একটি গাছে আপনার কল্পনার চেয়েও বেশি অণুজীব বাস করে

একটি গাছের বদলে পুরো বনের উদাহরণ দিলে বিষয়টি ভালো বোঝা যাবে। বনের কথা ভাবলে আমরা বড় বড় গাছপালা ও প্রাণীর কথা ভাবি। সুন্দরবনে যেমন আছে বাঘ, হরিণ বা বানর। আছে নানা রকম পাখি। বড়-ছোট মিলিয়ে সুন্দরবনে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির পাখি ও ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে।

গাছেরও আছে বিভিন্ন প্রজাতি। সব প্রজাতি মিলে বন হলো এক জটিল ও গতিশীল বাস্তুতন্ত্র। সুন্দরবনে যেমন বাঘ কমে গেলে প্রভাব পড়ে হরিণের সংখ্যায়। তেমনি হরিণ কমে গেলে আবার ঘাস লতাপাতা বেড়ে যায়। এভাবে পুরো বাস্তুতন্ত্র একে অপরের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকে। শুধু প্রাণী না, বনে পুরোনো মরে যাওয়া গাছও এই বাস্তুতন্ত্রের অংশ। এমনকি এই সিস্টেমের অংশ অণুবীক্ষণিক ছত্রাকও। সাম্প্রতিক এক গবেষণা দেখা গেছে, একটি গাছের ভেতরের জগতটিও ঠিক একটি বনের মতো। কারণ, একটি গাছের ভেতরে বাস করে এক ট্রিলিয়ন অণুজীব। এসব অণুজীব অদৃশ্য এক বাস্তুতন্ত্রে জীবনযাপন করে। 

ইয়েল ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিদ জোনাথন গেউয়ার্টজম্যান ২০২১ সালের জুলাইয়ে ইয়েল-মায়ার্স বনে একটি গাছে পোর্টেবল গ্যাস মাপার যন্ত্র বসাচ্ছেন। এর সাহায্যে গাছ থেকে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাস পরিমাপ করা যাবে
জুডিথ রোজেনট্রেটার

গত আগস্টের শুরুতে বিজ্ঞানীরা নতুন এই অনুসন্ধানের ফল প্রকাশ করেছেন। গাছের কাণ্ডের ভেতরে বসবাসকারী অণুজীব বাস্তুতন্ত্র বা মাইক্রোবায়োম নিয়ে করা সবচেয়ে বিস্তৃত গবেষণা এটি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাছের কাঠ বা টিস্যুর ভেতরে নিজস্ব কোষ ছাড়াও ট্রিলিয়ন অণুজীব নিয়ে কোষের আরেকটি জগৎ আছে। এ জগতের অণুজীব কোষগুলো মূলত ব্যাকটেরিয়া ও এককোষী আর্কিয়া দিয়ে গঠিত। এগুলো গাছের বিভিন্ন অংশে বাস করে। এমনকি প্রতিটি প্রজাতির গাছের জন্য অণুজীবগুলো বিশেষভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।

যেভাবে জানা গেল

নেচার জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণার ফল থেকে অণুজীবের বিশাল এক জগৎ নিয়ে সম্পর্কে জানা গেছে। এর আগে এই অণুজীবেরা অনাবিষ্কৃত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির বাস্তুতন্ত্রবিদ ও এই গবেষণার লেখক জোনাথন গেউয়ার্টজম্যান বলেছেন, ‘একটি গাছ নিজেই এক ধরনের জটিল বাস্তুতন্ত্র।’ যদিও গবেষণাটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, তবু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই অণুজীবগুলো গাছের স্বাস্থ্য, বৃদ্ধি আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষকেরা যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ১৬ প্রজাতির ১৫০টির বেশি গাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন। নমুনায় আছে রেড ম্যাপল, ব্ল্যাক বার্চ ও হোয়াইট অ্যাশ গাছ। এই গাছগুলো থেকে কলমের চেয়ে সরু কাঠের কোর বের করে নিয়েছেন গবেষকেরা। এরপর কাঠ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি অনুমান করা হয়েছে গাছের কাণ্ডে থাকা অণুজীবের সংখ্যাও।

২০২১ সালে ইয়েল-মায়ার্স বনে একটি বার্চ গাছে জন্মানো ছত্রাক
জোনাথন গেউয়ার্টজম্যান

অণুজীব যেভাবে গাছে থাকে

অণুজীবগুলো গাছের কাণ্ডের দুইটি ভিন্ন অংশে থাকে। এরা গাছের ভেতর ও বাইরের অংশে থাকে। বাইরের কাঠকে বলে স্যাপউড। ভেতরের কাঠ হার্টউড নামে পরিচিত। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, ভেতরে বা বাইরের কাঠে ভিন্ন ধরনের অণুজীব আছে। স্যাপউডে অক্সিজেন বেশি ব্যবহার করে এমন অণুজীব বেশি। আর অক্সিজেনবিমুখ অণুজীব বেশি হার্টউডে। গবেষণায় দেখা গেছে, গাছে উৎপন্ন বেশিরভাগ মিথেন গ্যাসের উৎস হার্টউড।

অণুজীবগুলো কীভাবে গাছের কাঠের টিস্যুতে প্রবেশ করে, তা নিয়েও গবেষণা চলছে। জানা গেছে, কিছু অণুজীব হয়তো বীজের মাধ্যমে উত্তরাধিকারসূত্রে গাছের কাঠে চলে আসে। এরপর গাছের সঙ্গে থেকে যায়। কিছু অণুজীব গাছের ক্ষত দিয়ে প্রবেশ করে। আবার কিছু প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া উন্মুক্ত অংশের মাধ্যমেও ভেতরে চলে আসে।

ভবিষ্যত গবেষণায় পথ দেখাবে 

গাছের ওপর এই অনুসন্ধানের আগে একইরকম গবেষণা হয়েছে মানুষের শরীর নিয়ে। মানুষের শরীরে কত অণুজীব থাকে, তা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা আছে। নতুন গবেষণাটি মানবদেহের মাইক্রোবায়োম নিয়ে করা আগের গবেষণার আদলে তৈরি করা হয়েছে। ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষক ওয়ায়াট আর্নল্ড এই গবেষণার লেখক। তাঁর মতে, এই গবেষণাটি গাছে অণুজীব নিয়ে গভীরতর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ম্যাপ হিসেবে কাজ করবে।

গবেষণাটি মেক্সিকোর ইনস্টিটিউট অব ইকোলজির অণুজীব বিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক রেভারচনের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘আমি জানতে চাই মেক্সিকো বা ব্রাজিলের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় গাছগুলোতে কী ঘটে।’

একটি গাছের বাস্তুতন্ত্র আসলে জটিল এবং বৈচিত্র্যময় জগৎ। আমরা গাছকে একটি মাত্র জিনিস বলে মনে করি। আসলে গাছ হলো ট্রিলিয়ন অণুজীবের এক মিলিত জীবন। আর এক ট্রিলিয়ন কোনো ছোটখাটো সংখ্যা নয়। একের পর ১২টি শূন্য দিতে হয় এক ট্রিলিয়ন লিখতে। এক গাছে এত অণুজীব বাস করে, তা এই গবেষণা প্রকাশের আগে আমাদের ধারণার বাইরে ছিল!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস