বিশ্বব্যাপী তিনটি শব্দ এখন বেশ আলোচিত হচ্ছে। এক, ডায়ার নেকড়ে, দুই, ক্লসোল বায়োটেক, আর তিন নম্বর হলো ডি-এক্সটিংকশন। শব্দ তিনটি দেখে পাঠক হয়তো বুঝে ফেলেছেন, পৃথিবীতে ফিরে এসেছে বিলুপ্ত হওয়া এক প্রজাতির নেকড়ে। ফিরিয়ে আনার কাজটি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লসোল বায়োসায়েন্সের বিজ্ঞানীরা।
ডায়ার নেকড়ে এক বিশেষ প্রজাতির নেকড়ে। প্রায় ১২ হাজার ৫০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফলে পৃথিবীতে এরা ফিরে এসেছে। এটিই ‘বিশ্বের প্রথম সফলভাবে ডি- এক্সটিংকশন বা বিলুপ্ত প্রাণীকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা প্রাণী’। ঘোষণাটি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের বায়োটেক কোম্পানি ক্লসোল বায়োসায়েন্সেস।
ক্লসোলের বিজ্ঞানীরা প্রাচীন ডিএনএ, ক্লোনিং এবং জিনোম সম্পাদনা প্রযুক্তি ব্যবহার করে তিনটি ডায়ার নেকড়ে ছানা তৈরি করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা পরিবর্তন করেছেন ধূসর নেকড়ের জিন। ধূসর নেকড়ে জিনগত দিক দিয়ে ডায়ার নেকড়ের সবচেয়ে কাছের জীবিত আত্মীয়। ফলে তৈরি হয়েছে এক ধরনের হাইব্রিড প্রজাতি, যা দেখতে অনেকটা বিলুপ্ত প্রাণীটির মতো।
তিনটি ডায়ার নেকড়ে এখন একটি গোপন ২ হাজার একর জায়গায় রাখা হয়েছে। যেটি ১০ ফুট উঁচু নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা। সেখানে নিরাপত্তাকর্মী, ড্রোন এবং লাইভ ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে।
ডায়ার নেকড়ের বৈজ্ঞানিক নাম এনোসিয়ন ডিরাস (Aenocyon dirus)। একসময় নেকড়ে প্রজাতিটি উত্তর আমেরিকায় বিচরণ করত। এটি ছিল কি-স্টোন স্পেসিস বা খাদ্যশৃঙ্খলের শীর্ষে থাকা শিকারি প্রাণী। এই প্রাণীকে ফিরিয়ে আনার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে এইচবিও টেলিভিশনের ‘গেম অব থ্রোনস’ সিরিজের পশমওয়ালা সাদা নেকড়ে।
ক্লসোল বলছে, ডায়ার নেকড়ে দেখতে ধূসর নেকড়ের চেয়ে বড়। এদের মাথাটা তুলনামূলক একটু চওড়া। ঘন ফুরফুরে পশম আর শক্তিশালী চোয়াল এদের। ক্লসোল ২০২১ সাল থেকে ম্যামথ, ডোডো ও তাসমানিয়ান টাইগার ফিরিয়ে আনার প্রকল্পে কাজ করছে। এতদিন এই প্রাণীগুলো আলোচনায় থাকলেও ডায়ার নেকড়ে নিয়ে তাঁদের কাজ এতদিন প্রকাশিত হয়নি।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও বেন ল্যাম বলেছেন, ‘এই সাফল্য প্রমাণ করে, আমাদের ডি-এক্সটিংকশন বা প্রাণীদের ফিরিয়ে আনার প্রযুক্তি কাজ করে। আমাদের টিম ১৩ হাজার বছর পুরোনো একটি দাঁত এবং ৭২ হাজার বছর পুরনো একটি খুলি থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে সুস্থ ডায়ার নেকড়ের ছানা তৈরি করেছে।’
ক্লসোল এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৩৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে। যদিও ম্যামথ ফিরিয়ে আনার কাজটি ধীরে চলছে। কোম্পানিটি মনে করে, ২০২৮ সালে প্রথম উলি ম্যামথের ছানা জন্ম দিতে পারবে।
এই তিনটি ডায়ার নেকড়ে এখন একটি গোপন ২ হাজার একর জায়গায় রাখা হয়েছে। যেটি ১০ ফুট উঁচু নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা। সেখানে নিরাপত্তাকর্মী, ড্রোন এবং লাইভ ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকান হিওউম্যান সোসাইটির স্বীকৃতি পেয়েছে এবং এটি ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারে নিবন্ধিত।
প্রাচীন ডিএনএ ও ডায়ার নেকড়ের জিনোম
ক্লসোলের বিজ্ঞানীরা দুইটি ডায়ার নেকড়ের জীবাশ্ম থেকে ডিএনএ নিয়ে এনোসিয়ন ডিরাসের দুটি উচ্চমানের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছেন। তাঁরা এই জিনোমকে তুলনা করে দেখেছেন ধূসর নেকড়ে, শিয়াল ও শিয়ালজাতীয় অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে। উদ্দেশ্য, ডায়ার নেকড়ের বৈশিষ্ট্যের মতো সাদা লোম, ঘন ও লম্বা লোম শনাক্ত করা।
এরপর এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ধূসর নেকড়ের কোষের ১৪টি জিনে ২০টি সম্পাদনা করা হয়। এরপর ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে উন্নত কোষ থেকে ভ্রূণ তৈরি করা হয় এবং সেগুলো স্থানান্তর করা হয় সারোগেট মায়ের দেহে। এই ভ্রূণের মাধ্যমে তিনটি সফল গর্ভধারণ সম্ভব হয়েছে। ভ্রুণগুলো পরিণত হয়ে জন্ম নেয় পৃথিবীর প্রথম সফলভাবে ডি-এক্সটিংকট প্রজাতিতে। গর্ভধারণের জন্য সারোগেট মা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বড় আকারের মিশ্র জাতের গৃহপালিত কুকুর।
ডায়ার নেকড়ের দুটি পুরুষ ছানা জন্ম নেয় ১ অক্টোবর ২০২৪ সালে। আর নারী ছানাটি জন্মে ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ সালে। এ ব্যাপারে ক্লসোলের উপদেষ্টা ও জেনেটিক বিশেষজ্ঞ লাভ ডালেন বলেন, ‘ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধূসর নেকড়ের জিন বাদ দিয়ে ডায়ার নেকড়ের বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা হয়েছে। যদিও জেনোমের ৯৯.৯ শতাংশ ধূসর নেকড়ের, তবুও এটি ডায়ার নেকড়ের মতো দেখতে এবং আচরণেও অনেকটা এর কাছাকাছি। জেনেটিকভাবে এটি হয়তো পুরোপুরি ডায়ার নেকড়ে নয়, কিন্তু এটি ডায়ার নেকড়ের বৈশিষ্ট্য বহন করে। গত ১৩ হাজার বছরে আমরা এমন কিছু আর দেখিনি। আমার মতে, এটি আসলে ডায়ার নেকড়েই।’
ক্লসোলের বিজ্ঞানীরা দুইটি ডায়ার নেকড়ের জীবাশ্ম থেকে ডিএনএ নিয়ে এনোসিয়ন ডিরাসের দুটি উচ্চমানের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছেন। তাঁরা এই জিনোমকে তুলনা করে দেখেছেন ধূসর নেকড়ে, শিয়াল ও শিয়ালজাতীয় অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে।
ক্লসোল এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৩৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে। যদিও ম্যামথ ফিরিয়ে আনার কাজটি ধীরে চলছে। কোম্পানিটি মনে করে, ২০২৮ সালে প্রথম উলি ম্যামথের ছানা জন্ম দিতে পারবে।
অনেকেই মনে করেন, এত বিপুল অর্থ অন্য সংরক্ষণ প্রকল্পে ব্যয় করা উচিত। এছাড়া সারোগেট প্রাণীর স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশদর্শনের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার প্রেস্টন বলেছেন, ‘ক্লসোল প্রাণীর কল্যাণ নিয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করছে। যেমন বিশাল জায়গা, নিরাপত্তা এবং আমেরিকান হিওউম্যান সোসাইটির স্বীকৃতি।’
তবে তিনি মনে করেন, ‘বাস্তব পরিবেশে ডায়ার নেকড়েকে ছেড়ে দেওয়া ও এদেরকে প্রকৃতির অংশ করে তোলা কঠিন হতে পারে। মনটানায় আমরা এখনও ধূসর নেকড়ে রক্ষা করতেই রাজনৈতিক বাধার মুখে পড়ছি। সেখানে ডায়ার নেকড়েকে মুক্ত করে প্রাকৃতিতে যুক্ত করা কঠিন ব্যাপার’। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে—এই নতুন প্রাণীদের দিয়ে আমরা ঠিক কী করব?