পরজীবীর দল ভালো না খারাপ? হয়তো ভাবছেন, এ আবার কোনো প্রশ্ন হলো নাকি? পরজীবী মানে, পরের ওপর নির্ভরশীল যার জীবন যাপন। ও জিনিস নিশ্চয়ই কোনোভাবে ভালো হতে পারে না। এর উদাহরণও ভুরি ভুরি। মাথায় উকুন বা ছারপোকা—নাম শুনেই হয়তো কুঁচকে গেছে আপনার মুখ। সাক্ষাৎ দুঃস্বপ্ন যাকে বলে!
কোনো কোনো পরজীবী আরও এককাঠি সরেস। এগুলো হোস্ট বা পোষক দেহের বিকৃতি ঘটাতে পারে, এমনকি মেরেও ফেলতে পারে কখনো কখনো। ভয়ংকর ব্যাপার বটে। অথচ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পরজীবীরও রয়েছে উপকারিতা। বিষয়টি নিয়ে লাইভ সায়েন্স-এ বিস্তারিত লিখেছেন একজন বাস্তুসংস্থানবিদ। যুক্তরাষ্ট্রের ডিকিন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব লাইফ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস স্কুলের ওয়াইল্ডলাইফ ইকোলোজি অ্যান্ড কনজার্ভেশন বিভাগের অধ্যাপক ইউয়ান রিচি। তাঁর লেখায় বিস্তারিত উঠে এসেছে পরীজীর ক্ষতিকর ও উপকারী দিকগুলো।
কিছু পরজীবী আবার পোষককে মেরেও ফেলে। এরকম একটি উদাহরণ হলো মাকড়শার বাচ্চা। মায়ের বুকের ভেতরের ডিম ফেটে যখন বাচ্চা বের হয়, তখন লার্ভাগুলো মা মাকড়শাকে অকেজো করে ফেলে।
২
পরজীবীর সংজ্ঞায় তিনি লিখেছেন, যে জীব অন্য কোনো জীবিত প্রাণের ওপর খাদ্য, বেড়ে ওঠা বা প্রজননের জন্য নির্ভরশীল, তাই পরজীবী। এগুলো পোষকদেহের বাইরেও বাস করতে পারে, ভেতরেও বাস করতে পারে। বহিঃপরজীবীগুলোকে ইংরেজিতে বলা হয় এক্টোপ্যারাসাইট। আর ভেতরে বসবাসকারী পরজীবীগুলোকে বলা হয় এন্ডোপ্যারাসাইট। এরা মোটেও আমন্ত্রিত অতিথি নয়। ইচ্ছেমতো নিজের প্রয়োজনে তারা পোষকদেহ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে—বলা ভালো, ছিনতাই করে।
পোষকের দেহে অল্প সময় যেমন থাকতে পারে এগুলো, তেমনি থাকতে পারে দীর্ঘকাল। সময়টা কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে। এ সময় এরা লুকিয়েও থাকে অনেক সময়। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলা যেতে পারে। একলোক মস্তিষ্কে টেপওয়ার্ম (বাংলা ‘ফিতাকৃমি’) নিয়ে জীবনযাপন করেছেন প্রায় চার বছর। যখন মাথাব্যথা ও উদ্ভট গন্ধ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন তিনি ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। এমআরআই এবং বায়োপসি করে চিকিৎসকেরা হতভম্ব চোখে দেখলেন, ওটা একটা টেপওয়ার্ম। তাঁকে এ জন্য ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু ভদ্রলোকের সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়নি। অবিশ্বাস্য এ ঘটনা উঠে এসেছে দ্য গার্ডিয়ান-এর এক রিপোর্টে।
আগেই বলেছি, কিছু পরজীবী আবার পোষককে মেরেও ফেলে। এরকম একটি উদাহরণ হলো মাকড়শার বাচ্চা। মায়ের বুকের ভেতরের ডিম ফেটে যখন বাচ্চা বের হয়, তখন লার্ভাগুলো মা মাকড়শাকে অকেজো করে ফেলে। অন্য কোনো পোকামাকড় বা কিছু বাধা না দিলে তারা মা মাকড়শাটিকে খেয়ে বেড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। নির্মম এ প্রকৃতির বিধান!
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, মোট প্রাণিপ্রজাতির প্রায় ৪০ শতাংশ হলো পরজীবী। প্রায় ২০০ বার এরা অভিযোজিত হয়েছে কালের আবর্তে। শুধু প্রাণীই নয়, উদ্ভিদ, ফাঙ্গাস, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসসহ বিভিন্ন কিছুর দেহে বাস করে নানা ধরনের পরজীবী।
৩
জোঁক চেনেন নিশ্চয়ই। এরা পোষকের রক্ত শুষে খায় সুযোগ পেলে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই জোঁকের লালায় রয়েছে অ্যানেস্থেটিক (চেতনানাশক) ও অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট (রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে, এমন) রাসায়নিক। এই দুটোতে ভর করেই পোষকের যে জায়গায় আক্রমণ করে, সেখানটা অবশ করে ফেলে জোঁক। তাই চোখে না দেখলে সহসা বিষয়টা টের পাওয়া যায় না। এই সুযোগে তারা শুষে নেয় রক্ত। যেকোনো সার্জারিতে এ ধরনের রাসায়নিক কাজে লাগে। তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানে জোঁকের লালা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তার ওপর এরা যেসব প্রাণীর রক্ত শুষে নেয়, তাদের ডিএনএ রয়ে যায় জোঁকের দেহে। বিজ্ঞানীরা জোঁকের রক্ত বিশ্লেষণ করে এসব ডিএনএ থেকে পেয়েছেন বহু দুর্লভ প্রাণের সন্ধান।
পৃথিবীর অন্যতম বহুল বিস্তৃত পরজীবীর বৈজ্ঞানিক নাম টোক্সোপ্লাজমা গন্ডি (Toxoplasma gondii)। প্রতি তিনজন মানুষের একজনকে আক্রমণ করে এটি। তবে এর মূল পোষক বিড়াল। বিশেষ করে ঘরে যেসব বিড়াল পোষা হয়, সেগুলো এ পরজীবীতে আক্রান্ত হয়। তাদের মলের মাধ্যমে এটি আরও ছড়িয়ে পড়ে।
এ পরজীবীতে আক্রান্ত মানবদেহে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। তবে সিরিয়াস অবস্থা হয়ে গেলে কোনো অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে, হবু মায়েদের গর্ভধারণে সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়াও দেখা যায় অকারণে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা, মানসিক কিছু সমস্যাও দেখা যায় মাঝেমধ্যে। এমনকি এ পরজীবী আক্রান্তদের তুলনামূলক বেশি গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়তেও দেখা গেছে।
অথচ এদেরও রয়েছে উপকারিতা। টোক্সোপ্লাজমায় আক্রান্তদের ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতার ফলে দেখা গেছে, তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা ও সম্ভাবনা বেশি। দেখা গেছে, যে দেশে এ পরজীবীতে আক্রান্ত মানুষ বেশি, তাদের নতুন ব্যবসা বা উদ্যোগে ব্যর্থ হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা কম। অনেক ক্ষেত্রে তাদের এ জন্য ব্যবসায় সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
এ ছাড়াও দেখা গেছে, যে বাস্তুতন্ত্রে পরজীবী বেশি, সেগুলো বেশি স্বাস্থ্যকর (Healthy)। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানকার বাস্তুতন্ত্রে বেশির ভাগ বড় শিকারী প্রাণীর চেয়ে পরজীবীর মোট ভর (Biomass) বেশি। বিশেষ করে সেখানে ট্রেমাটোডের মোট ভর পাখি, মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতি দেখে বেশি।
আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর অনেক প্রাণীই আমাদের বাস্তুতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো মনে হতে পারে, সব সাপ বা পরজীবীকে মেরে ফেললে দুনিয়া ভালো থাকবে। আসলে তা নয়।
এরকম আরও বহু উপকারিতা রয়েছে পরজীবীদের। তবে এরা যেহেতু প্রচুর ক্ষতি করে, এদের কারণে অ্যালার্জি হয়, কষ্টে ভোগে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী, তাই এদের ব্যাপারে বেশির ভাগ মানুষের চিন্তাধারাই একদম ইতিবাচক নয়। সে কারণেই ধীরে ধীরে এরা বিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে। ২০২০ সালে পরজীবী সংরক্ষণের জন্য একটি বৈশ্বিক পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। তবে তাতে এখন পর্যন্ত কতটা ইতিবাচক কাজ হয়েছে, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর অনেক প্রাণীই আমাদের বাস্তুতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো মনে হতে পারে, সব সাপ বা পরজীবীকে মেরে ফেললে দুনিয়া ভালো থাকবে। আসলে তা নয়। সে ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে যাবে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য। তখন আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীটা আর সুন্দর থাকবে না। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি।
