ঢাকা শহরের পাখি: লক্ষ্মীপ্যাঁচা

লক্ষ্মীপ্যাঁচা বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ও উপকারী পাখি। গ্রামের চেয়ে ঢাকা শহরের ইট-পাথরের কোণে বাস করাই এদের জন্য বেশি নিরাপদ। তাই দিব্যি রাজধানীর বসতবাড়ি এমনকি বাণিজ্যিক ভবনগুলোর চিলেকোঠাতেও এদের দেখা মেলে

নিশাচর এই পাখিরা ভোররাতে আস্তানায় ফেরে। বছরের পর বছর একই আস্তানায় ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিসহ বসবাস করে। সবাই ডিম পাড়ে, ছানা জন্ম দেয়। তাই বলে এরা দলবদ্ধভাবে চলে না বা শিকারে বেরোয় না। মূল খাদ্য এদের ধেনো ইঁদুর, গেছো ইঁদুর, ব্যাঙ, চামচিকা, পাখির ডিম-ছানা ইত্যাদি। শহুরে পাখিরা সুযোগ পেলেই পাতিকাকের ডিম-বাচ্চা খায়। কাকেরা রাতে বলতে গেলে চোখেই দেখে না। আর এই পাখি নিশাচর। সাপ-বেজির যেমন সম্পর্ক, পাতিকাকের সঙ্গে এদের সম্পর্কও তেমন। দিনে যদি বাগে পায় পাখিটাকে, তাহলে কাকবাহিনী মহা শোরগোলে ঘেরাও করে। এ রকম ঘেরাওয়ের দৃশ্য ও পাখিটির আত্মরক্ষার আশ্চর্য কৌশল মাঝেমধ্যে রাজধানী ঢাকা শহরের মতিঝিল-দিলকুশা থেকে শুরু করে পুরো শহরেই দেখা যায়।

রাজধানী ঢাকা শহরে লক্ষ্মীপ্যাঁচা যথেষ্ট পরিমাণে আছে। তবে নিশাচর বলে নজরে পড়েই না বলতে গেলে। দিনে দালানের ফোকরে, আকাশচুম্বী ভবনগুলোর এসি মেশিন ও বিলবোর্ড, সাইনবোর্ডের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে ঝিমোয়-ঘুমায়। বেরোয় রাতে। খোদ মতিঝিলের শাপলা চত্বরের শাপলা ফুলে বসা অবস্থায়ও দেখা যায় মাঝেমধ্যে। পুরান ঢাকার পুরোনো ভবনগুলোতে এদের আস্তানা বেশি।

রাজধানী ঢাকায় আবাসিক, পরিযায়ী মিলে পাখি দেখা যায় প্রায় দুই শ প্রজাতির। টুনটুনি, বুলবুলি, দোয়েল, ঘুঘু, ফটিকজল, শালিক, মৌটুসি, নীলটুনি, কাঠঠোকরা, বসন্তবৌরি, মাছরাঙা, হলদে বউ, হাঁড়িচাচাসহ আরও কিছু পাখি। বহু বছর আগেই এরা পুরোপুরি নাগরিক পাখি হয়ে গেছে। তিন প্রজাতির শালিক, টিয়া, কোটরে প্যাঁচা, দোয়েলসহ অন্যান্য কোটরবাসী পাখির জন্য ঢাকা এখন আদর্শ শহর। এই শহরে ওদের বাসা বদলানোর কোটর, ফোকর-ফাটলে জুতসই জায়গার অভাব নেই। এমনকি মহা বিপন্ন বড় টিয়া বা চন্দনা টিয়ারাও রাজধানীতে এসে স্থায়ী বসতি গেড়েছে ১৫ বছর ধরে। ডিম-ছানাও তুলছে নিয়মিত। ঢাকা শহরের রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও শিশু একাডেমী ঘিরে যে‌ পাখিবলয়, সেই বলয়ে চন্দনা টিয়ার ঝাঁক দেখা যায়। উল্টো চিত্র গ্রামবাংলায়। গ্রামে নিরাপত্তার অভাব, বাসা বাঁধার জায়গার অভাব। পোষার জন্য মানুষ এদের ছানা চুরি করে, চুরি করা ছানা চড়া দামে বিক্রিও করে। ঢাকা শহরের এমন কোনো ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা, পাড়া, গলি, উদ্যান, পার্ক নেই, যেখানে আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল নেই। এই শহরে পাতিঘুঘু, বুলবুলিরা পরম নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। এয়ারগান ও পয়েন্ট টু টু বোরের রাইফেল শিকারিরা রাজধানীতে নেই।

ফিরে আসি লক্ষ্মীপ্যাঁচার গল্পে। এদের কিন্তু বিখ্যাত একটা নাম আছে। রূপকথার গল্পের সেই ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি নামটিও পরম্পরায় গ্রামবাংলার কোথাও কোথাও প্রচলিত আজও। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এরা লক্ষ্মীদেবীর বাহন হিসেবে স্বীকৃত। সারা দেশেই এর দেখা মেলে। লক্ষ্মীপ্যাঁচার ইংরেজি নাম Common Barn Owl। বৈজ্ঞানিক নাম tyto alba। দৈর্ঘ্য ৩৬ সেমি। ওজন ৫২০ গ্রাম। সোনালি বর্ডার ঘেরা সাদা মুখমণ্ডলখানা। পিঠের রং বাফ-সোনালি। তার ওপরে সাদা ও কালো কালো শিল্পিত ছিটা। বুক-পেট সাদাটে। তার ওপরে আবার কালো কালো ছিটা। পা ও ঠোঁট সাদা। মুখমণ্ডলের আকৃতি অনেকটাই অশ্বত্থ পাতা, মানুষের হৃদয়াকৃতির সঙ্গে মেলে। ব্যাঙ্গমি ডিম পাড়ে প্রতি কিস্তিতে ৬-৮টি। ডিম ফুটে ছানা হয় ৩০-৩২ দিনে। ছানাগুলো হয় উলেন সাদা রঙের। ছানারা ভালোভাবে উড়তে পারে ৩৫-৪০ দিনে।

লেখক: পাখিবিদ ও সাহিত্যিক

ছবি: আ ন ম আমিনুর রহমান