জলবায়ু পরিবর্তন ও ভবিষ্যতের মহামারি

বর্তমান করোনা মহামারিতে থমকে গেছে পৃথিবী। ইতিমধ্যে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অনেকেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন, অনেকে শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত ও ফুসফুসের নানা সমস্যায় ভুগছেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যেভাবে বিপর্যস্ত করেছে জনজীবনকে, তা দেখে অনেক অসহায়বোধ বেড়েছে মানুষের মনে। যদিও একাধিক ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম শেষ হয়েছে এবং বেশ কিছু ভ্যাকসিন ট্রায়াল এখনো চালু রয়েছে, তা সত্ত্বেও স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে না। এ মহামারি চলে যাওয়ার পরও এর প্রভাব দীর্ঘদিন ভোগাবে মানবসভ্যতাকে। প্রশ্ন হলো, এটাই কি শেষ? নাকি অদূর ভবিষ্যতে আরও কোনো বড় বিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?

জলবায়ু পরিবর্তন একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সমস্যা। মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডের কারণে পরিবেশ ও জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে প্রাণী ও উদ্ভিদের অভূতপূর্ব ক্ষতি হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এটিকে ‘মানবজাতির জন্য সতর্কবার্তা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন শুরু হয়েছে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং মেরু ও অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলের বরফ গলা শুরু হয়েছে। এতে যে শুধু সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী মানুষের ক্ষতি হবে তা নয়, পুরো মানবজাতির জন্যই তা মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে নতুন নতুন মহামারির আবির্ভাব হতে পারে, এ বিষয়কে মানুষ এ পর্যন্ত তেমন গুরুত্ব দেয়নি।

এ বিষয়ে যে ঘটনা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, সেটি হলো ২০১৬ সালে মেরু অঞ্চলে হঠাৎ অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাদুর্ভাব। ২০১৬ সালের আগস্টে রাশিয়ার সাইবেরিয়ান তুন্দ্রা অঞ্চলের প্রত্যন্ত ইয়ামাল উপদ্বীপে ১২ বছরের এক কিশোর অ্যানথ্রাক্সে মারা যায় এবং কমপক্ষে ২০ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। এর কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, ৭৫ বছর আগে এ এলাকায় একটি বল্গা হরিণ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং এর মৃতদেহ বরফে চাপা পড়ে। বরফে ঢাকা পড়া এসব ভূমিকে বলা হয় ‘পার্মাফ্রস্ট’।

২০১৬ সালের তীব্র দাবদাহে এই ভূগর্ভস্থ হিমায়িত অঞ্চল গলতে শুরু করে। ফলে বল্গা হরিণের মৃতদেহটি বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে আসে এবং আশপাশের মাটি, পানি ও খাদ্যশৃঙ্খলে অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ে। দুই হাজারের বেশি বল্গা হরিণ এবং বেশ কিছু মানুষও তখন অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু এটিই একমাত্র ঘটনা নয়।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আরও বেশি পার্মাফ্রস্টের বরফ গলতে শুরু করেছে। স্বাভাবিক অবস্থায় গ্রীষ্মকালে যেখানে প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার গভীরতার বরফ গলে, এখন উষ্ণায়নের কারণে এই হার কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। আর এর ফলেই প্রাদুর্ভাব হতে পারে নতুন রোগের, হতে পারে ভয়ংকর মহামারি।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূপদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও পার্মাফ্রস্ট বিশেষজ্ঞ ভ্লাদিমির রোমানোভস্কি বলেন, পার্মাফ্রস্টে জমে থাকা বরফ দ্রবীভূত হলে এর ভেতরে আবৃত থাকা ভূমি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই–অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস বাতাসে নির্গত করে; যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে আরও ত্বরান্বিত করে। কানাডার উত্তরে যেখানে তাপমাত্রা সচরাচর ১৪o ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানেও বরফ গলা শুরু হয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে যে স্থান বরফ দিয়ে আচ্ছাদিত ছিল, তা আর এখন আগের অবস্থায় ফিরছে না। রোমানোভস্কি আরও উল্লেখ করেন, পার্মাফ্রস্টের এই বরফ গলার ঘটনা পুরোনো নয়। ১৯৯০ সালের দিকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ত্বরান্বিত হচ্ছে। আগামী দশকে এই বরফ গলার হার সর্বোচ্চ মানে পৌঁছাতে পারে বলেও তিনি মনে করেন। আর এর ফলেই বরফের নিচে আটকে পড়া ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।

রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স, মস্কোর আবহাওয়া বিভাগের দুজন গবেষক বোরিস রেভিচ ও মারিনা পডলনায়ার ২০১১ সালের গবেষণাপত্র অনুসারে, পার্মাফ্রস্টের বরফ গলার কারণে আঠারো ও উনিশ শতকের অনেক প্রাণঘাতী রোগ আবার ফিরে আসতে পারে। বিশেষ করে এসব রোগের বিস্তার হতে পারে সেসব এলাকায়, যেখানে রোগে মৃত ব্যক্তিদের সমাহিত করা হয়েছিল। ১৮৯০ সালে সাইবেরিয়ায় গুটিবসন্ত মহামারি হয়েছিল। এই মহামারিতে সেখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ লোক মারা গিয়েছিল। তাদের মৃতদেহগুলো কলিমা নদীর তীরের পার্মাফ্রস্টের ওপরের স্তরে সমাহিত করা হয়েছিল। প্রায় ১২০ বছর পর পানিস্তর বৃদ্ধির ফলে কলিমার পানি–তীরবর্তী পার্মাফ্রস্টগুলোকে প্লাবিত করেছে এবং গুটিবসন্তের জীবাণু আশপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।

১৯৯০ সালে একটি প্রকল্পের অধীন স্টেট রিসার্চ সেন্টার অব ভাইরোলজি অ্যান্ড বায়োটেকনোলজির গবেষকেরা দক্ষিণ সাইবেরিয়ার গর্বি অল্টাই এলাকায় প্রস্তরযুগের কিছু মানুষের দেহাবশেষ পরীক্ষা করেন। এ ছাড়া তাঁরা উনিশ শতকে ভাইরাসজনিত মহামারিতে মারা যাওয়া রাশিয়ান পার্মাফ্রস্টে পাওয়া কিছু দেহাবশেষের নমুনাও পরীক্ষা করেন। দেখা যায়, দুই ধরনের নমুনাতেই গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ রয়েছে। যদিও তাঁরা কোনো জীবাণু পাননি, কিন্তু তাঁরা গুটিবসন্ত ভাইরাসের ডিএনএর খণ্ডাংশ পেয়েছিলেন।

ফ্রান্সের এক্সোমার্শেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট জিন মাইকেল ক্ল্যাভেরি ও তাঁর স্ত্রী চান্তাল আবের্গেল ২০১৪ সালে উত্তর–পূর্ব সাইবেরিয়ার কলিমা নদীর তীরবর্তী পার্মাফ্রস্ট থেকে সংগৃহীত নমুনা থেকে ৩০ হাজার বছরের পুরোনো দুটি ভাইরাসকে সক্রিয় করতে সক্ষম হন। ভাইরাস দুটি হলো, পিথোভাইরাস সাইবেরিকাম (Pithovirus sibericum) ও মলিভাইরাস সাইবেরিকাম (Mollivirus sibericum)। উভয়েই ‘জায়ান্ট ভাইরাস’। কারণ, সাধারণত ভাইরাস অতি আণুবীক্ষণিক হলেও এরা আণুবীক্ষণিক। তুন্দ্রা তীরবর্তী অঞ্চলের ১০০ ফুট গভীরে তাদের পাওয়া গেছে। এই ভাইরাসগুলো একবার সক্রিয় হয়ে গেলে দ্রুত সংক্রমণক্ষম হয়ে ওঠে। যদিও উল্লিখিত ভাইরাস দুটি শুধু অ্যামিবাকে আক্রমণ করে। আবার এমন কিছু ভাইরাসও পাওয়া গেছে যারা সক্রিয় হয়ে মানুষকে সংক্রমণ করতে পারে।

আবের্গেলের মতে, ডিএনএ ভাইরাসগুলোই সবচেয়ে উৎকণ্ঠার বিষয়। আরএনএ ভাইরাসের জেনেটিক উপাদান আরএনএ হওয়ায় সেগুলো অস্থায়ী ও দীর্ঘ সময় নিষ্ক্রিয় থাকার পর আর কাজ করতে পারে না। সে তুলনায় ডিএনএ ভাইরাসগুলো রাসায়নিকভাবে অনেক বেশি স্থায়ী হয়। তাই উত্তর আলাস্কার একটি বরফে ঢাকা সমাধিস্থলে ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাসের আরএনএ পাওয়া গেলেও তা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কম বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ডিএনএ ভাইরাসজনিত রোগ, যেমন গুটিবসন্ত নতুন করে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলেও ভ্যাকসিনেশনের কারণে তা প্রভাব ফেলতে পারবে না। তাই ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগগুলোই হয়তো এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক হতে পারে এবং মহামারি আকার ধারণ করতে পারে।

২০১৫ সালে নাসার গবেষকেরা ৩২ হাজার বছরের পুরোনো ব্যাকটেরিয়াকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম হন। এগুলো আলাস্কায় একটি বরফে ঢাকা পুকুরে পাওয়া গিয়েছিল। এ ব্যাকটেরিয়া হলো কারনোব্যাকটেরিয়াম প্লাইস্টোসিনিয়াম (Carnobacterium pleistocenium)। এগুলো প্লাইস্টোসিন–যুগ থেকে সেখানে ছিল। যখন এই স্থানের বরফ গলে যায়, তখন এরা সক্রিয় হয় এবং পানিতে সাঁতার কাটতে শুরু করে। এর প্রায় দুই বছর পর ২০১৭ সালে অ্যান্টার্কটিকার বেকন মুলিন ভ্যালির একটি তুষারখণ্ডের নিচে গবেষকেরা ৮০ লাখ বছরের পুরোনো একটি ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পান। যদিও সব নিষ্ক্রিয় ব্যাকটেরিয়া পুনরায় সক্রিয় হতে পারে না, বেশ কিছু ব্যাকটেরিয়া যেমন ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস ও ক্লস্টিডিয়াম বটুলিনাম পুনরায় সক্রিয় হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

শুধু ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ার ফলে প্রোটোজোয়া পরজীবীরও সংক্রমণ বাড়তে পারে। ২০১৬ সালে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা শিকার করা একটা বেলুগা তিমি থেকে টক্সোপ্লাজমা গন্ডির সন্ধান পান। এটি টক্সোপ্লাজমোসিস নামের সংক্রমণ সৃষ্টি করে, যা গর্ভস্থ শিশু ও পূর্ণবয়স্ক মানুষের শারীরিক অনক্রম্যতাকে দুর্বল করে ফেলে। নিম্ন তাপমাত্রায় এই পরজীবী সাধারণত নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানেও এই পরজীবীর অস্তিত্ব ও সংক্রমণ সম্ভব হয়েছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে শুধু যে মেরু অঞ্চলের বরফাচ্ছাদিত এলাকা, পার্মাফ্রস্ট বা অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের বিস্তীর্ণ বরফ গলে এসব জীবাণু সংক্রমিত হবে, তা নয়। এ প্রক্রিয়ার আরও সুগভীর প্রভাব রয়েছে। ক্ল্যাভেরির মতে, পার্মাফ্রস্টের বরফ গলে যেসব ভাইরাস মুক্ত হবে, সেগুলো প্রথমে নদীতে আসবে। ভাইরাসগুলো অক্সিজেন ও আলোর সংস্পর্শে আসবে, যা তাদের জন্য ক্ষতিকর। ফলে এগুলো যদি উপযুক্ত বাহক না পায়, তাহলে বেশি সময় সক্রিয় থাকতে পারবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীবজগতে আমাদের অগোচরেই পরিযান ঘটছে। উত্তর দিকে শস্য বেশি। যেমন হরিণ ও খরগোশ সেদিকে অভিপ্রয়াণ করছে। এ ধরনের পরিযানের ফলে আগে যে এলাকায় কোনো জীবাণু ছিল না, সেখানেও সংক্রমণ হতে পারে এবং ক্রমে তা মহামারির রূপ নিতে পারে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের সমুদ্রতীরবর্তী জনগোষ্ঠীও ঝুঁকিতে রয়েছে। সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দক্ষিণ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। ফলে দক্ষিণ অঞ্চল থেকে উত্তর অঞ্চলের দিকে বিপুলসংখ্যক মানুষের অভিপ্রয়াণ ঘটতে পারে। সেখানে জনবসতির ঘনত্ব বেড়ে যাবে এবং জীবনযাত্রার নিম্নমানের কারণে হতে পারে মারাত্মক সংক্রামক রোগ, যা মহামারির আকার ধারণ করতে পারে।

মেরু অঞ্চলের বরফ গলার ফলে তাই এখন বৈশ্বিক সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করে, তা কমিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে ভবিষ্যতে হয়তো করোনার চেয়েও একাধিক ভয়াবহ মহামারির মুখোমুখি হতে পারে মানবসভ্যতা।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নেচার জার্নাল ও বিবিসি আর্থ