জীবকোষের অমরত্বের রহস্য

প্রথম ক্লোনড ভেড়া ডলি

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল কোষের পরিবর্তন সময়ের মতোই একমুখী, তাকে কিছুতেই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় না। ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলনের ফলে যে ভ্রূণ তৈরি হয়, সেখানে শুরুতে সামান্য যে কটি কোষ থাকে, তা নবীন অবিশেষায়িত কোষ। অর্থাৎ এই কোষগুলো থেকেই শরীরের সব কোষ তৈরি হয়। এই কোষগুলো বিভাজিত হতে হতে ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্য বিশেষায়িত হয়ে যায়। ভ্রূণের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নবীন প্রাথমিক কোষগুলো পরিণত হয়ে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গঠিত হতে থাকে।

কিছু কোষ পরিণত হয় স্নায়ুকোষে, কিছু যকৃতে, কিছু মস্তিষ্কে, কিছু হৃৎপিণ্ডে ইত্যাদি। তারপর যকৃতের কোষগুলো শুধু যকৃতের কাজই করে, হৃৎপিণ্ডের কোষগুলো হৃৎপিণ্ডের। কোষগুলো একবার পরিণত হয়ে বিশেষায়িত হয়ে গেলে তাকে আর কখনো অবিশেষায়িত তরুণ কোষে পরিবর্তন করা যায় না, এ রকম বিশ্বাসই ছিল বিজ্ঞানীদের। প্রাথমিক নবীন কোষগুলো শুরুতে যেকোনো অঙ্গের অংশ হতে পারে কিন্তু পরে ক্রমেই বিভাজিত হতে হতে যখন বিশেষায়িত হয়ে যায়, তখন আর কিছুতেই প্রাথমিক অবিশেষায়িত অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না। কিন্তু ১৯৫৮ সালে বিজ্ঞানীদের এই ধারণা বদলে দিলেন একজন ব্রিটিশ তরুণ জন গর্ডন। জীববিজ্ঞানে ক্লোনিংয়ের সূত্রপাত হয়েছে জন গর্ডনের আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। জন গর্ডনের লেখাপড়া ও গবেষণা সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে তাঁর বিজ্ঞান পড়ার সুযোগই যেখানে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল, সেখানে নোবেল পুরস্কার পাওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার।

জন গর্ডনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ২ অক্টোবর, ইংল্যান্ডে। তাঁর বাবা-মা তাঁকে সবচেয়ে নামীদামি স্কুলে পড়িয়েছেন। ১২ বছর বয়সে গর্ডনকে ভর্তি করিয়েছেন ইউরোপের সবচেয়ে দামি প্রাইভেট স্কুল—ইটন কলেজে। ইটন কলেজের শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের ‘মানুষের মতো মানুষ’ তৈরি করে দেন বলে বিশ্বাস অনেকের। কিন্তু গর্ডন ঠিক তাল মেলাতে পারলেন না সেখানে। বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল ঠিকই, কিন্তু নিজের মতো করে পড়াশোনা করতে গিয়ে কিছুই হলো না। এই দামি কলেজের বিজ্ঞান পড়ানোর পদ্ধতি ছিল অনেকটাই মুখস্থনির্ভর। ক্লাসে নোট নাও, দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলনসহ সবকিছু মুখস্থ করে পরীক্ষায় হুবহু লিখে দাও, শিক্ষকেরা তোমাকে ভালো ছাত্র বলবে। কিন্তু জন গর্ডনের পক্ষে এটা করা সম্ভব হয়নি। তাই সেখানে মোটেও ভালো ফলাফল করতে পারেননি তিনি।

ইটনের শিক্ষকদের মতে, ক্লাসের ২৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে গর্ডন ছিলেন সবচেয়ে খারাপ ছাত্র। ফলে ইটন কলেজের পড়াশোনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও বিজ্ঞানের কোনো শাখায় ভর্তির দরখাস্তও করতে পারেননি তিনি। ক্লাসিক সাহিত্যে ভর্তি হওয়ার দরখাস্ত করেছিলেন অক্সফোর্ডের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে। কিন্তু ভর্তি অফিসে কিছু কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। অ্যাডমিশন অফিস থেকে তাঁকে ফোন করে জানানো হয় যে ক্লাসিক সাহিত্যের বদলে তাঁকে প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে হবে। পরে জানা গিয়েছিল, সেই বছর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ক্রাইস্ট চার্চ কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে ৩০টি সিট খালি ছিল। সেই খালি সিটে ভর্তি করার জন্যই জন গর্ডনকে প্রাণিবিজ্ঞানে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। স্কুলে থাকতেই তাঁর আকর্ষণ জন্মেছিল প্রাণিবিজ্ঞানের প্রতি। তাঁর সেই আগ্রহকে শেষ করে দেওয়ার সব চেষ্টা তাঁর শিক্ষকেরা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও এই সুযোগ যখন এসে গেল তিনি তার পুরোটাই কাজে লাগালেন।

শুরু হলো গর্ডনের তুমুল বিজ্ঞানচর্চা। স্নাতকোত্তর শেষ করে পিএইচডি করেন অধ্যাপক মাইকেল ফিশবার্গের অধীনে নিউক্লিয়ার ট্রান্সপ্লান্টেশন বা কোষের নিউক্লিয়াস স্থানান্তরপ্রক্রিয়ার ওপর। জীবকোষ রূপান্তরের একমুখী ধারণা সম্পর্কে গর্ডন ভাবলেন, এত দিনের বদ্ধমূল ধারণা তো ভুলও হতে পারে। একটা কোষ যখন এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হয়, তখন কি তার প্রাথমিক অবস্থার সব স্মৃতিই মুছে যায়? যে জিনেটিক কোড তাদের পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করে, সেই কোডের কিছুই কি অবশিষ্ট থাকে না? যদি কিছু স্মৃতিও কোষের নিউক্লিয়াসে থাকে, তাহলে সেই স্মৃতি কাজে লাগিয়ে পরিণত কোষের মধ্যে নবীন কোষের বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। ১৯৫৮ সালে তিনি ব্যাঙের ডিম্বকোষের অপরিণত অবিশেষায়িত নিউক্লিয়াস সরিয়ে সেখানে পাকস্থলির প্রবীণ কোষের নিউক্লিয়াস ঢুকিয়ে দেন। এই পরিবর্তিত ডিম্বকোষগুলো যথাসময়ে স্বাভাবিক ব্যাঙাচিতে পরিণত হয়। তারপর পিএইচডি থিসিস জমা দিয়ে ব্যাঙাচিগুলো প্রফেসর ফিশবার্গের কাছে রেখে তিনি পোস্ট ডক্টরেট করতে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ক্যালটেকে ব্যাকটেরিয়ার বংশগতির ওপর তিন বছর গবেষণা করে ফিরে আসেন অক্সফোর্ডে। ১৯৬২ সালে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে যোগ দেন সহকারী প্রভাষক হিসেবে।

তত দিনে ব্যাঙাচিগুলো পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে পরিণত হয়েছে। সফলভাবে ব্যাঙের ক্লোন তৈরি হয়েছে। সে বছরই প্রকাশিত হলো তাঁর কালজয়ী গবেষণাপত্র ‘দ্য ডেভেলপমেন্টাল ক্যাপাসিটি অব নিউক্লিয়াই টেকেন ফ্রম ইন্টেস্টাইনাল এপিথেলিয়াম সেলস অব ফিডিং ট্যাডপোলস’। জন গর্ডন আবিষ্কার করলেন যে পরিণত প্রবীণ কোষগুলোকে আবার ঝকঝকে নবীন কোষে রূপান্তর করা যায়। ‘ক্লোন’ শব্দটি গাছের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকে প্রচলিত হলেও প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী হ্যালডেন ১৯৬৩ সালে, গর্ডনের গবেষণালব্ধ ফলাফল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে।

গর্ডনের আবিষ্কারকে শুরুতে পাত্তা দিতে চাননি অনেকেই। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা যখন গর্ডনের পদ্ধতি ব্যবহার করে সাফল্য পেতে শুরু করলেন, স্টেমসেল গবেষণার পালে হাওয়া লাগল। নিম্ন প্রজাতির প্রাণী থেকে শুরু করে স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্লোন তৈরি করার চেষ্টা চলল। ১৯৯৬ সালে স্কটল্যান্ডের রোজলিন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী আয়ান উইলমুট ও কিথ ক্যাম্পবেলের নেতৃত্বে যখন প্রথম স্তন্যপায়ী ক্লোন ভেড়া ডলির জন্ম হলো, পৃথিবীব্যাপী হইচই পড়ে গেল।

গর্ডনের আবিষ্কৃত পদ্ধতির ভিত্তিতে স্টেমকোষের বিভিন্ন রকমের গবেষণা চলতে থাকে এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। এমব্রায়োনিক স্টেমসেল–সংক্রান্ত গবেষণার জন্য ২০০৭ সালের চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় মারিও ক্যাপেচি, মার্টিন ইভানস ও অলিভার স্মিথকে।

জন গর্ডনের পদ্ধতিতে একটা পরিণত বিশেষায়িত কোষকে অপরিণত অবিশেষায়িত কোষে রূপান্তরের জন্য একটা কোষ থেকে নিউক্লিয়াস বের করে সেখানে অন্য পরিণত কোষের নিউক্লিয়াস স্থাপন করতে হয় পরীক্ষাগারে একটার পর একটা। এই জটিল পদ্ধতির কোনো বিকল্প কি আছে? পুরো একটা পরিণত কোষকে কি সরাসরি নবীন কোষে পরিণত করা সম্ভব? জাপানের কায়তো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর শিনিয়া ইয়ামানাকা প্রমাণ করেছেন এটা সম্ভব।

২০০৭ সালের নোবেল বিজয়ী মার্টিন ইভানস ইঁদুরের এমব্রায়োনিক স্টেমসেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন ল্যাবরেটরিতে। ইঁদুরের ভ্রূণ থেকে অবিশেষায়িত নবীন কোষ আলাদা করে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে সেই কোষগুলোর সফল বিভাজন ঘটিয়ে অনেকগুলো স্টেমসেল তৈরি করেছেন। ইয়ামানাকা সেই ব্যাপারটাকে কাজে লাগালেন। তিনি দেখতে চাইলেন নবীন কোষগুলোকে নবীন থাকতে সাহায্য করে কোন কোন জিন? ইয়ামানাকা বিভিন্ন রকমের জিনের সমন্বয় করে পরীক্ষা চালালেন। চার ধরনের জিনের একটা সহজ সমন্বয় এনে দিল তাঁর গবেষণার সাফল্য। ইয়ামানাকা ইঁদুরের শরীর থেকে একটা বিশেষায়িত প্রবীণ কোষ নিয়ে সেখানে চারটা জিন প্রবেশ করিয়ে পুরো কোষটাকেই অবিশেষায়িত নবীন কোষে রূপান্তর করতে সফল হলেন। তিনি এই কোষগুলোর নাম দিলেন ইনডিউজড প্লুরিপোটেন্ট স্টেমসেল বা আইপিএস সেল। এই আইপিএস সেল থেকে পূর্ণাঙ্গ ইঁদুর তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন ইয়ামানাকা। ২০০৬ সালে ইয়ামানাকার গবেষণাপত্র ইনডাকশান অব প্লুরিপুটেন্ট স্টেমসেলস ফ্রম মাউস এমব্রায়োনিক অ্যান্ড অ্যাডাল্ট ফাইব্রোব্লাস্ট কালচারস বাই ডিফাইন্ড ফ্যাক্টরস প্রকাশিত হয় সেল জার্নালে।

প্রবীণ কোষকে নবীন কোষে পরিণত করার পদ্ধতি যখন জানা হয়ে গেল, তখন কোষের অমরত্বপ্রাপ্তির রহস্য জানা হয়ে গেল। যেকোনো পরিণত কোষকে অপরিণত কোষে রূপান্তর করা সম্ভব। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আশা করছেন, অনেক জটিল রোগের সমাধান পাওয়া যাবে এখন। পার্কিনসন্স, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। আইপিএস কোষ কাজে লাগিয়ে শরীরের সব প্রত্যঙ্গের কোষ তৈরি করা সম্ভব। যেমন একজন রোগীর ত্বক থেকে একটা কোষ নিয়ে তাকে আইপিএস কোষে রূপান্তর করে আবার বাড়তে দিলে দেখা যাবে কীভাবে রোগের সংক্রমণ ঘটে। ফলে রোগ প্রতিরোধ করা সহজ হবে। জন গর্ডন ও অধ্যাপক শিনিয়া ইয়ামানাকার এ আবিষ্কার লাখো মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাণিদেহের ম্যাচিউর সেল বা প্রবীণ কোষকে কৃত্রিমভাবে আবার নবীন কোষে রূপান্তর করার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ২০১২ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন স্যার জন গর্ডন ও অধ্যাপক শিনিয়া ইয়ামানাকা।

৮৫ বছর বয়সেও জন গর্ডন প্রতিদিন ভোর চারটায় তাঁর গবেষণাগারে গবেষণা শুরু করেন। অন্য গবেষকেরা আসার আগেই প্রতিদিন পাঁচ ল্যাবরেটরিতে কাজ হয়ে যায় তাঁর। ছবিতে স্যার গর্ডনের ল্যাবের ডেস্কে ফ্রেমবন্দী যে সনদ দেখা যাচ্ছে, তা অভিনব। জীবনে এত কিছু অর্জন করেছেন—কোনো সনদই তিনি ফ্রেমবন্দী করেননি। অথচ এই বিশেষ সনদটি বাঁধাই করে কাজের টেবিলে রেখে দিয়েছেন চোখের সামনে। কী আছে এতে? বামের পাতায় সনদটির ক্লোজআপ দেওয়া হয়েছে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, স্কুল অব বায়োমেডিকেল সায়েন্সস, আর এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: নোবেল পুরস্কার ওয়েবসাইট, গর্ডন ইনস্টিটিউট, দি গার্ডিয়ান