অন্তত ১ কোটি ৪০ লাখ টন প্লাস্টিক প্রতিবছর জমা হয় সাগরের তলদেশে। এই দূষণ মারাত্মক প্রভাব ফেলে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র এবং মানুষের স্বাস্থ্যে। প্লাস্টিক সামুদ্রিক প্রাণীর গায়ে প্যাঁচিয়ে গিয়ে বা শ্বাসরোধ করে মারতে পারে। সাগরের অনেক প্রাণীই মাইক্রোপ্লাস্টিক খেয়ে ফেলে। এসব প্রাণীকে অন্য প্রাণী শিকার করে খায়। এমনকি মানুষের খাদ্যেও পরিণত হয় কিছু প্লাস্টিক খাওয়া প্রাণী। এভাবে প্লাস্টিকে থাকা বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো ছড়িয়ে পড়ে পুরো খাদ্যশৃঙ্খলে। অন্যদিকে স্থলভাগে বেশির ভাগ প্লাস্টিক জমা হয় বর্জ্যের স্তূপে। কিছু কিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়। ফলে নির্গত হয় বিষাক্ত ধোঁয়া। উৎপাদিত প্লাস্টিকের মাত্র ১৬ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হয় নতুন প্লাস্টিক তৈরিতে।
২০১৬ সালে জাপানি বিজ্ঞানীরা বিশ্বের প্লাস্টিক সমস্যা মোকাবিলা করতে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন। তাঁরা একধরনের ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন, যেগুলো প্লাস্টিকের বোতল খেয়ে হজম করতে পারে। বেশির ভাগ ব্যাকটেরিয়াই মৃত জৈব খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু আইডেওনেলা সাকায়েনসিস (Ideonella Sakaiensis) নামের ব্যাকটেরিয়াটি পেট বোতল খেয়ে বাঁচতে পারে। ব্যাকটেরিয়াটির জৈবরাসায়নিক বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, এরা একধরনের পাচক এনজাইম উৎপাদন করে। হাইড্রোলাইসিং পেট বা পেটেস (PETase) নামের এনজাইমগুলো পেট (Polyethylene Terephthalate) প্লাস্টিকের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। তখন এসব প্লাস্টিকের দীর্ঘ আণবিক শৃঙ্খল (পলিমার) ভেঙে ক্ষুদ্র আণবিক শৃঙ্খলে (মনোমার) পরিণত হয়। টেরেফথালিক অ্যাসিড এবং ইথিলিন গ্লাইকল এদের অন্যতম। এই মনোমারগুলো আবারও ভাঙে এবং ব্যাকটেরিয়া শারীরবৃত্তীয় শক্তি জোগায়।
জিনবিজ্ঞানীরা আইডেওনেলা সাকায়েনসিস নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। তাঁরা চেষ্টা করেছেন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আরও দক্ষ এনজাইম উৎপাদনে সক্ষম ব্যাকটেরিয়া তৈরি করতে। ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়াকেও পেটেস উৎপাদনকারী বানাতে চাইছেন তাঁরা। এ ধরনের সংবাদ আশা দেখায়, তবু বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন, আসলে গোটা পৃথিবীর প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণের মতো অবস্থায় যেতে হলে বহুদিন লেগে যাবে। তা ছাড়া পেটেস শুধু পেট প্লাস্টিক পচাতে পারে। কিন্তু পৃথিবীতে মোট ছয় ধরনের প্লাস্টিক রয়েছে।
সুপার পেটেস
যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা পেটেসের পুনর্ব্যবহারের মাধমে একটি এনজাইম ‘ককটেল’ তৈরি করেছেন। এটা স্বাভাবিকের চেয়ে ছয় গুণ দ্রুত প্লাস্টিক হজম করতে পারে। বিজ্ঞানীরা পেটেসকে আরেকটি প্লাস্টিকখেকো এনজাইম মেটেসের (MHETas) সঙ্গে যুক্ত করে একটি সুপার এনজাইম তৈরি করেন। এটি তৈরি করা হয়েছিল একটি সিনক্রোট্রন দিয়ে। সিনক্রোট্রন হলো এক ধরনের কণা ত্বরক, যা সূর্যের চেয়ে ১০ বিলিয়ন গুণ উজ্জ্বল এক্স–রে উৎপাদন করতে পারে। এটা গবেষকদের প্রতিটি এনজাইমের পরমাণু দেখতে এবং আণবিক নীলনকশা আঁকতে সাহায্য করে। ফলে এর সাহায্যে সহজেই ডিএনএ একত্র করে সুপার এনজাইম গঠন করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া এই এনজাইম সুগারভিত্তিক জৈব প্লাস্টিক পলিইথিলিন ফিউরানোয়েট (polyethylene Furanoate)–কেও ভাঙতে পারে।
প্লাস্টিককে ভ্যানিলায় পরিণত করা
স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ই কোলাই ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে আসছেন প্লাস্টিককে ভ্যানিলিনে রূপান্তর করতে, যা ভ্যানিলার প্রাথমিক উপাদান। ভ্যানিলিনের বৈশ্বিক চাহিদা ২০১৮ সালে ৩৭ হাজার টন ছাড়িয়ে গেছে এবং এর ৮৫ ভাগ তৈরি করা হয় জীবাশ্ম জ্বালানির রাসায়নিক উপাদান থেকে। এ ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প হতে পারে।
পেট প্লাস্টিককে ভেঙে মৌলিক এককে পরিণত করার পর গবেষকেরা মনোমারগুলোর একটি, টেরেফথালিক অ্যাসিডকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে রূপান্তরিত করা হয় ভ্যানিলিনে। এই ভ্যানিলিন মানুষের উপযোগী বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। তবে আরও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে এখনো।