জাতীয় পাখি দোয়েল

দোয়েলছবি: আদনান আজাদ, তানভীর খান

সাতসকালে পাঁচটি দোয়েল পাখি হাঁকাহাঁকি-ডাকাডাকিতে বাগানটা সরগরম করে তুলেছে, ডাকছেও বিচিত্র সুরে, করছে ওড়াউড়ি-ঘোরাঘুরি। চলছে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। পাঁচটিই পুরুষ। একটিমাত্র মেয়ে দোয়েল কলার পাতার ওপর বসে গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকে ঘিরে স্বয়ম্বর সভার জমজমাট আয়োজনটা উপভোগ করছে মনপ্রাণভরে। কী তার দাম! শুধু তাকে পাওয়ার জন্য পাঁচ প্রেমিকের এমন লড়াই। অবশ্য সুযোগ পেলেই দু-একটি দোয়েল কালো-সাদা বুক-পেট ফুলিয়ে টেনিস বলের মতো করে ফেলছে। গান গাইছে সুমিষ্ট সুরে। নাচছে, মাথা-ঠোঁট একেবারে আকাশমুখো। টেনিস বল দুলিয়ে প্রেমিকাকে নিজের সৌন্দর্য ও গুণপনা দেখানোর সে কী হাস্যকর কসরত! কিন্তু একটি দোয়েল প্রেমিকাকে পটানোর জন্য সময় বেশি পাচ্ছে না, অন্য একটি তিরবেগে ধেয়ে আসছে। বসে যাচ্ছে প্রেমিকের সামনে। সে-ও বুক ফুলিয়ে ডানা দুলিয়ে বলতে চাইছে যেন, ‘দ্যাখো দ্যাখো ডার্লিং। তোমার জন্য আমার বুকে এত ভালোবাসা জমে গেছে যে বুকটাই না ফেটে যায় পটাশ করে!’ দোয়েল ৯০ ডিগ্রি কোণে তো বটেই, যেকোনো কোণে তিরবেগে ধেয়ে এসে শত্রুকে আঘাত করতে পারে। বুকভরা সাহস ওদের, চোখভরা রোষ। পাঁচটি দোয়েলই পরস্পরকে ধাওয়া করছে। দুর্বলগুলো হটে যাচ্ছে। স্বয়ম্বর সভাটা সমাপ্ত হয়ে গেল একসময়। প্রেমিকা যাকে পছন্দ করল, তাকে বসতে দিল পাশে, ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল, প্রেমিকের বুকের টেনিস বলে ঠোঁট ঠুকরে কী যে পরখ করল। তারপর দিল লম্বা উড়াল। অন্যরা হতাশ। তাদের খুঁজতে হবে নতুন প্রেমিকা।

যে জুটি এই একটু আগে উড়ে গেল, এদের প্রেম ম–ম দিন কাটবে দু–চার দিন। তারপর বাসা বাঁধার জায়গা খুঁজবে। গাছের খোঁড়ল, দালানকোঠার ফাঁকফোকর, ভেন্টিলেটরসহ কোটরের মতো জায়গায়। বাসার উপকরণ থাকে শুকনো ঘাস, লতাপাতা, পাটের আঁশ, গাছের শিকড় প্রভৃতি। ঢাকা শহরের বারান্দার গ্রিলে ঠিলা-কলস ঝুলিয়ে দিলে বাসা করে। এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা ৪০ বছরের। বাসা করার ভরা মৌসুম এদের বসন্ত-বর্ষাকাল। তবে ভরা শীতেও বাসা করতে পারে। বাসা শেষ হতে সময় লাগে তিন–চার দিন। তারপর মেয়েটি দুই–িতন দিনে ডিম পাড়ে ৩-৫টি। ডিম ফোটে ১২-১৫ দিনে। ছানারা উড়তে পারে ১৫-২০ দিনে। ঢাকা শহরের এমন কোনো পাড়া-মহল্লা-পার্ক-উদ্যান নেই, যেখানে দু-চারজোড়া দোয়েল নেই। এরা একটা এলাকা নিয়ে থাকে। যে এলাকায় থাকে, সে এলাকাটাকে বাবার তালুক বলে মনে করে। এরা কোটরবাসী অন্য পাখিকে হটিয়ে দিয়ে বাসা দখল করে নিতে ওস্তাদ। খুব ভোরে পুরুষ দোয়েল কোনো উঁচু জায়গায় বসে টানা আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা বিচিত্র মিষ্টি সুরে গান গায়! এদের গলায় সুরের যেমন ওঠানামা আছে, তেমনি আছে নানান রকম ছন্দ। সুবেহ সাদেকের সময় কান পাতলে রাজধানী শহরেও দোয়েলের গান শোনা যাবে। ঢাকাসহ দেশের সব শহর, বন্দর ও গ্রামে দোয়েল আছে। দোয়েল আমাদের জাতীয় পাখি। বাসার সীমানায় শত্রু যেমন কাক, চিলসহ অন্যান্য শিকারি পাখি, কুকুর-বিড়াল, বেজি এলেও পিলে চমকানো চিত্কার দিয়ে ডাইভ দেয় পুরুষ দোয়েল। এমনকি বিষধর সাপ হলেও মাটিতে নেমে পুরুষটি বেজায় চেঁচায় আর মাটিতে লেজ-পাখা ঝাপটায়। তখন পুরুষ দোয়েলের বুক, গলা, মাথা, পিঠ তেলচকচকে নীলচে-কালো, পেট শরতের সাদা মেঘের মতো সাদা। সাদা লেজের তলাও। ডানার প্রান্তজুড়ে চওড়া সাদা টান। ঠোঁট-পা কালো। পুরুষের তুলনায় মেয়েটি সুন্দরী নয়। মেয়েটির মাথা, ঘাড়, বুক, পিঠে স্লেট ও ধূসর রঙের মিশ্রণ। পুরুষ দোয়েল চেঁচায় কর্কশ স্বরে। কিন্তু গান যখন গায়, তখন সুরটা ‘সি-ই-সি, সিক সিক’ ধরনের হয়। কী রকম মেলোডিয়াস যে! সুর শুনে যেকোনো মানুষেরই ভালো লাগবে।

দোয়েলের মূল খাবার পোকামাকড়, রসাল ফল ইত্যাদি। ছানাদের এরা টিকটিকি-গিরগিটির বাচ্চা খাওয়ায়, নিজেরাও খায়। কেঁচো গেলে। তাল-খেজুরের রস পান করে। উড়ন্ত উইপোকা বা ওড়লা পোকা দোয়েলের খুবই প্রিয় খাবার। আবার দোয়েলও ধানখেত-ঝোপঝাড়ে গিয়ে ক্বচিৎ বেজি বা বনবিড়ালের কবলে পড়ে, সোনাব্যাঙও লাফ দিয়ে ধরে ফেলে। ছানারা যখন বাসা ছেড়ে বাইরে আসে, তখন ক্বচিৎ কাক-চিলের কবলে পড়ে।

গানের পাখি দোয়েলের ইংরেজি নাম Oriental Magpie Robin। বৈজ্ঞানিক নাম Copsychus saularis । দৈর্ঘ্য ২০ সেিন্টমিটার। ওজন ৪০ গ্রাম।