প্রথমবার ইংল্যান্ডের মাঠে ফলেছে সোনালি ধান

যুক্তরাজ্যে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে বড় পরিসরে ধান চাষ করেছেন নাদিন মিৎসচুনাসবিবিসি

একসময় যা ছিল রসিকতা, তাই এখন বাস্তব। যুক্তরাজ্যে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে বড় পরিসরে ধান চাষ সফল হয়েছে। ইংল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলের একটি গ্রামের কৃষক নাদিন মিৎসচুনাস এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। এটি যুক্তরাজ্যের কৃষির ইতিহাসে প্রথম বড় ধরনের প্রচেষ্টা।

গ্রীষ্মে রেকর্ড ভাঙা গরমের কারণে তাঁর ছোট ছোট ধানক্ষেতে দানাগুলো পেকেছে সুন্দরভাবে। নাদিন মিৎসচুনাস এই সাফল্যে ভীষণ গর্বিত। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে এখানে এমনটা হবে!’ তাঁর সহযোগী কৃষক সারা টেলরও এ সাফল্যে বিস্মিত। তাঁর জমিতেই এই ধান চাষ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দশ লাখ বছরেও এখানে এমনটা হয়নি।’

যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর ইকোলজি অ্যান্ড হাইড্রোলজির গবেষকেরা ঘোষণা করেছেন, তারা দেশে প্রথম পরীক্ষামূলক ধানের ফসল সফলভাবে কেটেছেন। তাদের পরীক্ষামূলক ক্ষেতগুলোতে ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ইতালি এবং ফিলিপাইন থেকে আনা নয়টি জাতের ধান চাষ করা হয়। এর মধ্যে রিসোটো, বাসমতি এবং সুশি চালের মতো জনপ্রিয় জাতও রয়েছে। ১৮৮৪ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া রেকর্ড রাখা হচ্ছে। সেই রেকর্ড অনুযায়ী এ বছর ছিল অন্যতম উষ্ণ গ্রীষ্মকাল। এ কারণেই এই ভালো ফলন ফলেছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

যুক্তরাজ্যের প্রথম ধানক্ষেতে এ বছর চাষ হয়েছে নয় রকমের ধান
বিবিসি

ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ জলবায়ু ধান চাষের জন্য খুবই ঠান্ডা বলে মনে করা হতো। এখানে দীর্ঘ সময় ধরে টানা রোদও থাকে না। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা বাড়ছে। এর সঙ্গে ‘ফেন্স’ অঞ্চলের উর্বর মাটি ও পর্যাপ্ত পানি ধান চাষের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেছে। কারণ ব্রিটেনের জলবায়ু দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

গবেষণা বলছে, যুক্তরাজ্যের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে এখানে বড় পরিসরে ধান চাষ সম্ভব হবে। ধান ছাড়াও এই গবেষক দলটি জলাবদ্ধ জমিতে জন্মানো লেটুস ও হাইব্রিড উইলো নিয়েও পরীক্ষা চালাচ্ছেন।

যুক্তরাজ্যের চালের বাজার এরই মধ্যে ১ বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি মূল্যের। অভ্যন্তরীণ সরবরাহ খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে এবং আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

যুক্তরাজ্যে ধান চাষের কথা শুনতে সহজ মনে হলেও প্রকল্পটি বেশ জটিল। তাই এখনই ব্রিটিশ চালের স্বাদ পাওয়া যাবে না। এর জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে আগামী দশকেই হয়তো যুক্তরাজ্যের চাল আমাদের খাবারের প্লেটে চলে আসবে।

এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য শুধু চাল উৎপাদন নয়। এটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাতেও যুক্তরাজ্যকে সাহায্য করতে পারে। পূর্ব ইংল্যান্ডের ‘ফেন্স’ অঞ্চলটি খুব উর্বর। ব্রিটেনের মোট সবজির এক-তৃতীয়াংশ এখানেই উৎপাদিত হয়। এর বার্ষিক বাজারমূল্য প্রায় ১.২ বিলিয়ন পাউন্ড।

এই ধান চাষ বড় একটি পরীক্ষার অংশ। ভবিষ্যতে ব্রিটেনে কীভাবে কৃষি বদলাতে পারে, তাই এখন দেখার বিষয়
বিবিসি

যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর ইকোলজি অ্যান্ড হাইড্রোলজির অধ্যাপক রিচার্ড পাইওয়েল অবশ্য সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্য এখনো ধান চাষের জন্য পুরোপুরি উপযোগী নয়। তাই বাণিজ্যিকভাবে চাষ করাটা কৃষকদের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।’ প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যে গম ও রেপসিডের ফলন অনেক কমেছে। এটি কৃষকদের ঝুঁকির বিষয়টিই প্রমাণ করে। অধ্যাপক পাইওয়েলের মতে, তাপমাত্রা আরও বাড়লে আগামী দশকে ধান চাষ লাভজনক হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের চালের বাজার এরই মধ্যে ১ বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি মূল্যের। অভ্যন্তরীণ সরবরাহ খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে এবং আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

ধানগুলো অক্টোবর মাসে কাটা হবে
বিবিসি

এই ধান চাষের পরিবেশগত সুবিধাও রয়েছে। এটি যুক্তরাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পিটভূমি বা জলাভূমিকে রক্ষা করতে পারে। গত এক শতাব্দীতে দেশটির প্রায় ৯০ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। প্রখ্যাত পাখি সংরক্ষণবিদ মেরি কলওয়েল জানান, ধানের খেত বিপন্ন কার্লিউ পাখির জন্য নতুন আবাসস্থল তৈরি করতে পারে। এই পাখি খাবারের সন্ধানে ও বিশ্রামের জন্য ধানের খেত ব্যবহার করে।

যুক্তরাজ্য প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৬ লাখ থেকে ৭ লাখ টন চাল আমদানি করে। দেশের ৯০ শতাংশ পরিবারই চাল কেনে। তাই দেশের অভ্যন্তরে চাল উৎপাদন হলে খাদ্য নিরাপত্তা বাড়বে এবং আমদানিনির্ভরতা কমবে।

লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর

সূত্র: বিবিসি