জিনোম দিয়ে তদন্ত

টিভি বা সিনেমার ক্রাইম শোতে প্রায়ই দেখা যায়, অপরাধ সংঘটনের স্থান থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে সেটা বিশ্লেষণ করে তদন্তকারীরা দোষীদের চিহ্নিত করতে এবং নির্দোষকে মুক্তি দিয়েছে। তবে বাস্তবে ফরেনসিক ডিএনএ প্রসেসিং তথা ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং এক ঘণ্টার প্রাইমটাইম স্লটের চেয়ে অনেক বেশি সময় নেয়।

ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং একটি রাসায়নিক পরীক্ষা। এটা কোনো ব্যক্তি বা জীবের জেনেটিক মেকআপ দেখায়। আদালতে প্রমাণ হিসেবে, মৃতদেহগুলো শনাক্ত করতে, রক্তের সম্পর্কের সন্ধান করতে এবং রোগের সন্ধানের জন্যও ব্যবহৃত হয় এই পরীক্ষা পদ্ধতি।

ডিএনএ হলো ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিডের সংক্ষিপ্তরূপ। আমাদের দেহের প্রতিটি কোষের ভেতর রয়েছে এই দ্বি-সূত্রাকার রাসায়নিক যৌগ। পলিমারের মতো একত্রে বন্ধন তৈরি করে জীবনের স্থায়ী নীলনকশা তৈরি করে এই ক্ষারজাতীয় যৌগ। এর মধ্যে চারটি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষার রয়েছে। তারা একে অন্যের সঙ্গে জুটি বাঁধে, একে বেসপেয়ার বা জোড়াবদ্ধ ক্ষার বলে। মানুষের ডিএনএতে প্রায় ৩ বিলিয়ন বেসপেয়ার রয়েছে। এরা একটি আরেকটির সঙ্গে পেঁচিয়ে থাকে। যৌগগুলোর সম্পূর্ণ সেটটি জিনোম নামে পরিচিত। যেকোনো মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের জিনোমের ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশই হুবহু একরকম। তবে সামান্য শূন্য দশমিক ১ শতাংশ পার্থক্যই শারীরিক ও মানসিকভাবে একজনের সঙ্গে আরেকজনের চেহারা, আচরণ ও বংশগতভাবে পার্থক্য তৈরি করে দেয়। এই পার্থক্যটাই ব্যবহার করা হয় ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট পদ্ধতিতে।

মানুষের জিনোমের ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রকাশ করতে কিছু রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। ডিএনএর ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক টুকরা তথ্যই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে কিংবা নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে। এ ছাড়া কোনো পুরোনো বা নষ্ট হওয়া মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করা যেতে পারে এই পদ্ধতিতে।

ধরা যাক, কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে অপরাধ সংঘটনের স্থান থেকে প্রাপ্ত জেনেটিক নমুনা এবং সন্দেহভাজনের জেনেটিক নমুনাকে সংগ্রহ করা হবে। তারপর ১৩টি মূল STR-এর জন্য স্ক্যান করা হবে এগুলোকে। STR হলো জিনোমে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ২-৬টি নিউক্লিওটাইড-দীর্ঘ অনুক্রমের পুনরাবৃত্তি সংগ্রহ। যেহেতু STR-এর পুনরাবৃত্তিগুলো দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে, তাই এই জেনেটিক মার্কারের সেট প্রতিটি ব্যক্তির আলাদা হয়। এই বৈশিষ্ট্য STR-কে একটি অনন্য ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট হিসেবে আদর্শ করে তোলে।

টিভি সিরিজের সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক। একটি এএনএ বিশ্লেষক মেশিনে অপরাধীর চুল, নখ বা অন্য কোনো নমুনার কিছু অংশ প্রবেশ করিয়ে অপরাধীর চেহারা কেমন, তার ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি একদল ডাচ গবেষকেরা নতুন একটি পরীক্ষা-পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। অপরাধ সংঘটিত স্থান থেকে সংগৃহীত ডিএনএ নমুনাকে পর্যবেক্ষণ করে সন্দেহভাজন ব্যক্তির চোখের রং শনাক্ত করা যায় এ পদ্ধতিতে। ছয়টি নির্দিষ্ট এসএনপিকে ব্যবহার করা হয় অপরাধীর চোখের রং শনাক্ত করতে। কিন্তু পরীক্ষাটি ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর জিনোমের নকশার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। তাই আরও বিচিত্র জনগোষ্ঠীর জন্য এটা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তা ছাড়া শুধু চোখের রঙের মিলের কারণেই কারও কাউকে দোষী করা যায় না। পরীক্ষাটি শুধু অপরাধীকে খুঁজে বের করার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং একটি অত্যন্ত নির্ভুল পদ্ধতি। বেশির ভাগ দেশে এখন ঠিক একইভাবে ডিএনএ রেকর্ডগুলো রাখে, ঠিক যেমন পুলিশ আসল ফিঙ্গারপ্রিন্টের অনুলিপি রাখে। চিকিৎসাক্ষেত্রে এর আরও ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে, যেমন কোনো রোগীর হয়তো অঙ্গ প্রতিস্থাপন করতে হবে। এ জন্য দাতার দেহের টিস্যুর সঙ্গে গ্রহীতার টিস্যুর ম্যাচিং করতে হয়। এ কাজ দ্রুত করা যায় ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশ্লেষণের মাধ্যমে। পারিবারিকভাবে যেসব রোগ বংশানুক্রমে ছড়ায়, সেগুলো সহজে শনাক্ত ও নিরাময়েও এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।

ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং পদ্ধতি দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। কারণ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা সহজ। তবে ফরেনসিক বিজ্ঞান মূলত একটি সম্ভাব্যতা-নির্ভর বিজ্ঞান, এমনকি এটি নিশ্চিতভাবে অপরাধী শনাক্ত করতে পারে না। তাই চেষ্টা চলছে এই পদ্ধতিকে আরও নিখুঁত করে তোলার।

লেখক: প্রভাষক, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়