দাবদাহ বা তাপপ্রবাহ কী?

বেশ কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া বিরাজ করছে দেশজুড়ে। অসহনীয় গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত। শুধু যে গরম, তাই নয়; কমে গেছে বাতাসের আর্দ্রতাও। ফলে চামড়ায় জ্বলুনি বা ঠোঁট ফাটার মতো ঘটনাও ঘটছে।

তীব্র এই গরম আবহাওয়াকে বলা হয় দাবদাহ বা তাপপ্রবাহ। পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই দাবদাহ হয় কমবেশি। আমাদের দেশেও গ্রীষ্মকালে দেখা যায় দাবদাহ। কিন্তু কী এই দাবদাহ? কেন আবহাওয়া এত উত্তপ্ত হয়?

বিশাল এলাকা জুড়ে গরম হাওয়া আটকা পড়লে দেখা দেয় দাবদাহ। পৃথিবীজুড়ে প্রবাহিত হওয়ার বদলে যখন নির্দিষ্ট অঞ্চলে বাতাসের কিছু অংশ আটকা পড়ে, তখন সেই বায়ুর তাপমাত্রা বাড়তে থাকে ক্রমাগত। বলা বাহুল্য, এই তাপের উৎস সূর্য।

প্রশ্ন হলো, বায়ুমণ্ডলের নির্দিষ্ট অঞ্চলে কিছু বাতাস কেন আটকা পড়ে?

এর কারণ, উচ্চচাপ। গ্রীষ্মকালে দিনের দৈর্ঘ্য সাধারণত বড় হয়। এরকম দিনে ভূপৃষ্ঠে সূর্যের আলো পড়ে অনেকটা বেশি সময় ধরে। ভূপৃষ্ঠ এই তাপ প্রতিফলিত করে। জলাধার বেশি থাকলে এই তাপের কিছুটা শোষিত হয়। তবে ভূপৃষ্ঠে জলাধারের পরিমাণ কম থাকলে, সেখান থেকে প্রচুর তাপ প্রতিফলিত হয় বায়ুমণ্ডলে। ফলে অতিদ্রুত বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়। বিশাল এলাকা জুড়ে ভূপৃষ্ঠে বাতাস এমন হঠাৎ উত্তপ্ত হলে আশপাশের ও ওপরের অপেক্ষাকৃত শীতল বায়ু একটা বদ্ধ ব্যবস্থা (সিস্টেম) তৈরি করে। এই সিস্টেমে চাপের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে।

জাতিসংঘের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC)-এর মতে, কোনো অঞ্চলে দুই দিন থেকে মাসখানেক সময় ধরে অতি অস্বাভাবিক গরম আবহাওয়া বিরাজ করলে সেটাকে দাবদাহ বলা যাবে।

অঞ্চল ভেদে দাবদাহের তাপমাত্রা আলাদা হয়। যেমন কোনো অঞ্চলের স্বাভাবিক গড় বা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যদি ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তাহলে সেখানে কয়েকদিন ধরে ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রা বিরাজ করলে সেটাকে দাবদাহ বলা হবে। কিন্তু যে অঞ্চলের স্বাভাবিক গড় বা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে কিন্তু এটাকে দাবদাহ বলা যাবে না। মোট কথা, দাবদাহ হওয়ার কোনো নির্ধারিত তাপমাত্রা নেই।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ক্লাইমেট নলেজ পোর্টালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রার ব্যাপ্তিটা হলো, ১৫ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে মৃদু দাবদাহ বলে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেলে ধরা হয় মাঝারি দাবদাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে ধরা হয় তীব্র দাবদাহ চলছে। ঢাকায় বর্তমানে তীব্র দাবদাহের কাছাকাছি তাপমাত্রা রয়েছে।

দাবদাহ প্রাণ-বৈচিত্র্যের জন্য ভালো কিছু নয়। এর ফলে ফসলের মারত্মক ক্ষতি হয়। হাইপারথার্মিয়া বা অতিগরমে অসুস্থ হয়ে পৃথিবীজুড়ে প্রতিবছর মারা যান হাজারও মানুষ। দাবানলের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে দাবদাহ। এ ছাড়াও, গরম থেকে বাঁচতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বেশি ব্যবহৃত হয়, তাই বিদ্যুৎ খরচ বেড়ে যায় দাবদাহের ফলে। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের সাধারণ যন্ত্রপাতি দিয়েই শনাক্ত করা যায় এ দাবদাহ।

দাবদাহের সময় শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয় এড়াতে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। বেশি করে পানি পান করতে হবে। শরীরকে আর্দ্র রাখা এ সময় খুব জরুরী। অতি প্রয়োজন ছাড়া এ সময় সরাসরি বাইরে থাকা উচিত নয়। ঘরের জানালা ভারী, অর্থাৎ তাপের কুপরিবাহী পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা যেতে পারে। এতে ঘরের তাপ সহনীয় থাকবে। বাইরে থেকে অসহ্য তাপ ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। তবে পর্দা মাঝে মাঝে সরিয়ে ঘরের ভেতরের বদ্ধ বাতাস বেরোনোর সুযোগও করে দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী জুড়েই আবহাওয়া অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানী ও পরিবেশ নিয়ে ভাবেন, এমন মানুষেরা বিষয়টি নিয়ে সবাইকে সর্তক করছেন। তারপরও আগের মতোই জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াচ্ছি আমরা, উজাড় করছি বন, প্লাস্টিক ব্যবহার করছি প্রতিদিন। পৃথিবীকে সুস্থ রাখতে হলে নিজেদের অভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে। কোনোভাবেই প্রকৃতির যেন ক্ষতি না হয়, লক্ষ্য রাখতে হবে সেদিকে। তাহলে হয়তো আবহাওয়ার এমন চরম অবস্থা আর তৈরি হবে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: উইকিপিডিয়া, সাইজিংকস, আইপিসিসি, প্রথম আলো