বিপন্ন চন্দনা টিয়া

চন্দনা টিয়াছবি: সৌরভ মাহমুদ

বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর মূল ফটক পেরোলেই ডান হাতে বয়সী বিশাল একটা রাজশিরীষগাছ। গাছটার ডালের খোঁড়লে টিয়া পাখির বাসা। মেয়েটি বোধ হয় তা দিচ্ছে ডিমে। পুরুষটি বাসার বাইরে বসে আপন মনে কী সব যেন বলে চলেছে! এ রকম সময়ে হাইকোর্ট ভবন পেরিয়ে দুটি পাখি ‘কিয়াক কিয়াক’ স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে এল। রাজশিরীষগাছটা পেরিয়ে কার্জন হলের দিকে যেতে গিয়েও শূন্যে কড়া ব্রেক কষল ডানায়। তারপরে ঘুরে এসেই নেমে পড়ল গাছটার সেই পয়েন্টে—যে পয়েন্টে টিয়ার বাসা। ভয়ে ডালে বসা পুরুষ টিয়াটা ভয়ার্ত ‘টি টি টিয়া টিয়া’ ডাক ছেড়ে ছিটকে উঠল শূন্যে। নিরাপদ দূরত্বে থেকে দ্রুত ডানায় উড়ে-ঘুড়ে সমানে চেঁচাতে লাগল। এইমাত্র নামা পাখি দুটি খোঁড়লের মুখের কাছে ঠোঁট-মাথা ঢুকিয়ে সমানে প্রচণ্ড গলায় ধমক-ধামক মারতে লাগল। বলছে যেন—বেরিয়ে আয় বেটি! তোর আজ বারোটা বাজাব আমরা। এই খোঁড়ল দখল করে আমরাই বাসা বানাব। ডিম-ছানা তুলব!

কিন্তু বাসায় বসা মেয়ে টিয়াটা জানে—কচুও করতে পারবে না ওরা। এই মাপের খোঁড়লে ওরা ঢুকতেই পারবে না। এ রকম ক্ষেত্রে বেরোলেই বিপদে পড়তে হবে। টিয়াটার গত ১০–১২ বছরে বাসা দখলকারীর স্বভাব–চরিত্র মুখস্থ হয়ে গেছে। তার আগে কী সুখেই না ছিল ঢাকাবাসী টিয়ারা! ওরা যে কোত্থেকে এসে উদয় হলো এই রাজধানী শহরে! খোঁড়ল-কোটর থেকে টিয়া-শালিক-বসন্তবৌরি-কাঠঠোকরা-কোটরে প্যাঁচা-দোয়েল ইত্যাদি কোটরবাসী পাখিদের কোটর-খোঁড়ল দখলে নিয়ে বাসা বানাতে চায় ওরা।

এ সময়ে মেয়েটির স্বামী ১০–১২টি টিয়া সঙ্গে নিয়ে উড়ে আসে। বাসা দখলের চেষ্টা করা পাখি দুটিকে আক্রমণ করতে চায়। অমনি দুটি পাখিই ‘কিয়াক কিয়াক’ ডাকে যে–ই না দিল উড়াল, অমনি টিয়ার দল ভয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে পালিয়ে গেল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে।

টিয়ারা (সবুজ টিয়া, তোতা টিয়া, Rose-Ringed Parakeet, দৈর্ঘ্য ৪২ সেন্টিমিটার, ওজন ১৩০ গ্রাম) হলো বাসা দখলকারী পাখি দুটির জাতভাই। ওরাও টিয়া, তবে বড় টিয়া। নাম ‘চন্দনা টিয়া’। বাংলাদেশের বিরল তথা বিপন্ন পাখি এরা। ইংরেজি নাম Alexandrine Parakeet। বৈজ্ঞানিক নাম Pisttacula eupatria। দৈর্ঘ্য ৫৩ সেন্টিমিটার। ওজন গড়পড়তা ২৪০ গ্রাম। অর্থাৎ সবুজ টিয়ার চেয়ে দৈর্ঘ্যে ১০–১১ সেিন্টমিটার বড়, ওজনে ১১০ গ্রাম বেশি। চন্দনা টিয়াই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় টিয়া। সবচেয়ে ছোট টিয়াটির নাম লটকন, ঝুলন টিয়া, সুখপাখি। ইংরেজি নাম Vernal Hanging-parrot। দৈর্ঘ্য মাত্র ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ২৮ গ্রাম। এটির বসবাস বৃহত্তর চট্টগ্রাম-সিলেটের টিলা-পাহাড়ি অঞ্চলে।

চন্দনা টিয়ার ইংরেজি নামের সঙ্গে গ্রিসের মহাবীর আলেকজান্ডারের নাম জড়িয়ে আছে। আলেকজান্ডার চন্দনা টিয়াদের ভারতের পাঞ্জাব থেকে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে শুরু করে পৃথিবীর অনেক দেশে ছড়িয়ে দেন। তিনি বিখ্যাত, সম্মানিত ব্যক্তিদের রাজকীয় পুরস্কার বা প্রতীক হিসেবে চন্দনা টিয়া দেওয়ার প্রচলন করেছিলেন। তখন থেকে এই টিয়ার ইংরেজি নাম হয় Alexandrine Parakeet। বৈজ্ঞানিক নামের প্রথম অংশের বাংলা অর্থ তোতা, দ্বিতীয় অংশ eupatria শব্দের অর্থ সম্ভ্রান্ত বংশের কন্যা। ষাটের দশকেও চন্দনারা বাংলাদেশের সব এলাকায় কমবেশি ছিল। ১৯৬২-৭১ সাল পর্যন্ত আমি নিজে বাগেরহাট-ফকিরহাট এলাকায় এদের ছোট ও মাঝারি ঝাঁক দেখতাম, শুনতাম ডাকাডাকির শব্দ। সবাই বলত ‘বড় তোতা’ পাখি। আমাদের স্থায়ী গৃহকর্মী গনি মিয়াকে দিয়ে একটি মরা তালগাছ ও মরা নারকেলগাছে খেজুরগাছ কাটা দা দিয়ে মোট ১১টি কোটর তৈরি করিয়ে নিয়েছিলাম। চন্দনারা বাসাও করেছিল। কিন্তু আমরা বালক-বালিকারা এদের ধরার জন্য বহু চেষ্টা করেও গাছে উঠতে পারিনি কোনো দিন। টিয়ার দলবদ্ধ প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে রুখে দিয়েছিল তাদের। চেঁচাতও বটে! এই ২০১৮ সালে চন্দনারা একেবারেই বিরল পাখি হয়ে গেছে। দেশের হাতে গোনা কয়েকটি পয়েন্টে মাত্র দেখা মেলে ওদের।

পাখিপ্রেমী, পাখি আলোকচিত্রী ও প্রাণিবিজ্ঞানী এস এম ইকবাল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাড়ি বগুড়ায়। তিনি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের ডেমাজানী বাজারের তহশিল অফিস প্রাঙ্গণের প্রায় আড়াই শ বছর বয়সী একটি মেহগনিগাছের খোঁড়লে এক জোড়া চন্দনার বাসা দেখেছিলেন। ওই গাছে সবুজ টিয়াদেরও বাসা ছিল। চন্দনা যাতায়াত করত ৫–৭টি, কিন্তু ওই গাছের একটি মাত্র খোঁড়ল ছাড়া অন্য কোনো খোঁড়ল ছিল না—যেটাতে চন্দনারা ঢুকতে পারে। ইকবাল সাহেব টানা ৫–৭ দিনের নিবিড় পর্যবেক্ষণ শেষে বুঝলেন, জুতসই খোঁড়ল থাকলে আরও চন্দনার বাসা হতো। তিনি ফোনে আমার পরামর্শ চান। আমি তাঁকে পরামর্শ দিই নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। তিনি ওই গাছে কাঠের বক্স ও অন্যান্য ব্যবস্থা করেছিলেন প্রায় ৪০টির মতো। তবে শেষমেশ তাঁর মিশন নানা কারণে ব্যর্থ হয়। তবে এক ভরদুপুরে ওই মেহগনিগাছের বাসা থেকে দুটি বাচ্চা চুরি হয়। কিন্তু ইকবাল সাহেব পুলিশ বাহিনী ও সাংবাদিকদের নিয়ে ছানা দুটি উদ্ধার করে আবারও বাসায় তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শিশু একাডেমী প্রাঙ্গণ মিলে যে ‘পাখিবলয়’ আছে, সেই বলয়ে চন্দনাদের ২০–২৫টির মতো ঝাঁক দেখা যায়। দেখা মেলে জাতীয় চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ঢাকা শহরে সেই প্রায় এক যুগ আগে থেকে কীভাবে স্থায়ী বসতি গেড়ে, কীভাবেই বা রাজধানীবাসী হয়ে গেল, তা নিয়ে কয়েকটি মতামত আছে। মতামত বাদ থাক, ওরা যে ঢাকায় বসতি গেড়েছে, সেটি পরিবেশ-প্রকৃতির জন্য অত্যন্ত সুখবর। এই শহরে আছে ওরা সুখে, বাসা বেঁধে ডিম-ছানা তুলছে, এটাই তো বড় খুশির খবর।

পুরুষ চন্দনা টিয়ার ঠোঁটটি টুকটুকে আলতা রঙের। ঘাড়ের কাছের ডানার প্রান্তও আলতা রঙের পট্টি মারা। চিবুক-ঘাড় গোলাপি। লম্বা লেজের উপরিভাগ আকাশি-নীলচে। পুরুষের গলায় যেন কালো রঙের চেইন পরানো। মেয়েটির কালো পট্টি থাকে না। ধূসরাভ পা। তবু দূর থেকে একনজরে সবুজাভ পাখি এরা।

মূল খাদ্য এদের নানা রকম ফল-বীজ-নরম ফুলের অতি কচি কুঁড়ি, পাতা, বিভিন্ন বীজসহ ফুলের মধুরেণু। ভরা মৌসুম এদের শীত ও বসন্তকাল। এ সময় এরা বাসা বাঁধে। গাছের খোঁড়ল-কোটর বাদেও দালানকোঠার ফোকর-ফাটলে বাসা বাঁধে। ডিম পাড়ে ৪-৬টি। ডিম ফুটে ছানা হয় ২৩-২৭ দিনে। সবুজ টিয়ারা তো বহুকাল ধরে রাজধানীবাসী। বড় টিয়ারাও এখন তা–ই। অতএব দুই প্রজাতির টিয়া এখন নগরবাসীর চোখের সৌন্দর্য হয়ে গেছে। সব জাতের টিয়াই গাছের ডালে ঝুলতে-দুলতে পারে অ্যাক্রোব্যাটদের মতো। পা ব্যবহার করতে পারে হাতের মতো।

লেখক: পাখিবিশারদ

ছবি: এস এম ইকবাল