জিএমও হচ্ছে জিনগতভাবে পরিবর্তিত জীব। আর এ ধরনের উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণার নাম হলো জিন প্রকৌশল বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের লক্ষ্য প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজননের মতোই। যাতে উদ্ভিদে জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য সংযোজন বা অনাকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য বাদ দেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য হলো উৎপাদিত ফসলের পুষ্টি গুণাগুণ ও স্বাস্থ্যগত সুবিধা বাড়ানো। অথবা পোকামাকড় ও আগাছা প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা, যা পরিবেশ প্রতিকূল অবস্থায় টিকে থাকতে পারে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসল উৎপাদনের প্রতিকূলতা ক্রমশ বাড়ছে। চাষযোগ্য জমিতে সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা, খরা, লবণাক্ততাসহ নানা প্রতিকূল পরিবেশ। এসব প্রতিকূল অভিঘাত মোকাবিলায় সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনের বিকল্প নেই। অথচ এই জিএমও নিয়ে আমাদের শিক্ষিত সমাজে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যা আদৌ ঠিক নয়। যেহেতু আমরা কৃষিক্ষেত্রের সূচনা থেকে জীবের জিনগত পরিবর্তন করছি, তাই এখন জিএমও (জিনগতভাবে পরিবর্তিত জীব) শব্দের ব্যবহার নিয়ে কিছু ভুল ধারণা সম্পর্কে প্রকৃত সত্য জানা জরুরি।
জিএমও নিয়ে একটি বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা হচ্ছে, কৃষকেরা জিএমও শস্যের বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন না। আসুন, বিষয়টি খোলাসা করা যাক। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, জিএমও শস্যের বীজ কিছু ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব আইন (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি) দ্বারা সুরক্ষিত করা হয়। যার মানে হলো কৃষকেরা বীজগুলো সংরক্ষণ করতে পারবেন না ও সংরক্ষিত বীজ থেকে ফসল ফলাতে পারবেন না। দশকের পর দশক ধরে বাজারে প্রচলিত সংকর জাতের (হাইব্রিড) বীজগুলোও কৃষকেরা প্রতি মৌসুমে কিনে ফসল ফলান। কারণ, কৃষক কর্তৃক সংরক্ষিত বীজগুলো সাধারণ ফসলের মতো গুণগত বৈশিষ্ট্যগুলো ধরে রাখতে পারে না এবং ফলনও আশানুরূপ হয় না। তাই সংরক্ষণ না করে বীজ কেনার বিষয়টি অনেক কৃষকের কাছে নতুন কিছু নয়। ফলে কৃষকেরা এই বীজগুলো নতুন করে কিনতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ, নতুন বীজ থেকে তাঁরা ভালো ফলন পান এবং আর্থিকভাবে লাভবান হন। কিন্তু কিছু বহুল প্রচলিত জিএমও ফসল, যেমন হাওয়াইয়ের পেঁপে, বাংলাদেশের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকাপ্রতিরোধী বিটি বেগুন এবং আফ্রিকার খরাসহনশীল ভুট্টার বীজ কৃষকেরা অন্যান্য সাধারণ ফসলের মতো উৎপাদন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি বাজারজাতকরণের মাধ্যমে অন্য কৃষকদের দিতে পারেন। এমনকি অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা বহুল আলোচিত প্রো-ভিটামিন এ–সমৃদ্ধ গোল্ডেন রাইসের বীজ কৃষকেরা উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারবেন। এতে আলাদা কোনো কৌশলের প্রয়োজন হবে না।
আরেকটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, যেটি জিএমওবিরোধীরা প্রায়ই প্রচার করেন, তা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য জিএমও প্রযুক্তি একটি করপোরেট চক্রান্ত। আসলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় উন্নত দেশগুলো জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জিএমও প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করছে, যা ওই সব দেশের মানুষকে দিয়েছে আর্থিক সচ্ছলতা। তাই এই প্রযুক্তির সুফল থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। কেননা জিএমও ফসলগুলো বিশ্বব্যাপী ১ কোটি ৮০ লাখ ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের আয় বাড়িয়ে তাদের পরিবারের ক্ষুধা নিরসনে সহায়তা করেছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৬ কোটি ৫০ লাখের বেশি মানুষ এ থেকে উপকৃত হতে পারে।
জিএমও নিয়ে আরেকটি প্রচলিত ভুল ধারণা হচ্ছে—জিএমও কীটনাশক উৎপাদনকারী বহুজাতিক কোম্পানির কূটকৌশল। আবার কিছু জিএমও ফসল যেমন, রাউন্ডআপ রেডিজাতীয় ফসল আগাছানাশকের ব্যবহার বাড়াতে পারে। রাউন্ডআপ ফসলের এই বৈশিষ্ট্যের কারণে খেতের আগাছা হাত অথবা যন্ত্র দিয়ে পরিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা কমায়। এতে মাটির গুণাগুণ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সংরক্ষিত হয়। অনেকে মনে করেন, জিএমও ফসলের জন্য বেশি কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো। আসলে পোকা–প্রতিরোধী জিএমও ফসলের জন্য কম কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। ফলে এ ধরনের ফসল রক্ষায় কীটনাশকের ব্যবহার কমে আসে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দরকারই হয় না। সর্বোপরি বিজ্ঞানীদের মতে, জিএমও চাষের ফলে রাসায়নিক বালাইনাশক, কীটনাশক ও আগাছানাশকের ব্যবহার ৩৭ শতাংশ কমেছে। (কাইম ইট. এল, ২০১৪)। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক উন্নয়নশীল দেশের সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা জিএমও ফসল নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, এ ফসল বিভিন্ন অঞ্চলের প্রধান খাদ্যশস্যের পুষ্টি গুণাগুণ ও ফসলের উপযোগিতা বাড়াতে একটি পরীক্ষিত প্রযুক্তি। এ ধরনের ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাসাভা, ডাল, শর্ষে, বেগুন, আলু, ধান ও কলা। বিভিন্ন দেশের প্রান্তিক ও মধ্যম আয়ের কৃষকেরা সাধারণত এই ফসলগুলো চাষাবাদের মাধ্যমে পরিবারের মৌলিক পুষ্টিচাহিদা পূরণ করে থাকেন।
আরেকটি মিথ হচ্ছে—জিএমও প্রযুক্তি ও এর মাধ্যমে উদ্ভাবিত ফসল যথেষ্ট পরীক্ষিত ও নিরাপদ নয়। নতুন উদ্ভাবিত জিএমও পণ্য যাতে মানবদেহ, প্রাণী কিংবা পরিবেশের জন্য হুমকি না হয়, তা নিশ্চিতে সব দেশের সরকার কঠোর জীব নিরাপত্তাবিধি (বায়ো-সেফটি প্রটোকল) মেনে চলে। এই বিধিগুলো পরীক্ষাগার ও মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই প্রক্রিয়ার ব্যাপ্তি বহু বছর পর্যন্ত হতে পারে। জিএমও ফসল নিরাপদ কি না, তা শত শত বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র মূল্যায়ন করেছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে জিএমও ফসল সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং প্রচলিত উদ্ভিদ ও খাবারের মতো পুষ্টিগুণসম্পন্ন।
পরিবেশবাদীরা প্রায়ই অভিযোগ তোলেন, জিএমও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। প্রকৃতপক্ষে জিএমও সয়াবিন ও ভুট্টার জমিতে কম চাষ দিতে হয় চাষিদের। এতে মাটির উপরিভাগের ক্ষয় হ্রাসের পাশাপাশি পুষ্টি উপাদানের বিলীন হয়ে যাওয়া কমে যায়। এ ছাড়া পোকা-প্রতিরোধী জিএমও ফসল, যেমন বিটি তুলা, ভুট্টা ও বিটি বেগুন চাষ করতে অনেক কম কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, যা মানবশরীর ও পরিবেশের জন্য উপকারী। উল্লেখ্য, বিশ্বের এক–চতুর্থাংশের বেশি বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণ কৃষি ও এ–সংশ্লিষ্ট ভূমির ব্যবহার। গবেষণায় দেখা গেছে, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে উদ্ভাবিত ফসল উৎপাদন রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়েছে ৩৭ শতাংশ, ফলন বাড়িয়েছে ২২ শতাংশ এবং কৃষকের মুনাফা বাড়িয়েছে ৬৮ শতাংশ। এ ছাড়া জিএমও ফসল ২২ বিলিয়ন কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমন কমিয়েছে, যা সড়ক থেকে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ গাড়ি তুলে নেওয়ার সমান (কাইম ইট. এল, ২০১৪)।
পরিবেশবাদীদের মতে, জিএমও অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববাজারে জিএমও খাদ্যদ্রব্য ২০ বছর ধরে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিজ্ঞানী ও বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে স্বনামধন্য মার্কিন ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সও একমত যে জিএমও শস্য থেকে উৎপাদিত খাবার প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসল বা খাবারের মতো নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর। জিএমও নিষিদ্ধের ফল স্বাস্থ্যের জন্য নেতিবাচক পরিণতি ডেকে আনবে। কারণ, কৃষকেরা তখন পুরোনো ও অধিক বিষাক্ত বালাইনাশক ও কীটনাশক ব্যবহারে বাধ্য হবেন এবং খাবারের সহজলভ্যতা আরও সীমিত হবে।
অনেকে আবার অভিযোগ তোলেন, জিএমও অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ। আসলে জিএমও কৃত্রিম। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ উদ্ভিদ ও প্রাণীর কৃত্রিম প্রজনন করে আসছে। আর তাই কৃষিকাজের সব উদ্ভিদ প্রজাতি ও আমাদের গৃহপালিত পশুপাখি অন্ততপক্ষে জিন পরিবর্তিত জীব। ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে জিন পরিবর্তন করছে। লাখ লাখ বছর ধরে ঘটে চলা প্রাকৃতিক এ প্রক্রিয়াই বিজ্ঞানীরা জিন প্রকৌশলের ক্ষেত্রে অনুকরণ করলে এটি কৃত্রিম হবে কেন?
কিছু পরিবেশবাদী দাবি করেন, জিএমও ফসলের তুলনায় অর্গানিক ফসল চাষাবাদ নিরাপদ। জৈব চাষাবাদ বা অর্গানিক ফার্মিং একধরনের বিশেষ চাষপদ্ধতি, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে প্রাকৃতিকভাবে ফসল উৎপাদন করা হয়। এটি নিরাপদ বটে, কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য জোগানে টেকসই কৌশল নয়। যেটি সাম্প্রতিক শ্রীলঙ্কান কৃষির বিপর্যয় থেকে প্রমাণিত। কিন্তু জিএমও একটি টেকসই ও পরীক্ষিত প্রজনন পদ্ধতি । তাই জৈব চাষাবাদের তুলনায় কিছু কিছু জিএমও ফসল অধিক নিরাপদ, যেমন লেটব্লাইট (নাবিধসা) রোগ প্রতিরোধ সক্ষম জিএমও আলু। এ ক্ষেত্রে লেটব্রাইট নিয়ন্ত্রণের জন্য জৈব চাষাবাদ ব্যবহৃত কপার সালফেটের মতো বিষাক্ত পদার্থ কিংবা অন্যান্য ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হয় না।
পরিশেষে বলা দরকার, কেবল একটি কৌশল কিংবা একটিমাত্র প্রযুক্তি বর্তমান বিশ্বের ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্যচাহিদার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কখনোই টেকসই সমাধান নয়। বরং টেকসই ও নিরাপদ খাদ্যের লক্ষ্য অর্জনে আমাদের সম্ভাব্য সব ধরনের প্রযুক্তির (Holistic Technology) ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্রচলিত চাষপদ্ধতি, অর্গানিক চাষাবাদ, জীবপ্রযুক্তি (Biotechnology), ক্ষুদ্র-মাঝারি ও বৃহৎ আকারের বাণিজ্যিক চাষাবাদের পাশাপাশি খাদ্য সরবরাহ ও সংরক্ষণব্যবস্থা উন্নতকরণ, খাদ্যের পুষ্টি গুণাগুণ ও নিরাপদ খাদ্যের সহজলভ্যতা বৃদ্ধি এবং খাবারের অপচয়ও কমাতে জিএমও প্রযুক্তি ক্রমেই একটি নির্ভরযোগ্য ও পরীক্ষিত কৌশল হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের কৃষিতেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
লেখক:
মো. আরিফ হোসেন, নির্বাহী পরিচালক, ফার্মিং ফিউচার বাংলাদেশ
এম আব্দুল মোমিন, ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি