রক্ত খেয়ে মশা সেই পুষ্টির যোগান দেয়। তাই অন্যান্য প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর হলেও রক্ত শোষণ মশার জীবনচক্রেরই অংশ
মশা আমাদের জন্য অন্যতম আতঙ্কের নাম। এটি একধরনের ছোট মাছি প্রজাতির পতঙ্গ। ‘প্রজাতি’ কথাটা হয়তো পুরোপুরি ঠিক হলো না। বৈজ্ঞানিকভাবে বললে, একই বর্গের কীট। বর্গের নাম, ডিপটেরা। এটি মূলত মাছির বর্গ।
অধিকাংশ প্রজাতির স্ত্রী-মশা স্তন্যপায়ী প্রাণীর রক্ত পান করে। মেরুদণ্ডী প্রাণীর, যেমন স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, সরীসৃপ, উভচর প্রাণী, এমনকি কিছু মাছের শরীর থেকেও রক্ত শোষণ করে মশা। এরকম হাজারো প্রজাতির মশা রয়েছে। অ্যানোফিলিস, কিউলেকস, এডিস, হেমাগোগাস প্রভৃতি রোগ সংক্রমণের চলক হিসেবে কাজ করা মশাদের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সাধারণভাবেও এগুলোই সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সাড়ে তিন হাজারের বেশি প্রজাতির মশা পাওয়া গেছে। যেসব মশা নিয়মিত মানুষকে কামড়ায়, তারা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষের শরীরে রোগজীবাণু সংক্রমণের চলক হিসেবে কাজ করে। অন্য যেসব প্রজাতি নিয়মিত মানুষকে কামড়ায় না, কিন্তু অন্যান্য প্রাণীদের শরীরে রোগ সংক্রমণের চলক, তারা মূলত বিভিন্ন কারণে, যেমন হঠাৎ বন ধ্বংস বা বাসস্থান থেকে উৎখাত করা হলে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। যদিও এগুলো যেসব প্রাণীর শরীর থেকে রক্ত শুষে নেয়, তা তাদের শরীরের তুলনায় খুবই অল্প।
আর সব মাছির মতো মশার জীবনচক্রও চারটি পর্যায়ে বিভক্ত—ডিম, শূক, মুককীট এবং পূর্ণাঙ্গ মশা
কিছু মশা আবার ভয়ানকরকম রোগজীবাণু সংক্রামক। এগুলোর মাধ্যমে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকা ভাইরাস প্রভৃতি রোগ সংক্রমিত হয়। এদের মধ্যে পুরুষ মশা কেবল একদিন বাঁচে। যেগুলো একদিনের বেশি বাঁচে, তাদের পরিস্থিতি একেবারে নাজুক হয়ে পড়ে। আর নারী মশা বেঁচে থাকে সচরাচর ৬-৮ সপ্তাহ। এই ছোট মাছি প্রজাতির পতঙ্গ দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বুকে টিকে আছে।
আগেই বলেছি, মশা ডিপটেরা বা মাছি বর্গের পতঙ্গ। এই বর্গের ‘নেমাটোসেরা’ উপবর্গের অন্তর্ভুক্ত এরা। আরও স্পষ্ট করে বললে, মশা মূলত ক্রেন মাছি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। মশার কিছু প্রজাতির নারীরা রক্ত শোষণ করে ও মারাত্মক সংক্রামক রোগ বিস্তার করে। তবে কিছু প্রজাতির মশা রক্ত শোষণ করে না। আবার যেসব প্রজাতির মশা রক্ত শোষণ করে, সেগুলোর অনেকগুলো রক্ত শুষে নিয়ে রক্তে উচ্চ থেকে নিম্ন চাপ সৃষ্টি করে। তবে কোনোরকম রোগ বিস্তার করে না। রক্ত শোষণকারী প্রজাতির মধ্যেও শুধু নারীরাই রক্ত শোষণ করে।
এবারে মশার জীবনচক্র নিয়ে একটু জেনে নেওয়া যাক। আর সব মাছির মতো মশার জীবনচক্রও চারটি পর্যায়ে বিভক্ত—ডিম, শূক, মুককীট এবং পূর্ণাঙ্গ মশা।
মূলত অ্যানোফিলিস প্রজাতি এমনটা বেশি করে থাকে। অ্যানোফিলিস প্রজাতির ডিম অনেকটা চুরুট আকৃতির। দুই পাশে পানিতে ভেসে থাকার উপাদান রয়েছে
বেশির ভাগ প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ নারী মশা বদ্ধ পানি বা জলাশয়ে ডিম পাড়ে। কিছু পানির কাছাকাছি, বাকিরা জলজ উদ্ভিদে ডিম পাড়ে। প্রত্যেক প্রজাতি ডিম পাড়ার জন্য পানিতে বা পানির কাছাকাছি অবস্থান নির্বাচন করে ও পারিপার্শ্বকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। কিছু হ্রদে, কিছু সাময়িক ডোবায়, কিছু জলাভূমিতে, আবার কিছু লবণাক্ত জলাভূমিতে ডিম ছাড়ে। লবণাক্ত পানিতে ডিম পাড়া মশাদের মধ্যে সমান সংখ্যক প্রজাতি বাড়িতে পরিষ্কার পানিতে ও লবণাক্ত পানিতে ডিম পাড়ে। এর এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্রের পানিতে, আর বাকিরা লবণাক্ততার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়।
এবারে মশার জীবনচক্রের ধাপগুলো নিয়ে সংক্ষেপে বলি।
১. ডিম: প্রজাতি অনুযায়ী মশার ডিম পাড়ার ধরনে পার্থক্য রয়েছে। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো, নারী মশা পানির ওপরে ওপর-নিচ বরাবর ওড়াউড়ি করে এবং পানিতে ডিম ছাড়ে। মূলত অ্যানোফিলিস প্রজাতি এমনটা বেশি করে থাকে। অ্যানোফিলিস প্রজাতির ডিম অনেকটা চুরুট আকৃতির। দুই পাশে পানিতে ভেসে থাকার উপাদান রয়েছে। কিছু প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ নারী মশা তার জীবনচক্রে ১০০ থেকে ২০০টি ডিম দিতে পারে।
২. শূক: মশার শূক বা লাভায় খাবার উপযোগী মুখসহ সুগঠিত মাথা, পা-হীন বক্ষস্থল, ও বিভক্ত পেট থাকে। লাভা চারটি স্তরে বৃদ্ধি পেয়ে মুককীটে পরিণত হয়।
৩. মুককীট: মশার মুককীট দেখতে কমা-আকৃতির। মাথা ও বক্ষস্থল পেটের সঙ্গে বাঁকা হয়ে একত্রিত হয়। মুককীট তার পেটের সাহায্যে সাঁতার কাটতে পারে। বেশির ভাগ প্রজাতির মুককীটকে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য প্রায়ই পানির ওপরে আসতে হয়।
৪.পূর্ণাঙ্গ মশা: প্রজাতি অনুযায়ী ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হওয়ার সময়ের পার্থক্য দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রার ব্যাপক প্রভাব থাকে। কিছু প্রজাতির ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে সময় লাগে পাঁচ দিনের মতো। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে সময় লাগে ৪০ দিন বা কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে আরও বেশি। পূর্ণাঙ্গ মশার শারীরিক আকৃতি শূকের ঘনত্ব ও পানিতে খাদ্যের পর্যাপ্ততার ওপর নির্ভর করে।
শেষ করার আগে বলি, নারী মশারা রক্ত শোষণ করে কেন। ডিম পাড়ার আগে নারী মশাদের প্রচুর পুষ্টি প্রয়োজন হয়। রক্ত খেয়ে মশা সেই পুষ্টির যোগান দেয়। তাই অন্যান্য প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর হলেও রক্ত শোষণ মশার জীবনচক্রেরই অংশ।
লেখক: শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি, বিজ্ঞান বিভাগ, কাজেম আলী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চট্টগ্রাম
সূত্র: উইকিপিডিয়া