সাধারণত দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা মায়ের দুধ খেয়ে হজম করতে পারে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের দেহে একটা সমস্যা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে অনেকের দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খেয়ে হজম করার ক্ষমতা কমে যায়। একে বলে ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা বা ইনটলারেন্স। প্রশ্ন হলো, ল্যাকটোজ অসহিষ্ণু ব্যক্তিকে কি সব ধরনের দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে, নাকি কিছু খাবার নিরাপদে খেতে পারবেন?
বাংলাদেশে কত শতাংশ মানুষ ল্যাকটোজ অসহিষ্ণু, তার সঠিক হিসাব জানা যায় না। তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩ থেকে ৫ কোটি মানুষ ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতায় ভুগছেন। মানে তাঁদের শরীর দুধে থাকা ল্যাকটোজ নামের সুগারটি সঠিকভাবে ভাঙতে পারে না। ফলে তাঁরা গ্যাস, পেট ফাঁপা, বমিভাব, ডায়রিয়া এবং পেটব্যথার মতো সমস্যায় ভোগেন দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার খেলে। এই উপসর্গগুলো সাধারণত ল্যাকটোজযুক্ত খাবার খাওয়ার ৩০ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে দেখা দেয়।
আশার ব্যাপার হলো, প্রত্যেকের দুগ্ধজাত খাবারের সহ্যক্ষমতা ভিন্ন হতে পারে। কিছু কম ল্যাকটোজযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার, যেমন শক্ত চিজ বা দই ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতার উপসর্গ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
শুরুতেই বলেছি, ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা সাধারণত বড় হলে শুরু হয়। ক্ষুদ্রান্ত্র যখন যথেষ্ট ল্যাকটেজ তৈরি করতে পারে না, তখন ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা দেখা দেয়। ল্যাকটেজ নামে একধরনের এনজাইম আছে, যা ল্যাকটোজ ভাঙতে সাহায্য করে। সাধারণত, ল্যাকটেজ দুধের শর্করাকে দুটি সাধারণ শর্করা—গ্লুকোজ এবং গ্যালাকটোজে রূপান্তর করে। অন্ত্রের প্রাচীর দিয়ে এগুলো রক্তে শোষিত হয়।
ল্যাকটেজের ঘাটতি থাকলে খাবারের ল্যাকটোজ হজম ও শোষিত হওয়ার পরিবর্তে বৃহদান্ত্রে চলে যায়। সেখানে স্বাভাবিক ব্যাকটেরিয়া হজম না হওয়া ল্যাকটোজের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে, যা ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতার লক্ষণ ও উপসর্গ সৃষ্টি করে।
ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা তিন প্রকার। এর মধ্যে প্রাথমিক ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা সবচেয়ে সাধারণ। প্রাথমিক অসহিষ্ণুতা মূলত এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ঘটে, যারা জীবনের শুরুতে পর্যাপ্ত ল্যাকটেজ উৎপাদন করলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা হ্রাস পেতে থাকে।
শিশুরা যারা দুধ থেকেই পুষ্টি গ্রহণ করে, তাদের ল্যাকটেজের প্রয়োজনীয়তা থাকে। তবে যখন শিশুরা দুধ ছেড়ে অন্যান্য খাবারে অভ্যস্ত হয়, তখন ল্যাকটেজ উৎপাদন কমে যায়। প্রাথমিক ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা হলে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ল্যাকটেজের উৎপাদন এত কমে যায় যে দুধজাত পণ্য হজম করা কঠিন হয়ে পড়ে।
মাধ্যমিক ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা ঘটে যখন কোনো অসুস্থতা, আঘাত বা ক্ষুদ্রান্ত্রের অস্ত্রোপচারের পর ল্যাকটেজ উৎপাদন কমে। মাধ্যমিক ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতার সঙ্গে সম্পর্কিত রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্ত্রের সংক্রমণ, সিলিয়াক ডিজিজ, ব্যাকটেরিয়ার অত্যধিক বৃদ্ধি, ক্রনস ডিজিজ ইত্যাদি।
জন্মগত বা বিকাশজনিত ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতাও দেখা যায়। ল্যাকটেজের ঘাটতির কারণে জন্মগত ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা নিয়ে শিশু জন্ম নেওয়া সম্ভব, তবে এটি অত্যন্ত বিরল। এই রোগটি অটোসোমাল রিসেসিভ প্যাটার্নে বংশ পরম্পরায় হয়। মানে মা এবং বাবা—উভয় থেকে একই জিন ভ্যারিয়েন্ট সন্তানের মধ্যে যায়। প্রিম্যাচিউর শিশুরাও অপর্যাপ্ত ল্যাকটেজের মাত্রার কারণে ল্যাকটোজ অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে পারে।
কিছু মানুষ ল্যাকটোজ অসিহিষ্ণুতা টের পান না। তবে অন্যদের ক্ষেত্রে এই উপসর্গ এত গুরুতর হয় যে তারা কিছু দুধজাত খাবার খাওয়ার পর বমি করতে পারেন। তাই যারা ল্যাকটোজ অসহিষ্ণু, তাদের সমস্যার কারণ বুঝতে নিজে নিজে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। এ জন্য শুরুতে খাদ্যতালিকা থেকে সব ধরনের দুধজাত খাবার বাদ দিয়ে দেখতে হবে। এরপর অল্প কিছু দুধজাত খাবার আবার খেতে শুরু করতে হবে। তারপর দেখতে হবে, কেমন লাগছে। সব ধরনের ফুল ক্রিম দুধের প্রতি কাপে প্রায় ১২-১২.৫ গ্রাম ল্যাকটোজ থাকে। এটি ল্যাকটোজ অসহিষ্ণু ব্যক্তিদের জন্য দৈনিক সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রা। তাই দিনে এক গ্লাসের বেশি দুধ না খাওয়ার পরামর্শ দেন পুষ্টিবিদেরা।
চিজে সাধারণত দুধের তুলনায় কম ল্যাকটোজ থাকে। তবে সব ধরনের চিজ এক নয়। যেসব চিজ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা হয়নি, সেগুলোতে ল্যাকটোজের পরিমাণ বেশি। যেমন ক্রিম চিজে বেশি ল্যাকটোজ থাকতে পারে।
দুধ ও ক্রিম থেকে তৈরি বেশির ভাগ আইসক্রিমে উচ্চমাত্রায় ল্যাকটোজ থাকে। তবে কিছু আইসক্রিমের ল্যাকটোজের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। বিশেষ করে যেগুলোতে দুধের পরিমাণ বেশি থাকে।
ফলে যেসব খাবারে অল্প পরিমাণে ল্যাকটোজ থাকে, সেটি গ্রহণ করা যায়। হার্ড চিজ ও দইয়ে এমন ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা ল্যাকটোজ ভেঙে দেয়। এটি হজমে সাহায্য করে এবং উপসর্গ কমায়। বাটার বা মাখন তৈরি হয় দুধের চর্বি থেকে। এতে ল্যাকটোজের পরিমাণ থাকে খুব কম। এক টেবিল চামচ মাখনে ল্যাকটোজের পরিমাণ আধা গ্রামেরও কম। তাই দুধজাত খাবার হিসেবে এসব নিরাপদে গ্রহণ করা যায়।
এ ছাড়া বাদাম, সয়া বা ওট থেকে তৈরি দুধ এবং নারকেল থেকে তৈরি আইসক্রিমের মতো দুধহীন পণ্যও ল্যাকটোজমুক্ত। অনেকে নিজে বুঝতে পারেন যে তিনি ল্যাকটোজ অসহিষ্ণু। এটি সঠিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। কারণ, খাবারে অ্যালার্জি বা অন্য কোনো রোগ থেকেও একই ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।