ডেঙ্গু ভ্যাকসিন গবেষণায় অগ্রগতি কতদূর?

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশাফাইল ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির আবারো মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। ২০১৯ সালের ভয়াবহতা, আতঙ্ক ও ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি আবারো ফিরে আসছে। যদিও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা হলো ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ। বাংলাদেশে গত দুই দশকেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, ডেঙ্গু ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন আছে কি? এ নিয়ে কি কোনো গবেষণা হচ্ছে? হলে তার অগ্রগতি কতদূর? বিশেষত কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিনের অভূতপূর্ব সাফল্যে মানুষের মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে।

এসব প্রশ্নের উত্তর দেবো। তার আগে ডেঙ্গু ভাইরাস ও তার আক্রমণে আমাদের শরীরে যেসব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে তা সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। ডেঙ্গু ভাইরাসের মূলত চার ধরণের সেরোটাইপ থাকে। এর যে কোনোটায় প্রথমবার আক্রান্ত হলে রোগের ধরণ সাধারণত হালকা থাকে। কিন্তু যখন দ্বিতীয়বার ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস আক্রমণ করে, তখন রোগ মারাত্মক হেমোরেজিক ফর্ম বা সেপটিক ফর্মে রূপ নিতে পারে। ফলে মৃত্যুও হতে পারে।

অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রে যেখানে প্রথমবার ইনফেকশনের কারণে আমাদের শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয় এবং সে এন্টিবডি ভবিষ্যতে একই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও তাই হয়। কিন্তু একম হয় শুধু একই সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হলে। এক সেরোটাইপের বিপরীতে তৈরি এন্টিবডি অন্য সেরোটাইপের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে না। বরং ভিন্ন সেরোটাইপের ইনফেকশনে মানুষের শরীরে অপ্রত্যাশিত এক ধরণের ইমিউন রিঅ্যাকশন ঘটতে পারে। এর সঙ্গে প্রথমবারের ইনফেকশনের কারণে তৈরি এন্টিবডি কোনো না কোনো ভাবে জড়িত বলে ধারণা করা হয়। 

সত্যি বলতে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে প্রায় ৭৫ বছর ধরে। কিন্তু আজও আমাদের হাতে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে সার্বজনীনভাবে প্রয়োগযোগ্য, নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন নেই। যে কারণে ভিন্ন সেরোটাইপের ইনফেকশনে আমাদের শরীরে অযাচিত ও অপ্রত্যাশিত বিক্রিয়া ঘটে, ঠিক একই সমস্যার কারণে একটি যথোপযুক্ত ভ্যাকসিন তৈরি করাও মুশকিল। এর পাশাপাশি আরও সমস্যা হলো, প্রাণী মডেল ভ্যাকসিন যেভাবে কাজ করছে, মানুষের শরীরের সঙ্গে তার তারতম্য হচ্ছে।  আবার ভ্যাকসিন ঠিকভাবে আমাদের শরীরে কাজ করছে কিনা, তা নির্ণয় করার জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তিরও অভাব আছে।

এ পর্যন্ত ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে অনেক ধরণের ভ্যাকসিন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু শুধু লাইভ অ্যাটেনিউটেড ভ্যাকসিন (যার মানে হলো অবদমিত করা জীবন্ত ভাইরাস) অনুমোদন পেয়েছে। মানে ক্লিনিকাল ট্রায়ালে এগিয়ে যেতে পেরেছে। সানোফি পাস্তুর কোম্পানির 'ডেঙভাক্সিয়া' হলো ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রথম ভ্যাকসিন যা ২০১৫ সালে মেক্সিকোতে অনুমোদন পায়। পরে আরও ২০টি দেশে অনুমোদন পায় এ ভ্যকসিন। রিকম্বিনেন্ট টেকনোলজি ব্যবহার করে ইয়েলো ফিভার ভাইরাসের কাঠামোতে ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪ ধরণের সেরোটাইপের বিভিন্ন এনভেলপ প্রোটিনের শংকর বানিয়ে তৈরি করা হয়েছে 'ডেঙভাক্সিয়া’। যদিও ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে প্রথম ভ্যাকসিন হিসেবে অনেক আশার সঞ্চার করেছিল এই ভ্যাকসিন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের শেষের দিকে দেখা যায়, আগে ডেঙ্গু হয়নি এমন শিশুদের মাঝে ভ্যাকসিন না নেওয়া শিশুদের তুলনায় ভ্যাকসিন নেওয়া শিশুদের গুরুতর রোগের হার বেশি। ‘ডেঙভাক্সিয়া’ ভ্যাকসিনের এই ব্যর্থতার কারণ এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এ নিয়ে অনেক রকমের ধারণা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, এ ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে, বিশেষত অল্পবয়সী বাচ্চাদের শরীরে অনেকটা প্রথমবার ডেঙ্গু ইনফেকশনের মতো কাজ করে। যাতে দ্বিতীয়বার ইনফেকশন হলে শরীরে ওপরে উল্লেখিত ইমিউন রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে রোগের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়।

এসব কারণে ‘ডেঙভাক্সিয়া’ ভ্যাকসিন ব্যবহারের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। শুধু ৯ বছরের বেশি বয়সের শিশুদের মাঝে যাদের আগে ডেঙ্গু হয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রেই শুধু এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার সুপারিশ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মতেও বলা হয়েছে, যাদের আগে ডেঙ্গু হয়েছে তাঁদের শুধু ‘ডেঙভাক্সিয়া’ প্রয়োগ করা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের তথ্য অনুযায়ী, ৯-১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে এবং যাদের আগে একবার ডেঙ্গু হয়েছে তাদের মধ্যে ‘ডেঙভাক্সিয়া’ ভ্যাকসিন খুবই নিরাপদ এবং ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ ও ভাইরাস জনিত গুরুতর রোগ ও হাসপাতালে ভর্তি হবার প্রয়োজনীয়তার বিচারে এর কার্যকারিতা প্রায় শতকরা আশি ভাগ। ‘ডেঙভাক্সিয়া’ যদিও এখনও যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও অনেক দেশেই অনুমোদিত, তবে এর ব্যবহার খুবই সীমিত। 

ডেঙভাক্সিয়ার ক্লিনিকাল ট্রায়ালের অভিজ্ঞতা থেকে ডেঙ্গু সেরোপজিটিভ (যাদের আগে একবার ইনফেকশন হয়েছে) আর সেরোনেগেটিভ (যাদের আগে কখনও ইনফেকশন হয়নি) মানুষের মাঝে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তারতম্য দেখে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে নতুন ভ্যাকসিনের গবেষণায় আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।  এসময়ে নতুন প্রজন্মের দুটি ভ্যাকসিন সম্প্রতি ক্লিনিকাল ট্রায়াল শেষ করেছে। তাকেদা কোম্পানির ভ্যাকসিন TAK-003 একটি টেট্রাভেলেন্ট ভ্যাকসিন। যা ডেঙ্গু ভাইরাস সেরোটাইপ ২-এর কাঠামোতে চার সেরোটাইপের জেনেটিক ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে তৈরি।  অর্থাৎ এ ভ্যাকসিন চার ধরনের সেরোটাইপের বিরুদ্ধেই কাজ করার কথা। আবার এই ভ্যাকসিন সেরোপজিটিভ বা সেরোনেগেটিভ দুই ধরনের মানুষের মধ্যেই ৪-৬০ বছর বয়সীদের মাঝে কার্যকরী হবার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে।  ক্লিনিকাল ট্রায়ালে প্রায় বিশ হাজার মানুষের উপর গবেষণা করে এই ভ্যাকসিনের সামগ্রিক কার্যকারিতা পাওয়া গেছে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ। ডেঙ্গু রোগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বিপরীতে কার্যকারিতা ছিল শতকরা ৯৫ ভাগ। আবার যেসব মানুষ ডেঙ্গু সেরোনেগেটিভ ছিলেন, অর্থাৎ যাদের আগে কখনো ডেঙ্গু হয়নি, তাঁদের মধ্যেও এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ছিল প্রায় ৭৫ ভাগ।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের সাম্প্রতিক রিভিউতে দেখা গেছে, ডেঙ্গু সেরোপজিটিভ মানুষদের ক্ষেত্রে, TAK -003 ডেঙ্গু ভাইরাসের যেকোন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিচ্ছে। আর সেরোনেগেটিভ মানুষদের ক্ষেত্রে শুধু সেরোটাইপ ১ ও ২-এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিচ্ছে। সেরোটাইপ ৩ ও ৪-এর ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে এখনো প্রশ্ন বা অনিশ্চয়তা রয়েছে। TAK-003 ইতিমধ্যেই আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যে অনুমোদিত হয়েছে। সেখানে এটি 'কিউডেঙ্গা' নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে এফডিএতে অনুমোদনের জন্য আবেদন করলেও, এফডিএ আরও গবেষণা তথ্য চেয়েছে। ফলে কোম্পানি সম্প্রতি তাদের আবেদন প্রত্যাহার করে নেয়।

ব্রাজিলের বুটানটান ইনস্টিটিউট ১৬ হাজার মানুষ নিয়ে আরেকটি টেট্রাভেলেন্ট ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে। প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী, এই ভ্যাকসিনের সামগ্রিক কার্যকারিতা প্রায় ৮০ ভাগ। ডেঙ্গু সেরোপজিটিভ মানুষদের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা প্রায় ৯০ ভাগ এবং সেরোনেগেটিভ মানুষের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা প্রায় ৭৫ ভাগ। সেরোটাইপ ২-এর তুলনায় সেরোটাইপ ১-এর বিরুদ্ধে এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বেশি। অন্যদিকে সেরোটাইপ ৩ ও ৪-এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে এখনো যথেষ্ট তথ্য নেই। এই ক্লিনিকাল ট্রায়াল এখনো চলছে। ২০২৪ সালের মধ্যে এ বিষয়ে আরও বেশি চূড়ান্ত তথ্য জানা যাবে।

মোদ্দাকথা, ডেঙ্গু ভাইরাসের তিনটি ভ্যাকসিনই যাদের আগে ডেঙ্গু হয়েছে তাঁদের সংক্রমণ ও গুরুতর রোগ, দুটোর বিরুদ্ধেই ভালো কার্যকারিতা দেখাচ্ছে। কিন্তু সেরোটাইপের ভিত্তিতে কার্যকারিতার তারতম্য দেখা যাচ্ছে। আবার সেরোপজিটিভ এবং সেরোনেগেটিভ দুই গ্রূপের মানুষের মধ্যে সব ধরনের সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সংক্রমণ, গুরুতর রোগ ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনীয়তার আলোকে কার্যকারিতা বিষয়ে এখনও আরও অনেক জানার বাকি আছে। কাজেই বলা যায়, ডেঙ্গু রোগের জন্য কোনো আদর্শ ভ্যাকসিন এখনও আমাদের হাতে নেই। কিন্তু সম্ভাবনা আছে। আছে আংশিকভাবে সফল কিছু ভ্যাকসিন, যার একটি ইতিমধ্যে বেশ কিছু দেশেই অনুমোদিত। আর অন্যগুলো এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায়। প্রথম ভ্যাকসিনের চেয়ে নতুন দুটো ভ্যাকসিনের ভালো দিক হলো, এগুলো যাদের আগে ডেঙ্গু হয়নি, তাদের মধ্যেও ভালো কার্যকারিতা দেখাচ্ছে।

আশা করা যায় ভবিষ্যতে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের সেরোটাইপ ভিত্তিক কার্যকারিতার তারতম্য কমিয়ে আনা যাবে এবং একটি পরিপূর্ণ ভ্যাকসিন আমাদের হাতে আসবে। তবে এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, সামগ্রিকভাবে ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের অগ্রগতি মন্থর। ভ্যাকসিন গবেষণায় সায়েন্টিফিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি যেসব দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি, সেসব দেশে এ জন্য যথেষ্ট অর্থ বিনিয়োগ ও কারিগরি দক্ষতার অভাব রয়েছে। এ পর্যন্ত পাওয়া বেশিরভাগ সফল ভ্যাকসিনের পেছনে আছে ধনী রাষ্ট্রগুলোর সরকার ও বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর বড় বড় বিনিয়োগ। কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে তা অনেকটাই অনুপস্থিত। এসব বিচারে বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষের সার্বজনীনভাবে প্রয়োগযোগ্য ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের সুফল পাওয়া এখনও সুদূর প্রসারী ব্যাপার। তবে রোগের ঝুঁকি, বয়স ও আগে কখনো ডেঙ্গু হয়েছিল কিনা তার তথ্য বিচার করে জনসংখ্যার একটি সুনির্দিষ্ট অংশকে বর্তমানে অনুমোদিত ভ্যাকসিন দেওয়া যায় কিনা, তা নিয়ে সরকারিভাবে একটি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে একযোগে সারা দেশজুড়ে মশকনিধনে একটা ম্যাসিভ ক্যাম্পেইন প্রয়োজন। সরকার চাইলে সারাদেশ থেকে ডেঙ্গুবাহী মশার উৎখাত নিশ্চয়ই সম্ভব। ঠিক যেমনভাবে একদিনে কোটি মানুষকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হয়েছিল !

লেখক: ক্লিনিকাল মাইক্রোবায়োলোজিস্ট ও সহকারী অধ্যাপক, ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি, হ্যামিলটন, কানাডা