দেহঘড়ি : সার্কাডিয়ান চক্র

ঘড়ির কথা বললে আমাদের মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে হাত ঘড়ি, টেবিল ঘড়ি বা দেয়াল ঘড়ির ছবি। এ সব ঘড়ি ছাড়াও আমাদের চোখের আড়ালে আর এক ধরনের ঘড়ি আছে, যার নাম দেহঘড়ি। আমরা বাইরের জগতের সঙ্গে তাল রেখে চলি যান্ত্রিক ঘড়ি দিয়ে, আর আমাদের দেহ বাইরের জগতের সঙ্গে তাল রেখে চলে দেহঘড়ি দিয়ে। এটাকে জৈবিক চক্রও বলা যেতে পারে। ব্যাপারটা বোঝা গেল না, তাই তো? বুঝিয়ে বলছি।

ধরা যাক এখন রাত, বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাদের দেহ তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারে, এখন ঘুমানোর সময়। আবার বাইরে সূর্যের তীব্র আলো। দেহ বুঝতে পারে, এখন ঘুম থেকে উঠতে হবে, এটা কাজ করার সময়। ঘুম একটা জৈবিক ঘটনা। শুধু ঘুমই নয়, আমাদের শরীরের অনেক দেহকলা আছে, যেগুলো দেহঘড়ির আইন মেনে চলে। আবার আমাদের শরীরে যে বিপাক ক্রিয়া ঘটে, সেটাও সময় অনুসরণ করে। এখন খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন মনে উদয় হতে পারে—আমরা তো যান্ত্রিক ঘড়ি চালাই ব্যাটারি দিয়ে; দেহঘড়ি চলে কী করে বা কী দিয়ে? আমরা এখানে হরমোনের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হব। যে হরমোনটি আমাদের জৈবিক চক্রের সঙ্গে জড়িত, তার নাম মেলাটোনিন।

আলোতে মেলাটোনিনের নিঃসরণ কমে যায়, আঁধারে বেড়ে যায়। পিনিয়াল গ্রন্থি আলো-আঁধারের এই অনুভূতি টের পায় কীভাবে? আমাদের মস্তিষ্কে দেখার অনুভূতিটা যায় যেখান থেকে, সেখান থেকেই মূলত পিনিয়াল গ্রন্থি আলো-আঁধারের বিষয়টা জেনে নেয়।

মেলাটোনিন নামক হরমোনটির নিঃসরণ ঘটায় মস্তিষ্কের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পিনিয়াল গ্রন্থি। মেলাটোনিনের নিঃসরণ আবার নির্ভর করে আলো থাকা বা না থাকার ওপরে। আলোতে মেলাটোনিনের নিঃসরণ কমে যায়, আঁধারে বেড়ে যায়। পিনিয়াল গ্রন্থি আলো-আঁধারের এই অনুভূতি টের পায় কীভাবে? আমাদের মস্তিষ্কে দেখার অনুভূতিটা যায় যেখান থেকে, সেখান থেকেই মূলত পিনিয়াল গ্রন্থি আলো-আঁধারের বিষয়টা জেনে নেয়। মস্তিষ্কে দেখার অনুভূতি বা কোনো কিছুর ছবি ভেসে ওঠার জন্য প্রথম কাজ করে যে অঙ্গ, তার নাম চোখ। চক্ষুগোলকের একেবারে ভেতরের আবরণকে বলা হয় রেটিনা। রেটিনায় অবস্থিত আলোগ্রাহক কিছু স্নায়ু প্রান্তের মাধ্যমে আলো গৃহীত হয় এবং মস্তিষ্কের পেছনের অংশে অবস্থিত দৃষ্টিকেন্দ্রে গিয়ে দেখার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এই রেটিনাতেই আবার কিছু স্নায়ুকোষ আছে, যেগুলো দেখার অনুভূতি না জাগিয়ে সোজা হাইপোথ্যালামাসের সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াসে চলে যায়। সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াস হচ্ছে জৈবিক চক্রের সবচেয়ে আদর্শ স্থান। এটাই মূলত সমস্ত শরীরের সার্কাডিয়ান রিদমের কেন্দ্রস্থল। সার্কাডিয়ান রিদম আবার কী? এখানে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি, সেটারই পুঁথিগত নাম সার্কাডিয়ান রিদম বা সার্কাডিয়ান চক্র। সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াস থেকে আলো-আঁধারের সংকেত বা সংবাদ চলে যায় পিনিয়াল গ্রন্থিতে। আঁধারের সংবাদ এলে গ্রন্থিতে মেলাটোনিন নিঃসরণের পরিমাণ দশগুণ বেড়ে যায়, হরমোনটি ঘুমাতে সাহায্য করে। তীব্র আলোতে ঘুমাতে পারে না, এমন মানুষ আমাদের আশপাশেই অনেক আছে।

দেহ যেভাবে আলো-আঁধার বোঝে

আলোতে মেলাটোনিনের নিঃসরণ কমে যায়। ফলে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। উত্তর মেরুর দিকে যে সব অঞ্চলে টানা কয়েকমাস দিন, আবার টানা কয়েকমাস রাত বা আলোর স্বল্পতা থাকে, সে সব অঞ্চলে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের জন্য পরিবেশের সঙ্গে দেহঘড়ির সামঞ্জস্য রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। সেখানে ঘরে গাঢ় রঙের পর্দা টেনে ঘুমাতে হয়। আবার উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে রাতে ও দিনে পালাক্রমে কাজ করানোর ব্যবস্থা করা হয়। এতে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে, কাজে মনোযোগ নষ্ট হয়। বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ ১৯৮৬ সালে ইউক্রেনের চেরনোবিলে নিউক্লিয় দুর্ঘটনার জন্য শ্রমিকদের দেহঘড়ির অস্থিতিশীলতাকে দায়ী করেন। এই দুর্ঘটনাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা। তাছাড়া সপ্তাহের বিভিন্ন দিন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কাজ করা শ্রমিকরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতেও থাকে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে আলসার, নিদ্রাহীনতা, খিটখিটে মেজাজ, হতাশা, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। সার্কাডিয়ান রিদমের একটি চক্র সাধারনত ২৫ ঘন্টায় সম্পন্ন হয়। আমরা দিন হিসাব করি ২৪ ঘন্টায়। এই সময়ের মাঝে মেলাটোনিনের নিঃসরণও আলো-আঁধারের সাথে সঙ্গে বাড়ে-কমে। মেলাটোনিনের এই চক্রাকার পরিবর্তন দেহের অন্যান্য দেহকলার নিজস্ব সময়জ্ঞানেও প্রভাব ফেলে। দেহকলার নিজস্ব সময়জ্ঞান বলতে এখানে দেহের বিভিন্ন অঙ্গের নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করার স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে বোঝানো হচ্ছে।

আঁধারের সংবাদ এলে গ্রন্থিতে মেলাটোনিন নিঃসরণের পরিমাণ দশগুণ বেড়ে যায়, হরমোনটি ঘুমাতে সাহায্য করে।

মেলাটোনিন যে শুধু সার্কাডিয়ান রিদমের ক্ষেত্রেই কাজ করে, তা নয়; এর আরও বেশ কিছু কাজ আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মেলাটোনিন বয়ঃসন্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়। মেলাটোনিন প্রয়োগ করে বালক-বালিকার বয়ঃসন্ধিকে বিলম্বিত করা যায়। চিকিত্সাশাস্ত্রে মেলাটোনিনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার দেখা যায় নিদ্রাহীনতার সমস্যায়। প্রকৃতিগত স্বাভাবিক ঘুমের জন্য মেলাটোনিনের জুড়ি মেলা ভার। অনেক প্রাণীর ঋতুনির্ভর আচরণগুলো নির্ধারিত হয় মেলাটোনিন নিঃসরণের ওপর ভিত্তি করে। প্রজনন, অভিপ্রয়াণ ও শীতনিদ্রার মতো ঘটনাগুলো মেলাটোনিন নিঃসরণ দিয়ে নির্ধারিত হয়। মেলাটোনিন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করে। বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে মুক্ত থাকতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এছাড়া জ্ঞান অর্জন, স্মৃতিশক্তি ও বোধশক্তি বাড়াতেও মেলাটোনিন সহায়ক ভূমিকা পালন করে বলে জানা গেছে।