প্রাণিজগৎ
পাখির নাম হট্টিটি
এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…
প্রাচীন জমিদার বাড়িটার চারপাশ জুড়েই এখন নানান রকম ঝোপঝাড় ও লতা-গুল্মের রাজত্ব। বড়-সড় গাছও কিছু আছে, আছে বয়সী কয়েকটি নারকেল গাছ। শেওলা জমা দেয়ালে যশরে লতার ঘন আচ্ছাদন। ভগ্নদশা বাড়িটা এখন পরিত্যক্ত। মানুষজনের আনাগোনা নেই। ভবনের রুমগুলোর ভেতরেও জন্মেছে নানান রকম লতা-গুল্ম। শেয়াল-খাটাসের আড্ডা ওখানে। ছাদের কাঠের কড়ি-বরগায় ঝুলে থাকে কাঠবাদুর আর চামচিকারা।
জমিদার বাড়ির সীমানা যেখানে শেষ, সেখান থেকে শুরু বিশাল একটি মাঠের। বলতে গেলে বাড়িটার চারপাশ জুড়েই খোলামাঠ। এখন এই ফাল্গুন মাসে মাঠটি শুকনো। ধানের নাড়া, ‘বাঘজামা’ নামের ছোট ছোট নরম গাছ, নানান রকম ছোট ছোট ঘাস জন্মেছে মাঠ জুড়ে। আছে উঁচু উঁচু চওড়া ঘাসের আইল। মাঠের ভেতরে আছে কিছু কিছু উঁচু জমি, ওসব জায়গাগুলোতে চমৎকার সব ঝোপ, আছে দু-পাঁচটি তাল-খেজুর গাছ। এখন এই ফাল্গুনে মাঠটির রঙই যেন গেছে বদলে। মাঠের চারপাশ জুড়ে গাছপালার সবুজ দেয়াল।
এখন এই বসন্তকালে মাঠজুড়েই ফুটেছে নাকফুল ও কানের দুলের মতো লাল-হলুদ ঘাসফুল। নীলচে রঙের ‘বাঘজামা’ ফুলও ফুটেছে। আর শুকনো মাঠ পেয়ে কত রকম মাঠের পাখি যে এসে জুটেছে! কসাই, নীলকণ্ঠ, মেঠোছাতারে, ভরত, পিপিট ও ধানটুনি। আইলের ঘাসের গোড়ায় বাসা বাঁধে ধানটুনিরা। ভরত-পিপিট বাসা করে আইলের ভেতরে। ওদের জন্য তাই এই মাঠটি এখন স্বর্গরাজ্য। মাঠের ভেতরে হেঁটে হেঁটে ওরা খাবার খায়। রাতে আশ্রয় নেয় আইলের ভেতরে, ছোট ছোট ঘাসঝোপ ও ধানের নাড়ার ভেতরে।
মাঠের কিনারের ওই জমিদার বাড়িতে কিছু বুনো কবুতরও থাকে। ওই কবুতরের লোভে, কবুতরের বাচ্চাদের লোভে ওখানে নিয়মিত টহল দেয় বনবিড়াল ও গেছো খাটাসরা, দিনে আনাগোনা করে কিছু শিকারি পাখি।
নীলচে রঙের ‘বাঘজামা’ ফুলও ফুটেছে। আর শুকনো মাঠ পেয়ে কত রকম মাঠের পাখি যে এসে জুটেছে! কসাই, নীলকণ্ঠ, মেঠোছাতারে, ভরত, পিপিট ও ধানটুনি।
তো সেই বসন্তকালেরই এক সকালে একটি বড় সড় বাজপাখি এসে বসল উঁচু একটি নারকেল গাছের মাথায়। জমিদার বাড়ির ছাদের দিকে সে তাকিয়ে রইল লোভী দৃষ্টিতে। গলাটা এই লম্বা করছে, এই গুটিয়ে নিচ্ছে। ছাদের পুরু কার্নিশের ওপর নামবে কিনা ভাবছে। কেননা, শিকারের সন্ধান সে পেয়ে গেছে ছাদের ওপরে। কিন্তু বিপদও আছে। যা হয় হবে—এ রকম ভাব নিয়ে যেই না বাজটি নেমে এসে বসল কার্নিশের ওপরে, অমনি গেলরে গেল-নিলরে নিল চিৎকার দিয়ে ছাদে বুক মিশিয়ে বসে থাকা চমৎকার গড়নের সাদাকালো পাখিটি উড়াল দিল—ধেয়ে গেল বাজটির দিকে। মাথা নিচু করে বাজটি ঠোকর এড়াল, ঘাবড়েও গেল একটু। উড়ন্ত পাখিটি ঘুরে আবারো ধেয়ে এল। সে কী গলার জোর ওর! যেন-বা ডাকাত পড়েছে, এভাবে চেঁচিয়ে ও পুরো এলাকা সরগরম করে ফেলেছে। ওর চিৎকারের শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে বহুদূর। চিৎকার শুনে ওর সঙ্গীও উড়ল মাঠের ভেতর দিয়ে—ওখানে ও খাবার সন্ধানে হেঁটে বেড়াচ্ছিল, দ্রুতবেগে উড়ে আসতে লাগল ও চেঁচাতে চেঁচাতে। ওই চেঁচানি শুনে মাঠের অপর প্রান্ত থেকে উড়াল দিল এক জোড়া নীলকণ্ঠ পাখি, চেঁচাতে চেঁচাতে ওরাও ঝড়ের বেগে এসে পড়ল জমিদার বাড়ির মাথার ওপরে। ঘাবড়ে গেল বাজটি।
৪টি পাখি যেভাবে সোরগোল তুলেছে, ডাইভ মারছে বারবার মাথা-পিঠ লক্ষ্য করে, আর ওই সোরগোল চেঁচামেচি শুনে এসে জুটছে শালিক-বুলবুল- ফিঙেরা, তাতে আর কার্নিশে বসে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করল না বাজটি। যেই উড়াল দিল, অমনি ‘ধরধর-মারমার’ শব্দে ৪টি পাখি তো বটেই, অন্য পাখিরাও ধাওয়া করল ডাকাতকে ছোট ও মাঝারি পাখিলো বটেই, আলুট করা এই বাজটি পাখির রাজ্যে সত্যিই ডাকাত। কিছু ঠোকর ডিম আঁচড় হজম করার পরেও সে বসল অন্য একটি উঁচু নারকেল গাছের আতার ওপরে। না, টিকতে পারল না তবুও। ওই ৪টি পাখি আর একটি ফিঙে তাকে নাস্তানাবুদ করার পরে উড়ল সে আবার। উঁচুতে উঠে পালিয়ে গেল মাঠ পাড়ি দিয়ে।
তখন ছাদের লম্বা পাওয়ালা পাখি দুটো তো বটেই, নীলকণ্ঠ দুটোও এসে বসল ছাদের পুরু কার্নিশের ওপর। সবকিছু ঠিকঠাক মতো আছে বুঝে নীলকণ্ঠ দুটো ফিরে চলল আবার আপন আস্তানার দিকে। লম্বা হলুদ পা ওয়ালা পাখি দুটো নেমে পড়ল এবার খোলা ছাদে। মেয়ে পাখিটি এগিয়ে এসে দাঁড়াল তার ছাদের বাসার পাশে, ঠোঁট বাড়িয়ে আদর করল ৩ ঘণ্টা বয়সী ছানাটিকে-আদর পেয়েই এতক্ষণে নড়েচড়ে উঠল ছানাটি। এতক্ষণ সে মাটির ঢেলার মতো পড়ে ছিল চুপচাপ। মায়ের বিপদ সঙ্কেত পাবার পরেই সে সহজাত প্রবৃত্তিতে পেয়ে গিয়েছিল বিপদের গন্ধ। বাসায় পড়েছিল স্ট্যাচু হয়ে। বাবা পাখিটিও ছানাটিকে দেখল গর্বিত চোখে। তারপর ‘গেলাম গেলাম, তাড়াতাড়ি আসব’ বলল দু-বার, উড়তে উড়তেও একই কথা বলল, চলে গেল মাঠের দিকে।
সন্ধ্যার আগেই ফুটে গেল সেদিন বাকি ৩টি ডিম। পুরুষ পাখি এর মধ্যে ৬বার খাবার মুখে এনে রেখে গেছে বউয়ের সামনে। বাসায় বসেই বউ তা খেয়েছে। শেষ বাচ্চাটি ফোটার পর বউটি যেন স্বামীকে দেখাতে চাইল বাচ্চাদের মুখ, বাসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে।
মা পাখিটি ঠোঁট নামিয়ে একে একে উল্টে-পাল্টে নিল বাসার তিনটি ডিম। তারপর দু-পা ছড়িয়ে বাসার ওপরে দাঁড়াল, শরীরে ও বুক-পেটের লোমে ঝাঁকুনি তুলল অল্প। বুক-পেটের নরম পালকের ভেতর যেন একটা চমৎকার ফোঁকর তৈরি হয়ে গেল। ওই ফোঁকরের ভেতর অদৃশ্য হলো ছানাটি, তখন আস্তে সে বসে গেল ডিম তিনটি পেটের তলায় নিয়ে। বসার ভঙ্গিটি খুবই চমৎকার। আজ সন্ধ্যার আগেই বাকি তিনটি ডিম ফুটে বাচ্চা হয়ে যাবে। ডিমের খোসাগুলো পুরুষ পাখিটি ঠোঁটে ধরে ফেলে দিয়ে আসবে দূরে। ব্যস, ৪টি ছানাকে নিয়ে তখন দু-জনে মিলে খুব আনন্দেই দিন কাটাবে।
এই আনন্দ তৈরির জন্য দু-জনকে কী কম কষ্ট করতে হয়েছে! এই খোলা ছাদের ওপরেই এরা বাসা করে আসছে গত তিন বছর ধরে। বাসাটিও খাসা বটে! মাঠ থেকে দু-জনে মিলে নিয়ে এসেছিল ছোট ছোট মাটির ঢেলা। সাজিয়েছিল বৃত্তাকারে গোল করে—একখানা পেতলের থালা যেন। অপেক্ষাকৃত বড় বড় ঢেলাগুলো ছিল বাইরের দিকে, ভেতরের দিকের ঢেলাগুলো ছোট ছোট। এই হচ্ছে বাসা। গোলগাল এই বাসাটিকে সাজাতে দু-জনের সময় লেগেছিল ৬ দিন। তারপরে বৃত্তের মাঝখানে ডিম পেড়েছিল মেয়ে পাখিটি। ২ দিনে ৪টি ডিম। সেই ডিমে পালা করে দু-জনেই তা দিয়েছিল ২৩ দিন। ২৩তম দিন সকালে ফুটেছিল প্রথম ছানাটি—যাকে পালকের ফোঁকরে আগলে রেখে বাকি ৩টি ডিম তা দিচ্ছে এখন মা। একটু আগে ডাকাত পাখিটি আসায় কী ধকলটাই না গেছে!
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চেঁচামেচি শুনে দূর থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে উড়ে এসেছিল দু-টি নীলকণ্ঠ পাখি। আমার বিচারে চেঁচামেচিতে নীলকণ্ঠ হচ্ছে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন পাখি। নীলকণ্ঠ মাঠের পাখি—ছাদের বাসায় বসা এই পাখিটিও মাঠের পাখি। স্বভাব-চরিত্র, খাদ্য ইত্যাদিতে যথেষ্ট মিল আছে এর নীলকণ্ঠের সঙ্গে। চেঁচামেচিতেও সে নীলকণ্ঠের চেয়ে কম যায় না। আমার দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ জীবনে আমি এই দুটি পাখির ভেতরে আশ্চর্য রকমের সহমর্মিতা লক্ষ করেছি। একের বিপদে অন্যে এগিয়ে আসবেই। এমন কি চিৎকার না শুনেও বহুদূর থেকে ওড়াউড়ি করতে দেখেও এই দুজাতের পাখি পরস্পরের বিপদের আলামত পেয়ে, ছুটে যায় ঊর্ধ্বশ্বাসে—এই পাখিটির বিপদে যেমন একটু আগে ছুটে যাসেছিল নীলকণ্ঠ দম্পতি। তেমনি নীলকণ্ঠের বিপদ দেখলেও ছুটে যাবে এরা। অবশ্য বাসায় যদি ডিম-বাচ্চা থাকে, তাহলে একটি পাখি যাবে, একটি থাকবে বাসা পাহারায়। খোলা মাঠের এই দু-জাতের পাখি বড়সড় যে কোনো মাঠে থাকলে সে মাঠের অন্যান্য ছোট জাতের পাখিতো বটেই, নিরীহ বড় ও মাঝারি পাখিরাও নিশ্চিন্ত থাকে—বিপদের গন্ধ পেলেই এই দু-জাতের পাখি বিমান হামলার সাইরেন হিসেবে কাজ করে। শত্রু দেখলেই এরা সাইরেন বাজিয়ে দেয়, সে সাইরেন ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর পর্যন্ত। সতর্ক হয়ে যায় অন্য পাখিরা। বিশেষ করে এই পাখিটি মাঠে নামা মেছোবিড়াল, গুইসাপ, বনবিড়াল, শিয়াল, খাটাস, বিষধর সাপ, খেকশিয়াল ইত্যাদি মাংস ও পাখির ডিম-বাচ্চা খেকো প্রাণীদের মাথার ওপরে ঘুরে ঘুরে ওড়ে, পিছু নেয় আর তারস্বরে চেঁচাতে থাকে, সুযোগ পেলে ডাইভ মারে। মাঠের অন্যান্য পাখি জেনে ফেলে শত্রুর অবস্থান। বড় জাতের শিকারি পাখিরা এই পাখিদের অনুসরণ করে; বিষধর সাপ, গুইসাপের বাচ্চা তুলে নিয়ে যায় নখরে গেঁথে। বিপদ দূর না হওয়া পর্যন্ত এই পাখিরা সাইরেন বাজিয়েই চলে। সাইরেনের শব্দের সঙ্গে অনায়াসে মিলিয়ে নেয়া চলে ‘হটে যা হটে যা, হটলি হটলি?’ নীলকণ্ঠের মতো এরাও ডিম-বাচ্চা হবার পরে টানটান টেনশনে থাকে সর্বক্ষণ, বিপদের গন্ধ পাওয়া মাত্রই সাইরেন বাজিয়ে দেয় আশপাশটা কাঁপিয়ে।
সন্ধ্যার আগেই ফুটে গেল সেদিন বাকি ৩টি ডিম। পুরুষ পাখি এর মধ্যে ৬বার খাবার মুখে এনে রেখে গেছে বউয়ের সামনে। বাসায় বসেই বউ তা খেয়েছে। শেষ বাচ্চাটি ফোটার পর বউটি যেন স্বামীকে দেখাতে চাইল বাচ্চাদের মুখ, বাসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। আশ্চর্য! ৪টি বাচ্চাই রয়ে গেল মায়ের বুক-পেটের লোমের ফোঁকরে। কৌতূহলী বাবা যখন ঘাড় কাত করে দেখতে চাইছে ছানাগুলোকে, তখন টুপুস করে একটি ছানা পড়ল ছাদে। বাবার কী খুশি তখন! কী সব যেন বলল ছানাটিকে, করল আদর। তারপর ডিমের খোলস নিয়ে উড়ে গেল দূরে।