মস্তিষ্ক সুস্থ রাখার জন্য কেমন ঘুম দরকার

প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া আর একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করা জরুরিপেকজেলস ডটকম

শরীর সুস্থ রাখার জন্য অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে, কথাটা সত্য বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে সুস্থ মস্তিষ্কের জন্য কেবল ঘণ্টা হিসেবে নয়, এমন ঘুম হওয়া জরুরি যা শরীরকে সতেজ রাখবে। সকালে ঘুম থেকে জেগে সতেজ লাগা জরুরী। কারণ, মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে এ ধরনের ঘুম খুব গুরুত্বপূর্ণ।

যাদের ঘুমের সমস্যা থাকে, তাদের ডিমেনশিয়া হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ঘুমের সমস্যার মধ্যে আছে ইনসমনিয়া বা স্লিপ অ্যাপনিয়া। এসব সমস্যা যাদের নেই, তাঁদের ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই কম। অসম্পূর্ণ ঘুম মস্তিষ্কের ক্ষতি করতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০ বা ৪০ বছর বয়সে যারা ঘন ঘন ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো সমস্যা ভোগেন, এক দশক পরে মস্তিষ্কের কর্মক্ষম স্মৃতি (এক্সিকিউটিভ মেমোরি), কর্যকরী স্মৃতি (ওয়ার্কিং মেমরি) এবং তথ্য প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, গভীর ঘুম এবং র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট বা আরইএম মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ডিমেনশিয়ার ঝুঁকির ক্ষেত্রেও এটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা গভীর ঘুম এবং আরইএম ঘুমের ঘাটতিতে ভুগছিলেন, ১৩ থেকে ১৭ বছর পর তাঁদের মস্তিষ্কে অ্যাট্রফির (Atrophy) লক্ষণ দেখা গেছে। এমআরআই স্ক্যান করলে আলঝেইমার রোগের প্রাথমিক লক্ষণের সঙ্গে অ্যাট্রফির মিল আছে। 

ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক ধারাবাহিকভাবে চারটি ভিন্ন ধাপের মধ্য দিয়ে যায়। সেগুলো হলো দুইটি হালকা ঘুমের ধাপ, একটি ডিপ স্লিপ ও আরইএম স্লিপ। হালকা ঘুমের ধাপে শরীর ধীরে ধীরে শান্ত হয় এবং হৃদস্পন্দন ও শরীরের তাপমাত্রা কমে আসে। এরপর আছে ডিপ স্লিপ বা স্লো-ওয়েভ ঘুম, যেখানে মস্তিষ্কের কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। সবশেষে আছে আরইএম, যেখানে আমরা সাধারণত স্বপ্ন দেখি। চারটি ধাপ শেষ হতে সাধারণত ৯০ মিনিট লাগে। এরপর আবার নতুন করে চক্রটি শুরু হয়।

আরও পড়ুন

ডিপ স্লিপ এবং আরইএম আমাদের মস্তিষ্ককে ক্লান্তি ও স্ট্রেস দূর করতে সাহায্য করে। স্মৃতি সংরক্ষণেও এর ভূমিকা আছে বলে জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সেসের সহযোগী অধ্যাপক ম্যাথিউ পেস। ডিপ স্লিপের সময় মস্তিষ্ক হরমোন এবং বিপাকীয় কাজের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। একই সঙ্গে মস্তিষ্ক থেকে বর্জ্য পরিষ্কারের কাজও চলে। অন্যদিকে আরইএম চলার সময় জেগে থাকার সময়কালে শেখা নতুন তথ্য এবং আবেগগত বিষয়গুলো প্রক্রিয়াকরণ চলে।

ডিপ স্লিপ এবং আরইএম ডিমেনশিয়ার ঝুঁকিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলে বলে মনে করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার মেডিক্যাল সেন্টারের নিউরোলজির অধ্যাপক মাইকেন নেডারগার্ড বলেছেন, ‘ডিপ স্লিপে মস্তিষ্ক যেসব অ্যামিলয়েড প্রোটিন পরিষ্কার করে, সেগুলো মস্তিষ্কে রয়ে গেলে ধরে নেওয়া হয় রোগীর আলঝেইমার আছে। বছরের পর বছর যদি ডিপ স্লিপ ব্যাহত হয়, তবে মস্তিষ্ক এই প্রোটিন পরিষ্কার পুরোপুরি করতে পারে না। একে বলে গ্লিমফ্যাটিক ফেইলিয়র। এটি হলে ডিমেনশিয়া কাছে চলে এসেছে বলে মনে করা হয়।’

বয়স বাড়ার সঙ্গে মস্তিষ্কের ঘুমের চক্র পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে পড়ে
হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিং

২০১৭ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ৬০ বছরের বেশি বয়সী ৩০০ জনের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের রাতে আরইএম স্লিপের ব্যপ্তি কম ছিল এবং ঘুমের চক্রে আরইএম পর্যায়ে যেতে বেশি সময় লাগত, তাঁদের ডিমেনশিয়ার সম্ভাবনা পরে বেড়ে গিয়েছিল। অধ্যাপক পেস বলেন, ‘আরইএম স্লিপ স্মৃতি সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্মৃতি সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ করতে না পারলে মস্তিষ্কের জটিলতাগুলো দ্রুত বাড়তে পারে এবং মস্তিষ্কের কিছু অংশ কাজে না লাগায় দ্রুত ক্ষয় হতে পারে।’

তবে ঘুম ও ডিমেনশিয়ার সম্পর্কটিকে মজা করে ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ ধরনের সমস্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন অধ্যাপক পেস। বয়স বাড়ার সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবেই (বিশেষ করে নারীদের মধ্যে) ডিপ স্লিপ এবং আরইএম স্লিপের সময় কমে আসে। বয়সের কারণে এমনিতেই ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। একইভাবে ডিমেনশিয়া হলে ঘুম কমে যায়। তাই দুই প্রক্রিয়াই একটি অপরটিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চাইলেই ঘুম উন্নত করা যায় না। ঘুমের চার ধাপের যে কোনোটিই উন্নত করা সাধারণত কঠিন। বয়স বাড়ার সঙ্গে মস্তিষ্কের ঘুমের চক্র পরিবর্তন করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ড. মালকানি বলেন, ‘ঘুম উন্নত করা সবসময়ই ভালো। কারণ এটি ঘুমের মান বাড়াতে সাহায্য করে।’

আরও পড়ুন

ঘুমের মান উন্নত করতে প্রতি রাতে প্রায় ৭ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করা সবচেয়ে সহজ কাজ। এটি বেশ কার্যকর একটি পদক্ষেপ। এতে মস্তিষ্কের জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে। এ সময়ে চার থেকে সাতবার পর্যন্ত ঘুমের চারটি ধাপ বা চক্র সম্পন্ন হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সে প্রতি রাতে ছয় ঘণ্টা বা তার কম ঘুমান, তাঁদের পরবর্তী জীবনে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। ঘুমের মান উন্নত করতে যে কোনো বয়সেই কাজ শুরু করা যায়। বয়স বেড়ে গেছে, এখন আর ঘুম হয় না ঠিকমতো, এই অজুহাত  দেওয়া ঠিক না। ঘুম ঠিক করতে বয়স কোনো বাধা নয় বলে মন্তব্য করেছেন যুক্ত্রাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, ইরভিনের সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড হিউম্যান বিহেভিয়ারের সহযোগী অধ্যাপক ব্রাইস ম্যান্ডার।

ঘুমের ধারাবাহিকতা বা নিয়মিত ঘুমানো এবং জেগে ওঠার সময় নির্ধারণ করলে ঘুম ভালো হয় বলে জানান ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের অ্যাডাপটিভ ব্রেন ল্যাবের পোস্টডক্টরাল গবেষক জশফিয়া জাভেচ।

যদি ঘুমের কোনো ঘাটতি থাকে, তাহলে মস্তিষ্ক নিজেই প্রতিটি ঘুমের চক্রে প্রয়োজন অনুযায়ী ডিপ স্লিপ বা আরইএম স্লিপের জন্য বেশি সময় বরাদ্দ করে

আরেকটি বিষয় হলো, দিনে মস্তিষ্কের যেসব অংশ বেশি ব্যবহার করা হয়, ঘুমের সময় সেসব অংশে স্লো-ওয়েভ বেশি দেখা যায়। তাই নতুন কোনো দক্ষতা শেখা বা মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জিং কিছু করলে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এর জন্য পুনরুদ্ধারমূলক স্লো-ওয়েভ ঘুমের প্রয়োজন বেড়ে যেতে পারে।

যথেষ্ট ঘুম হয়েছে কি না, বোঝার জন্য বিভিন্ন ট্র্যাকার বা স্মার্টফোন অ্যাপ আছে। সেগুলো ঘুমের বিভিন্ন ধাপে কত সময় কাটাল, তার আনুমানিক হিসাব দিতে পারে। তবে এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজে মনে করা, ‘ঘুম থেকে জেগে আমার কেমন লাগছে?’ আর যদি মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, তাহলে ভাবতে হবে আবার ঘুমে তলিয়ে যেতে আমার কতক্ষণ লেগেছে?’

সাধারণভাবে ঘুমের জন্য পর্যাপ্ত সময় বরাদ্দ রাখলেই মস্তিষ্ক ডিপ স্লিপ পর্যায়ে যেতে পারে। যদি ঘুমের কোনো ঘাটতি থাকে, তাহলে মস্তিষ্ক নিজেই প্রতিটি ঘুমের চক্রে প্রয়োজন অনুযায়ী ডিপ স্লিপ বা আরইএম স্লিপের জন্য বেশি সময় বরাদ্দ করে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তাই ভালো ঘুমের জন্য পর্যাপ্ত সময় রাখা জরুরী।

 

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস