হাইওয়ে বা বিশ্বরোড আড়াআড়িভাবে পাড়ি দিয়ে দ্রুতবেগেই পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাওয়ার সময় কাঠবিড়ালিটি নিশ্চয়ই ডানে-বাঁয়ে দেখে নিয়েছিল ভালোভাবে, তারপরে লোমশ লেজটি অনেকটাই খাড়া করে দিয়েছিল দৌড়, আড়াআড়িভাবে পাড়ি দিতে চেয়েছিল হাইওয়েটি; কিন্তু ‘টাইমিং’ ভুল হওয়ায় দ্রুতগামী একটি বাসের পেছনের একটি চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যায়। রোডের পাশে দাঁড়ানো ছিল কয়েকজন মানুষ, তাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী। একজন আমার গ্রামের, তিনি মুঠোফোনে মৃত প্রাণীটির ছবি তুলে পাঠালেন আমাকে, বর্ণনা করলেন ঘটনাটি। জায়গাটি ফকিরহাট (বাগেরহাট) সদরেই, ফলতিতা মাছের আড়ত থেকে কয়েক শ গজ দক্ষিণে। চওড়া হাইওয়ের দুপাশের গ্রাম গ্রামীণ বনে সমৃদ্ধ। হাইওয়ে হওয়ার আগে গ্রামীণ বাগানগুলো জড়াজড়ি-মেশামেশি করে ছিল।
রাস্তা যখন কম চওড়া ছিল, তখনো রাস্তার দুপাশের বড়-মাঝারি গাছগুলো ডালপালা ছড়িয়ে—বলা যায় দুপাশের গাছ হাত বাড়িয়ে হাত ধরাধরি-জড়াজড়ি করে রাস্তার উপরিভাগে ‘চাঁদোয়া’ তৈরি করে রেখেছিল—গাড়িতে বসে যাতায়াতের সময় মনে হতো ‘টানেল’, সবুজ টানেলের ভেতর দিয়েই যেন চলেছে গাড়ি বা বাস। রাতের বেলায় গাড়ির হেডলাইটে ওই টানেলকে অলৌকিক টানেল বলেই মনে হতো। হাইওয়ে হওয়ার পরে সেই কত বছর ধরে সে রকম চাঁদোয়া নেই। টানেল নেই। দুপাশের কাঠবিড়ালিগুলো তাই পাড়ি দেয় মাটিতে নেমে, দৌড় দিয়ে। গাছের ডালের প্রাকৃতিক চাঁদোয়া তথা পদচারী–সেতু অথবা উড়ালসড়ক থাকলে কাঠবিড়ালিটি কখনো মাটিতে নেমে রাস্তা পেরোতে গিয়ে জীবন হারাত না। কেননা, কাঠবিড়ালিরা বন-বাগানে চলাচল করে একটা নির্দিষ্ট রুট ধরে। রুট ওদের মুখস্থ থাকে।
এক জোড়া কাঠবিড়ালি রাজত্ব করে যেটুকু এলাকাজুড়ে, সেটুকুকে ওরা ওদের ‘বাবার তালুক’ বলে মনে করে, মনে করে রাজ্য বা স্বাধীন রাষ্ট্র, ওই রাজ্যে স্বজাতির অন্য কারও প্রবেশ নিষিদ্ধ। ‘ডিক্টেটর’ কাঠবিড়ালিরা অনুপ্রবেশকারীদের মেরেকেটে তাড়িয়ে দেয়। তার রাজ্যসীমানার বিভিন্ন পয়েন্টে লুকিয়ে-ছাপিয়ে থাকার স্থানগুলোও থাকে ওদের মুখস্থ। মানুষসহ অন্য যেকোনো প্রাণীর ধাওয়া খেলে নির্দিষ্ট রুট ধরে দ্রুতবেগে ছুটে গিয়ে আত্মগোপন করে। এদের রুট হলো গাছ, গাছের ডালপালা, বাঁশঝাড়ের কাত হওয়া বাঁশ, নারকেল-সুপারি ও খেজুরের পাতা, ঝুলন্ত ব্রিজের মতো এ–গাছ থেকে ও–গাছে বয়ে যাওয়া মোটা মোটা ‘গাওছা লতা’ ইত্যাদি। গেরস্তবাড়ির গাছপালা, ঘরের চালা, কুটোর পালা, গোলাঘর ইত্যাদি। প্রয়োজনে এক গাছ থেকে লাফ দিয়ে অন্য গাছে যেতে পারে। রুট ধরে দৌড়াতে পারে দ্রুতবেগে। অনেক উঁচুতে একটা ঝুলন্ত-দুলন্ত নারকেল পাতার শেষ প্রান্ত থেকে লাফ দিয়ে পাশের নারকেল গাছটির একই রকম পাতার শেষ প্রান্তে পড়ে সার্কাসম্যানদের মতো ঝুলতে পারে, তার পরে সুড়সুড় করে নারকেল পাতার গোড়ায় পৌঁছে ডগার ভেতরে ঘাপটি মারতে পারে। প্রয়োজনে বা বিপদের সময় অ্যাক্রোব্যাটদের মতো উঁচু জায়গা থেকে লাফিয়ে ৫ থেকে ১০ ফুট নিচের কোনো গাছের মাথায় বা ঝোপের ওপরেও পড়তে পারে। ধরা যাক—একটি গাছ প্রয়োজনে কেটে ফেলা হয়েছে, অথবা প্রচণ্ড ঝড়ে বাগানের বহু গাছ লন্ডভন্ড হয়ে ভেঙে পড়ে গেছে। ও রকম সময়ে যদি ছেলেপুলেরা কোনো কারণে ধাওয়া করে কাঠবিড়ালিদের, অথবা বড়সড় শিকারি পাখিরা চায় নখরে গাঁথতে, সে ক্ষেত্রে মুখস্থ রুট ধরেই দ্রুতবেগে পালাতে গিয়ে কাঠবিড়ালিরা মহাবিপদে পড়ে যায়—রুট তো নেই! এই আমগাছের ডালটা ধরে পৌঁছানো যেত কাত হওয়া বাঁশের আগায়, বাঁশের আগাটা কই! ডানের ‘ডেওয়া ফল’ গাছটাও নেই! নেই লাফের সীমানায় থাকা আমলকী গাছটাও! তবে ২-৪ দিনের ভেতর ওরা আবার নতুন ‘বৃক্ষ-লতা’ রুটের পাকা নকশা করে ফেলে। প্রয়োজনে রুটের কিছু কিছু অংশ মাটিতেও পড়ে—মাটিতে নেমেই পাড়ি দেয় পথটুকু।
কিন্তু ফকিরহাটে বাসচাপা পড়া পুরুষ কাঠবিড়ালিটা (তার কয়েক পুরুষব্যাপী) যদি রুটের একটা অংশ হাইওয়েতে নির্বাচন করে থাকে—সেটা তার ভুল ছিল বলা যাবে না, তাকে তো ওপারে যেতেই হবে! তাদের রাজত্বের ভেতর দিয়ে হাইওয়ে বয়ে গেল, সেটা তো কাঠবিড়ালিটা বোঝে না। সে বোঝে জীবন, জীবনের স্বাধীনতা। শত শত বছরব্যাপী তার বংশধরেরা এই এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য গড়ে ডিক্টেটরশিপ চালিয়ে যাচ্ছে, সে তার নিজের রাজ্যটুকুই শুধু নয়, আশপাশের অন্য রাজ্যও চেনে-জানে, প্রয়োজনে ‘যুদ্ধ’ করে অন্যের রাজ্য দখল করে নিজের রাজ্য পরিত্যাগ করে, এটা করে নিজ রাজ্যে খাদ্য–সংকট দেখা দিলে, শত্রুর সংখ্যা বেড়ে গেলে তথা নিরাপত্তা–সংকট দেখা দিলে, সভ্যতা বিস্তারের জন্য মানবজাতি কোনো নতুন স্থাপনা নির্মাণের জন্য বনজঙ্গল কেটে ফেললে বা আরও কিছু নির্দিষ্ট কারণে। যুদ্ধে পরাজিত কাঠবিড়ালি ‘রাজা–রানি’ রাজ্য ছেড়ে পালায়, অন্য কোথাও আবার রাজত্ব গড়ে। কিন্তু ফকিরহাটের ওই কাঠবিড়ালিটা তো নিজের রাজ্য ছাড়া ‘ফকিরহাট উপজেলা’ বোঝে না। নিজের রাজ্য দুই ভাগ! ও পাশে তো তাকে যেতেই হবে। যেতে গিয়েই মৃত্যু হলো। রাস্তার দুই পারের গাছের ডালের ‘সাঁকো’ থাকলে ওটা কি আর পিচঢালা হাইওয়ে পাড়ি দিতে চাইত? প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাকে জানান—কাঠবিড়ালিদের মাঝেমধ্যে তারা হাইওয়ে পাড়ি দিতে দেখেন। কদিন আগেই এক জোড়া কাঠবিড়ালি হাইওয়ে পাড়ি দিয়ে পূর্ব পাশ থেকে পশ্চিমে আসে, ওদের সঙ্গে ছিল তিনটি সদ্য বাসা ত্যাগ করা ফুটফুটে ছানা। একটি বেওয়ারিশ বিড়াল গিয়েছিল তেড়ে—দৌড়ে পাঁচটি কাঠবিড়ালিই চড়ে বসে মেহগনিগাছের মাথায়। বিড়ালটিও গাছে চড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই ওটার মাথায় ছোঁ মেরে উড়ে যায় একটি ঝুঁটি শালিক। ওপাশের একটি গাছের কোটরের বাসায় ওদের চারটি উড়ুউড়ু ছানা যে!
ফকিরহাটের কাঠবিড়ালিটি মারা যায় গত নভেম্বরের (২০২১) ১৬ তারিখে। এটা একটি দুর্ঘটনা। তবুও মৃত প্রাণীটার ছবি দেখে কষ্ট বাজল বুকে। সেই কষ্টের সঙ্গে যোগ হলো আরও কয়েক টন কষ্ট (কষ্টের ওজন কি মাপা যায়?)। অথচ সেই কয়েক টন কষ্ট যখন জমা করেছিলাম (৬০-৮০ দশক), তখন ওগুলো সুখ-আনন্দ হিসেবেই জমা হয়েছিল বুক ও মনের গোপন কুঠুরিতে। একদিন যে সেই সুখ ও আনন্দ-উল্লাস কষ্টে রূপান্তরিত হবে, তা কি আর জানতাম?
একেবারে শৈশবেই পরিচয় আমার কাঠবিড়ালির সঙ্গে। পাঁচ-ছয় বছর বয়সে নিত্য দেখতাম ওদের আমাদের উঠোন-বাড়ির ফলগাছগুলোতে। ওই বয়সে ধরতে চাইতাম, মা-বাবা-নানা-নানি ও দাদিকে ধরে দিতে বলতাম। ঢিল ছুড়তাম। আমাকে ওরা ভয় পেত বলে মনে হয় না। কত রকম গাছ ছিল উঠোন-বাড়ি জোড়া! সফেদা-পেয়ারা-বরই-আতা-আমড়া-বুনো আমড়া (এটা খেত না), দারুচিনি, এলাচি (শুধু নীলরঙা চমত্কার ফুল ফুটত, ফল হতো না) জামরুল, কতবেল-করমচা-হামজুম-কাউফল-লুকলুকিসহ আরও কত গাছ! মৌসুমে মৌসুমে লাউ-শিম-বরবটির মাচান ও কাঁকরোল। খেজুর-কলা-নারকেল-সুপারি আর আমগাছ তো ছিলই। বলা যায়, প্রাকৃতিক বাগানবাড়ি। ফুলের গাছও ছিল নানান রকম। শৈশব-কৈশোর ও তরুণ বেলায় তো ওরা আমাদের অতি আপনজন হয়ে গিয়েছিল। এমন একটা দিন নেই, যেদিন ওদেরকে আমি দেখিনি—দেখিনি মজার মজার কাণ্ড। শৈশব-কৈশোরে গুলতি মারতাম। একটু বড় হয়ে বাঁশের আগা কেটে চটা বানিয়ে সেই চটা বাঁকা করে দড়ি বেঁধে ধনুক বানাতাম আমরা। তিরের ফলা করতাম পাটকাঠিকে। পরবর্তী সময়ে কঞ্চি অথবা বাঁশের চটার ফলা। গুলতি আর তির–ধনুকে ক্বচিৎ ঘায়েল করতে পারতাম ওদের। মূলত শৈশবে তীর–ধনুক দিয়ে আমরা তীর-ধনুকের ‘লড়াই লড়াই’ খেলতাম দুই দলে ভাগ হয়ে। মুরব্বিদের কাছে রাম-রাবণের লড়াইয়ের গল্প শুনে কৈশোরে আমরা ‘অগ্নিতির’ বানাতেও শিখেছিলাম। তিরের ফলার মাথায় কাপড় অথবা পাটের আঁশের দলা পেঁচিয়ে তাতে সামান্য কেরোসিন ঢেলে অগ্নি–সংযোগ করা হতো। তারপর শূন্যে ছোড়ো—যত দূরে বা উঁচুতে পারো। দুই দলে ভাগ হয়ে লড়াই করো। এই লড়াইটা আমাদের বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পৌষ মাসের এক সন্ধ্যার দুর্ঘটনার পরে। আমার হাতের ‘টিপ’ বা নিশানা ছিল অব্যর্থ। সবচেয়ে বেশি দূরে তিরের ফলা পাঠাতে পারতাম আমিই। তো ওই সন্ধ্যায় অগ্নিতিরের লড়াই-ই হচ্ছিল বাড়ির পাশের খোলা মাঠে। আমার ছোড়া অগ্নিতিরের ফলা অনেক দূরে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে বাড়ির একটি খড়ের ঘরের চালার ওপরে—মুহূর্তেই আগুন ধরে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে অনতিদূরের ধানের গোলার চালায় ও লাগোয়া কুটোর পালায়। ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারত সেই অগ্নিকাণ্ড, বাড়ির মোট ১৪ খানা কাঁচাঘর ভস্মীভূত হতে পারত সেই রাতে।
কাঠবিড়ালিদের অত্যাচারে এলাকার মানুষ অনেক সময় অতিষ্ঠ হয়ে যেত। ক্ষতি করত ভীষণ। মানুষ তাই ওদের মারার জন্য নানান রকম কায়দা করত, ফাঁদ পাতত, বাসা ভেঙে বাচ্চা মেরে ফেলত। তির–ধনুকধারী আমাদেরও ডাক পড়ত। একটি কাঠবিড়ালি মারতে পারলে (প্রমাণ দেখাতে হতো) দুই আনা থেকে দুই টাকা পর্যন্ত পাওয়া যেত। তা ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত-অতিষ্ঠ অনেক মানুষ বন্দুকের টোটা বা কার্তুজ কিনে আমার বাবা ও গ্রামের অন্য দু–চারজন বন্দুকধারীর বাড়িতে গিয়ে কাঠবিড়ালি মারার অনুরোধ করতেন। বাবা যেতেন ও গুলি করে মারতেনও। কিন্তু কাঠবিড়ালির মতো একটি নিরীহ, শান্ত ও মজার প্রাণীর অত্যাচারের খবরটা বুঝতে হলে, জানতে হবে তাদের খাদ্য তালিকাসহ অন্যান্য মজাদার কাণ্ডকারখানা। মূল খাদ্য তাদের নানা রকম ফল। গৃহস্থের বাড়ির আঙিনার পেয়ারা খেয়ে ও আধখাওয়া পেয়ারাটি রেখে চলে যায়। প্রতিদিন দুই বেলা তো আসেই। অনেক পেয়ারা আধখাওয়া অবস্থায় মাটিতে পড়ে নষ্ট হয়। এ কথা খাটে অন্যান্য ফল ও শাকসবজির ক্ষেত্রেও। লাউ-কাঁকরোল-বরবটি ইত্যাদি গাছের ছাল খায়। দারুচিনিগাছের মিষ্টি বাকল ও মিষ্টি কচি পাতা খায়। চিবাতে এরা তেমন পারে না। ধারালো দাঁত দিয়ে চেঁছে-ছুলে খায়। সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো—কাঁচা-পাকা সুপারির পুরু খোসা চেঁছে-ছুলে ফেলে দিয়ে ভেতরের সুপারির দানাও চেঁছে-ছুলে খেয়ে ফেলে। মারাত্মক ক্ষতিটা করে ওরা অপুষ্ট সুপারির ভেতরের ‘দুধরস’ পান করে। সুপারির খোসার ভেতরে প্রথমে তৈরি হয় একধরনের তরল, ক্রমে সেই তরল সুপারিতে পরিণত হয়, তারপর আশ্বিন থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত পাকে। পাকা সুপারির দাম অনেক। সেই মূল্যবান ফসল যদি শুরু থেকেই একটি কাঠবিড়ালি পরিবার রোজই নষ্ট করতে থাকে, তাহলে সেই মালিক এটাকে বরদাশত করত না—আজও (২০২১) করে না।
প্রসঙ্গত, এখানে একটি মজার ঘটনা বলি। ভালো পাকা সুপারি (একসঙ্গে ১৫ থেকে ২৫ কুড়ি, ২৬৪টি সুপারিতে হয় ১ কুড়ি) মাটির জালা বা মাইটে রেখে তাতে জল ভরে সেই ‘মাইট’ মাটির তলায় পুঁতে রেখে ‘মদা সুপারি’ করা হতো, আজও হয়। মাইটের মুখ ভালো করে বন্ধ করা হয়। দুই থেকে ছয় মাস, এমনকি এক বছর বাদেও ওই সুপারিসহ ‘মাইট’ ওপরে তুলে পানি ঝেড়ে ফেলে গেরস্তরা বিক্রি করতেন। ওই পচা বা মদা সুপারি পানখেকোদের কাছে খুবই প্রিয়। তবে ওই পচা পানির দুর্গন্ধ হয় অসহ্য। মদা সুপারিতে একটা অন্য রকম দুর্গন্ধ বা মাদকতা থাকে। তো, আমি তখন পড়ি ক্লাস এইটে। আমাদের পাড়ারই একটি বাড়ির মালিক হাটবারে মদা সুপারির মাইট তুলে পানি ঝেড়েছিলেন। ওই পানি পান করে মোট চারটি কাঠবিড়ালি বদ্ধমাতাল হয়ে গিয়েছিল। ওগুলো ছিল কম বয়সী তথা আনাড়ি। ওগুলোর সেই বদ্ধমাতাল হওয়ার মজাদার কাণ্ডকারখানা দেখেছিল বহু মানুষ, করেছিল দারুণ উপভোগ। বাড়ির বিড়াল ও কুকুরেরাও দেখেছিল, আক্রমণ করতে সাহস পায়নি অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে। যদি কোনো বিপদ ঘটে! এই পচা জল পেটপুরে পান করার পরে বুনো এক দাঁতালকেও (শূকর) বদ্ধমাতাল হতে আমরা অনেকেই দেখেছিলাম। তালগাছে ঝোলানো রসের হাঁড়ি দু–তিন দিনেও না নামানোয় (গাছি জরুরি প্রয়োজনে দূরের আত্মীয় বাড়িতে গিয়েছিল) রস পরে ‘তালের তাড়ি’ হয়ে গিয়েছিল। ওই তাড়ি পান করে গাছখাটাশদেরও বদ্ধমাতাল হতে আমরা দেখেছি। কাঠবিড়ালিরাও তাল-খেজুরের রস পান করে।
কাঠবিড়ালিরা দ্বিতীয় যে ক্ষতিটা করে, সেটা হলো নারকেলের। নারকেলের ফুল খায়। অকারণে কাটাকুটি করে। ফুল থেকে যখন ছোট নারকেলের জন্ম হয় (নারকেলের ‘মুছি’) সেই নারকেল চেঁছে-ছুলে খেয়ে ফেলে। পরবর্তী সময়ে কচি ডাবের মুখ কেটে গোলাকার ছিদ্র করে ডাবের জল পান করে—পোক্ত ডাবের ক্ষেত্রেও একই কাজ করে। অনেক কষ্টে ডাবের পরবর্তী ধাপেও (দুমড়ো বা ঝুনো নারকেল) একই কাজ করে। এসব ক্ষেত্রে ক্বচিৎ দুর্ঘটনার খবরও আমাদের জানা আছে। ডাবের বোঁটা বা মুখটা আলগা হয়ে যাওয়ায় উঁচু গাছ থেকে ডাবটা খসে পড়ে মাটিতে, মানুষের ঘাড়-মাথায় পড়ে মারাত্মক কাণ্ড ঘটে যায় ক্বচিৎ। তবে এ ধরনের ঘটনা (সুপারি-নারকেল) কখনো কখনো ঘটে। গাছে হয়তো কাঁঠাল পেকে আছে, পেকে গেছে বড় আকারের পেঁপে বা বাতাবি লেবু (বাতাবি লেবুর মুখ ফুটো করতে এরা মহা ওস্তাদ) অথবা বড় আকারের আতাফল, মুখের দিকে গর্ত করে খেতে খেতে (২-৩ দিনে) ফলের ভেতরে ঢুকে পড়ে—কেননা, ফলগুলোর ভেতরেও ‘ফাঁপা’ বা স্পেস অথবা খোল তৈরি হয়েছে। ফলের ভেতরে ঢুকে যখন খায়, তখন তো দেখা যায় না প্রাণীটিকে (ফলখেকো অনেক পাখির ক্ষেত্রেও এ রকমটি ঘটে), শুধু নড়তে দেখা যায় কাঁঠাল-বাতাবি লেবু অথবা পেঁপেটিকে। ভৌতিক কাণ্ড বলেই মনে হয়! কাঠের তৈরি বক্স ফাঁদে আটকা পড়ার পরে যদি ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় পায় কাঠবিড়ালিরা, তাহলে ধারালো দাঁতে খাঁচা ও ফাঁদের কাঠ কেটে বেরিয়ে যায়। ধাওয়া খেলে অথবা বিপদ এলে এরা দ্রুতবেগে নির্দিষ্ট রুট ধরে দ্রুতবেগে পালায়—প্রয়োজনে এক গাছের ডাল থেকে লাফ দিয়ে অন্য গাছের ডালে গিয়ে পড়তে পারে, দুলতে-ঝুলতে পারে অ্যাক্রোব্যাটদের মতো। এই লাফের দূরত্ব ৮ থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত হতে পারে।
শিকারি পাখি-গুইসাপ-বনবিড়ালের ধাওয়া খেলেও দ্রুতবেগে পালায়—নিজেদের রাজ্যের সব লুকানোর জায়গা বা ‘হাইডআউট’ তো মুখস্থ, লুকিয়ে পড়ে। উল্লিখিত শত্রুরা তাই সফল হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। গাছে বসে হয়তো সামনের দুহাতে একটা মজাদার ফল ধরে (সামনের দুখানা পা এরা হাতের মতো ব্যবহার করতে পারে) খাচ্ছে, হাত থেকে খসে পড়ল মাটিতে। মাটিতে নেমে আসবে গাছ বেয়ে। সাবধানে গাছতলা থেকে মুখে ধরে আবারও চড়বে গাছে। ফলটি বড় হলে গাছতলায় বসেই সাবধানে খেতে শুরু করবে। এ সময় যদি বাড়ির পোষা বিড়াল বা বাগানের বনবিড়াল, বেজি বা গুইসাপের নজরে পড়ে, তাহলে শিকারের চেষ্টা করে। তবে ভুল করে বা কাঠবিড়ালির অসাবধানতার কারণে (হয়তো পালাচ্ছে) শিকার প্রাণীটি যদি ধরে বা থাবা বসায় কাঠবিড়ালিটির লোমশ মোটা লেজটাতে, তাহলে লেজের লোমগুলো খসে রয়ে যায় শিকারির থাবা বা মুখে—পালায় কাঠবিড়ালি। এ যেন তক্ষক বা টিকটিকির লেজ খসিয়ে দিয়ে পলায়নের কৌশল! পালানোর একটি সাধারণ কৌশলও আছে কাঠবিড়ালিদের। কোনো গাছ—বিশেষ করে নারকেলগাছের কাণ্ডে হয়তো আছে কাঠবিড়ালি, একজন মানুষ দেখলেই ওটা কাণ্ডের অন্য পাশে চলে যাবে, মানুষটি অন্য পাশে গেলে ওটিও ঘুরে আবার এপাশে আসবে। লাল কাঠঠোকরা পাখিরাও একই কাজ করে।
কাঠবিড়ালিদের ছানা তোলার ভরা মৌসুম গ্রীষ্ম-হেমন্ত ও বসন্তকাল। বছরে তিনবার ছানা তোলে এরা। প্রতি প্রসবে ৩-৪টি (প্রায় ক্ষেত্রে ৩টি) ছানা হয়। ছানাদের শরীর এতই স্বচ্ছ তথা সাদাটে থাকে যে—মনে হয় কাচের শরীর। পুরো ভেতরটা যেন দেখা যায়। নেংটুপুটু ছানা দেখতে খুব সুন্দর। চোখ থাকে বন্ধ। চোখ খুলতে সময় লাগে ৪-৭ দিন। মা কাঠবিড়ালি এ সময় প্রায়ই ছানা বুকে বাসায় থাকে। পুরুষটি থাকে কড়া পাহারায়। বেশি দূরে যায় না বাসা ছেড়ে। দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ রকম যে বাসায় থাকা বউটিকে স্বামী খাবার জোগাড় করে এনে খাওয়ায়—তা প্রায় ৮-১০ দিন যাবৎ। মা কাঠবিড়ালি যে কখনো বেরোয় না ওই ৮-১০ দিনে, তা কিন্তু নয়। শরীরের আড়ষ্টভাব কাটাতে ও ধারেকাছে পাওয়া খাবার খেতে সে স্বল্প সময়ের জন্য বেরোয়। প্রয়োজনে ছানাদের ওরা স্থানান্তরও করে।
শরীরে যৌবনের ডাক এলে পুরুষটি ‘কটকট’ শব্দে ডাকে। এটি পূর্ব রাগের পালা। প্রেমক্রীড়াও আছে এদের। মিছেমিছি পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার খেলায় মাতে এ সময় আনন্দে। গাছের ডালে দৌড়াদৌড়ি-হুড়োহুড়িও করে। এ রকম আনন্দের দিনগুলোতেই দুটিতে মিলে জুতসই স্থানে বাসা তৈরি করে ফেলে। বাসা বানানোর আদর্শ জায়গাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সুপারি-নারকেল-খেজুর-তালগাছের (কমপক্ষে ১৫-৩০ ফুট উচ্চতার ভেতরে, ব্যতিক্রমও আছে) মাথার ঘন পাতার ভেতরে, কুটোর পালার মাথার দিকে, পরিত্যক্ত ঘরের চালার ফাঁকে (১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ফাঁকা হিন্দু গ্রামে সাতটি বাসা আমরা দেখেছিলাম, গ্রামটি ছিল আগুনপোড়া গ্রাম), ঘন বাঁশঝাড়ের কঞ্চির গোড়ায়, বট-অশ্বত্থ-শেওড়াগাছের ডালের ঘন পাতার ভেতরে—এমনকি উল্লিখিত গাছগুলোর কোটর-ফোঁকর-ফাটলে, উঁচু পেঁপেগাছের মাথার ভেতরেসহ আম-লিচু-গাবগাছের ঘন সরু ডালপাতার ভেতরে। বাসার উপকরণে থাকে বিভিন্ন গাছের পাতার ডাঁটি, সরু সরু পাটকাঠির টুকরা, পরিত্যক্ত পাটের আঁশ, শুকনো ঘাস, বাঁশের শুকনো পাতা, শুকনো নারকেল-সুপারি পাতার খণ্ড খণ্ড শলাকা (নারকেলের পাতার শলাকা দিয়েই তো ঝাড়ু তৈরি হয়), ধানের কুটো, টুকরা টুকরা ছেঁড়া কাপড়, সুতা, মেয়েদের মাথার লম্বা লম্বা চুল (চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানোর সময় যে চুল উঠে আসে, সেই চুল তো মেয়েরা দলা পাকিয়ে কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাসে থু থু ছিটিয়ে ফেলে দেয়), ছোট-সরু বাঁশের কঞ্চি, সাধ্যে কুলালে কাশফুলের ডগা, ফেটে যাওয়া শিমুলের তুলা, পাখির বা পোষা হাঁস-মুরগির পালক ও নারকেলের খোসার ছোবড়াসহ (এই ছোবড়া দিয়ে গদি ও দড়ি বানানো হয়) শুকনো সুপারির খোসা। বাসাটি হয় গোলগাল ধরনের অথবা ডিম্বাকার। শক্তপোক্ত তেমন নয়। তবে বাসার ভেতরের মূল চেম্বারটা দেখলে এদেরকে আর্কিটেক্ট বলেই মানতে হবে। প্রবেশ দরজা থাকে এক পাশে—খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। সুন্দর বাসাটি সুরক্ষিত বটে! তবে ক্বচিৎ শিকারি তথা হাইজ্যাকার হাঁড়িচাঁচা পাখি ও কানাকোকা পাখিরা এদের বাসা ছিঁড়েখুঁড়ে লন্ডভন্ড করে ছানা খেয়ে ফেলে। শিকারি বাজ-ইগলেরাও ক্বচিৎ নখরে গেঁথে পুরো বাসা নিয়েই উড়ে যায় আকাশে। এ রকম ক্ষেত্রে কাঠবিড়ালিরা শুধু চারপাশে অস্থির ছোটাছুটি করে, হাহাকার করে, ডাকাডাকি করে—ডাগর দুচোখে ফুটে ওঠে করুণ অসহায়ত্ব। কিছুই করতে পারে না শত্রুর বিরুদ্ধে।
প্রসঙ্গত, বলতে হয় লম্বালেজি গেছো ইঁদুরের (Long-tailed tree mouse) কথা। এটিও বৃক্ষবাসী, নিশাচর। এটির মূল শরীর ৭-৯ সেমি। শুধু লেজটি ১০-১২ সেমি। আর বাদামি কাঠবিড়ালির মূল শরীর ২১ সেমি, শুধু লেজটি ১৮ সেমি। স্বাস্থ্যও ভালো এটির, নাদুসনুদুস। অথচ দিবাচর কাঠবিড়ালি শত্রুর সামনে অসহায়, কিন্তু ওই ইঁদুরটি কাক-চিল-কানাকোকা-হাঁড়িচাঁচাকে থোড়াই কেয়ার করে। আক্রমণ করতে চায় বারবার। অসীম সাহসী লম্বালেজি ইঁদুরের মতো কাঠবিড়ালিরাও যদি আক্রমণ করতে পারত!
প্রজনন মৌসুমের আনন্দের ডাকসহ কাঠবিড়ালিরা মোট চার ধরনের ডাক ডাকতে জানে। এরা তো সার্বক্ষণিক জোড়ায় জোড়ায় চলে। ‘একসঙ্গে খাওয়া আর একসঙ্গে বিশ্রাম বা ঘুম’। কোনো কারণে একটি চোখের আড়াল হলে অন্যটি ডাকে ‘কটকট’ শব্দে। তবে প্রজনন মৌসুমের ‘কটকট’ আর সঙ্গীকে ডাকা-খোঁজার ‘কটকটে’র মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকে। হারিয়ে যাওয়া আনাড়ি ছানাদেরও ডাকে শব্দ করে। বিপৎসংকেতও দেয় শব্দ করে। কোনো কারণে প্রচণ্ড বিরক্ত হলেও এক জায়গায় বসে একটানা ডাকে জোরে জোরে। প্রতিটি ডাকের ভাষা বা অর্থ বোঝা যায়। গেছো ইঁদুররাও বাসা করে কাঠবিড়ালিদের মতোই—জায়গাও অভিন্ন। তবে খাদ্যতালিকাটা একটু ভিন্ন। লম্বা গেছো ইঁদুররা পাখির ডিম-ছানা খায়, রান্নাঘরের উচ্ছিষ্টও খায়। লম্বালেজির বাসার ত্রিসীমানা মাড়ায় না কাঠবিড়ালিরা।
চাক্ষুষ দু–একটা মজার কাণ্ডের কথা বলি এবার। ডাব-নারকেলের মুখ ফুটো করে যখন ডাবের পানি বা নারকেল খাওয়ার জন্য ঘাড়-মাথা সেঁধিয়ে দেয় ভেতরে, তখন যদি বোঁটা থেকে খসে নিচের মাটিতে পড়ে ডাব বা নারকেলটি, অথবা পাকা পেঁপে-আতা বা বাতাবিলেবুর ভেতরে ঘাড়-মাথা ঢোকানোর পরে খসে মাটিতে পড়ে—সে ক্ষেত্রে ডাবের বেলায় মৃত্যু অনিবার্য, পেঁপে বা বাতাবিলেবুর ক্ষেত্রে মৃত্যু না হলেও আহত হয়, ছেলেপুলে বা বিড়াল-কুকুরের কবলে পড়ে। একবার বেলগাছের পাকা একটি বেলে এক জোড়া কাঠবিড়ালি কী যেন খুঁজছিল—টুপ করে বেলটি সশব্দে মাটিতে পড়েই চৌচির হয়ে গেল, প্রাণী দুটি চিত্পটাং, নট নড়নচড়ন। অনেকেই এগোল। ‘বেল পাকলে কাকের কী’ হয়ে গেল ‘বেল পাকলে কাঠবিড়ালির কী’–জাতীয় চিন্তা যখন সবার মাথায়, তখন একটি দুষ্টু মেয়ে গুটিসুতা এনে দুটিরই লেজের গোড়ায় বেঁধে দিল। ওমা! কয়েক সেকেন্ড মাত্র! উঠেই ছুটল দুটি (বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল) দুদিকে—না! একটু টানাটানির পরেই ফটাস করে ছিঁড়ে গেল সুতা। দুটোই জীবনবাজি দৌড়ে সেই বেলগাছটিতেই চড়ে বসল।
কাঠবিড়ালি! হ্যাঁ, এটি বাদামি কাঠবিড়ালি। বাগেরহাটে পরিচিত এটি ‘চিয়ে’ নামে। আমার ছেলেবেলায়ও ‘চিয়ে’ ছিল, ২০২১ সালেও তা–ই আছে। সুন্দরবনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক বন ও গ্রামবাংলায় আজও টিকে আছে সুন্দর এই প্রাণীটি। একনজরে জলপাই বাদামি বা বাদামি রঙের প্রাণী। পেট-বুকে বাফরঙা আভা ছড়ানো। চঞ্চল, চতুর, নিরীহ ও ডাগর ডাগর চোখের এই কাঠবিড়ালিটির ইংরেজি নাম Irrawaddy Squirrel। বৈজ্ঞানিক নাম Callosciurus pygerythrus। আমার বাল্য-কৈশোরে আমাদের এলাকায় (বাগেরহাট) রঙিন কাঠবিড়ালি বা পাঁচডোরা কাঠবিড়ালি (Northern Palm Squirrel) ছিল না। যেকোনোভাবেই হোক কয়েক বছর ধরে ফকিরহাটে দেখা যাচ্ছে, বংশবৃদ্ধি করছে। ফল, চাল বা অন্য কোনো ট্রাকে চড়ে হয়তো ফকিরহাটে এসেছে (ইচ্ছে করে আসেনি), পরিবেশ আছে, আছে পর্যাপ্ত খাবার। থেকে যেতে পারে, তাই বাধা কোথায়!
লেখক: পাখিবিশারদ
*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মে সংখ্যায় প্রকাশিত