বাঁশপ্যাঁচা বা শিঙ্গেল প্যাঁচা

ছবি: উইকিপিডিয়া

বাঁশঝাড়টির দুই পাশে দুটি বয়সী গাবগাছ। দুটি গাছেই পাকা গাব ঝুলে আছে। ওই পাকা গাবের লোভে চার ছেলেমেয়ে ঢুকে পড়ে গভীর-ঘন গ্রামীণ বাগানটির ভেতরে। একটি গাবগাছের তলায় আসতেই শেফালি নামের ১১ বছরের মেয়েটির চোখ আটকে গেল বাঁশঝাড়ের দুখানা কঞ্চিতে—একখানা কঞ্চিতে পাশাপাশি-ঠাসাঠাসি করে বসে আছে তিনটি পেতনি, অন্যটিতে চারটি। দিব্যি ঘুমাচ্ছে তারা। ভয়ে ‘ভূত ভূত’ বলে চিৎকার দিল শেফালি। আঁতকে উঠে অন্য তিনজনও যেই না দেখল ঘুমন্ত পেতনিগুলোকে, অমনি ভয়ে চেঁচিয়ে সবাই ছুটল বাড়ির দিকে। বাড়ির মুরব্বিরা ঘটনা শুনে বললেন, সত্যিই পেতনি সেগুলো। একজনের দাদি বললেন, চল যাই, দেখে আসি পেতনিগুলোকে। সারা জীবন শুধু গেছো পেতনি, মেছো পেতনির নাম শুনে এলাম, দেখলাম না কোনো দিন।

বাঁশতলায় এসে ওপরে তাকিয়ে তিনি পেতনি সাতটিকে দেখলেন, হাসলেন, হাতের ইশারায় ভীত ছেলেমেয়েদের ডাকলেন কাছে। আঙুল তুলে বললেন, ‘বোকারা, “বাঁশপ্যাঁচা” দেখে পেতনি ভাবলি। তাদের ডাক তো তোরা রোজ রাতেই শুনিস। ওই যে রাতে ঘরে বসে বা শুয়ে তোরা যে “টুও” বা “ব্রুউ” শব্দের পিলে কাঁপানো ডাক শুনিস না, এগুলোরই ডাক।’

ছবি: উইকিপিডিয়া

সবাই এবার নির্ভয়ে দেখছে প্যাঁচাগুলোকে—বাঁশঝাড়ের ঘনত্ব ও ছায়া ছায়া পরিবেশে বসে আছে তারা। ঠোঁটের আগা থেকে পুরো ঠোঁট ও কপাল হয়ে মাথার দুই পাশের লম্বা দুখানা খাড়া শিং (আসলে পালকগুচ্ছ) পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গাটুকুকে ইংরেজি ‘V’ অক্ষরের গড়নের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যাবে অনায়াসে। সব মিলিয়ে এগুলোর মুখমণ্ডলের আকৃতি বা গড়ন-ধরন কিম্ভূতকিমাকার। কপালজোড়া ‘ভি’ সেপটি তাদের অন্য রকম সৌন্দর্য দিয়েছে। নিশাচর পাখি তো, দিনটা কাটায় গাছের ডালে, বাঁশের কঞ্চিতে, গাবগাছ ও অন্যান্য ছায়াচ্ছন্ন গাছের বা আঁধার জায়গাই বেশি পছন্দ। বাঁশ-কঞ্চি ও বাঁশের কাঁচা পাতার সঙ্গে এদের শরীরের রং ক্যামোফ্লেজ হয়ে যায়। আর তারা ঘুমের অভিনয় খুব ভালো জানে। যে চারটি ছেলেমেয়ে পাকা গাব খেতে এসেছিল, সবাই তাকিয়েছিল ও চেঁচাচ্ছিল, তখনো কিন্তু প্যাঁচা সাতটি চোখ খোলেনি বা সামান্য খুলে ছেলেমেয়েদের দেখেছে, বসে থেকেছে মূর্তির মতো। এই প্যাঁচারা নিশ্চিত থাকে যে চোখ না খুললে কোনো শত্রু তাদের দেখতে পারবে না। দেখলেও তাদের মুখমণ্ডল দেখলে ভয় পাবে। ব্যাপারটা অবশ্য শতভাগ ঠিক নয়।

আরও পড়ুন

ওই সাতটি বাঁশপ্যাঁচার ভেতরে দুটি ছিল মা ও বাবা পাখি, অন্য পাঁচটি সদ্য উড়তে শেখা আনাড়ি বাচ্চা। তাদের বাসা বাঁধার ভরা মৌসুম বসন্ত থেকে হেমন্তকাল। বাসা করে গাছের প্রাকৃতিক কোটর-ফোকরে। সময়মতো বাসা বাঁধার জায়গা না পেলে কোটরবাসী অন্যান্য পাখির, যেমন দোয়েল, শালিক, বসন্তবাউরির পরিত্যক্ত বাসা ব্যবহার করে। তবে ক্বচিৎ মরিয়া হয়ে রাতেই তারা উল্লেখিত পাখিদের বাসা (দিনের পাখিরা তো রাতে অসহায়) জবরদখলে নিয়ে নেয়। পরদিন ভোর বা সকালে এ জন্য দুই পক্ষের ভেতর লড়াই লেগে যায়। নিশাচর প্যাঁচারা তো আবার দিনে অসহায়। তার ওপর অন্যান্য দিবাচর পাখিও প্যাঁচাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না। এ রকম লড়াই আমার জীবনে আমি দু-পাঁচবার দেখেছি।

বাঁশপ্যাঁচারা ডিম পাড়ে তিন থেকে পাঁচটি। স্ত্রীটিই ডিমে তা দেয় অধিকাংশ সময়। ক্বচিৎ পুরুষটিও তা দেয়। পুরুষটি রাতে স্ত্রীটিকে এনে খাবার খাওয়ায়। ডিম ফুটে ছানা হয় ২৫-৩০ দিনে। দুজনে মিলেই ছানাদের খাবার খাওয়ায়। এদের পিচ্চি ছানাগুলো দেখতে যা সুন্দর না! দুষ্ট-মিষ্টি চেহারা। আদুরে আদুরে চোখ। চাহনির ভাবভঙ্গি খুবই উপভোগ্য। বাঁশপ্যাঁচাদের মূল খাদ্য হলো নানা রকম কীটপতঙ্গ, ইঁদুর, পাখির ছানা ইত্যাদি। রাতে তারা শিকারের জন্য প্রয়োজনে মাটিতে নামে। মাটি থেকে অল্প ওপর দিয়ে মাটি ছুঁই ছুঁই করে উড়ে-ঘুরে খাবার তল্লাশি করে। উইপোকার ডিম ও কেঁচো তাদের প্রিয় খাদ্য। সুযোগ পেলে বসন্ত-গ্রীষ্মকালে ঝিঁঝি পোকা শিকার করে। ছোট ব্যাঙ-টিকটিকি নজরে পড়লেও ছাড়ে না।

ছবি: উইকিপিডিয়া

সদ্য উড়তে শেখা আনাড়ি বাচ্চারা অনেক সময় উড়ন্ত পোকামাকড় ধাওয়া করে মানুষের ঘরবাড়িতে ঢুকে পড়ে। মাছের ঘেরের জালেও আটকে যায়। যেমন ১৪ নভেম্বর ২০২২-এ সাতক্ষীরার তালা উপজেলার আগৈলঝাড়া গ্রামের সেলিম শেখ নামের এক ভদ্রলোকের কতবেলগাছের গোড়ায় দেওয়া জালে আটকা পড়েছিল একটি বাচ্চা। জাল দিয়ে ঘেরা দেওয়া হয়েছিল—যাতে ছেলেপুলেরা কতবেলগাছে উঠতে না পারে। একটি ‘মালপোকা’ ধাওয়া করে ওই জালে আটকে যায় পাখিটি। মুঠোফোনে আমার এক বন্ধু রাশেদ বিশ্বাসের মাধ্যমে সেলিম সাহেব আমার পরামর্শ চান ও পাখিটির ছবি পাঠান। সারা দিন আটকে রেখে সন্ধ্যায় ছেড়ে দেন পাখিটিকে। আমার গ্রামের (ফকিরহাট, বাগেরহাট) হৃদয় খান (১৮) ছেলেটি ঘরে বসে পড়ছিল রাতে। একটি ঘাসফড়িংকে ধাওয়া করে ঘরে ঢুকে পড়ে একটি বাচ্চা। কল পাই আমি। পাই ছবিও। ওটাকেও সন্ধ্যায় ছেড়ে দেওয়া হয় (১৫/১১/২২)। হৃদয়দের আছে একটা বিশাল বাঁশঝাড়। ওই বাঁশঝাড়ে যে বাঁশপ্যাঁচা বা শিঙ্গেল প্যাঁচারা থাকে, তা ছেলেটি ভালোভাবে জানে।

আরও পড়ুন

বাঁশপ্যাঁচা বা শিঙ্গেল প্যাঁচা নামটি বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে বেশি ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য নাম হলো নিমপ্যাঁচা, নিমপোখ। এর ইংরেজি Collared Scops-owl বৈজ্ঞানিক নাম Otus lettia। দৈর্ঘ্য ২৩-২৫ সেমি.। ওজন ১০৮-১৭০ গ্রাম।

একনজরে শিঙ্গেল প্যাঁচার রং ঘন বাদামি ও হালকা বাদামির মিশ্রণ। গলা-ঘাড়-মুখমণ্ডল হালকা হলুদ, তাতে লালচে-বাদামির ভাব। হলুদাভ ঠোঁট ও পা। আমাদের আবাসিক প্যাঁচাটিকে ঢাকার শহরতলি ও আশপাশ এলাকাসহ সারা দেশে দেখতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত, প্রথম আলোর উদ্যোগে ২০০৯ সালে আমি, আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন ও সাংবাদিক ইফতেখার মাহমুদ মিলে ‘পাখি ও প্রকৃতি’ ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সে ভ্রমণে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের এক গেরস্তবাড়ির পেছন দিকের মরা একটি গাছের কোটরে শিঙ্গেল প্যাঁচার সন্ধান পেয়েছিলাম। গাছটির গায়ে আমি জোরে জোরে থাবা মারি। তিনটি প্যাঁচা ভয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসে। নাসির ভাই ও ইফতেখার ভাই খুব কাছ থেকে দুরন্ত সব ছবি নিয়েছিলেন। সেই ছবিসহ রিপোর্ট প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল।

লেখক: পাখিবিশারদ

*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত