জলময়ূরী নাচ রে…

জলময়ূরী

পদ্মপাতার বড়সড় গোলাকার মঞ্চে নাচে মশগুল জলময়ূরীটি। ঘুরে ঘুরে নাচ, পর্যায়ক্রমে পা তুলে তুলে এক পায়ে দাঁড়িয়ে নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর নাচ। লম্বাটে গলা-মাথা-ঠোঁট বারবার ওপর-নিচ করছে, শরীর দোলাচ্ছে-ফোলাচ্ছে। ধ্রুপদি নৃত্যের সব কটি মুদ্রা যেন কবজায় আছে ওই স্ত্রী পাখির। পুরুষটি বসা অন্য একটি পদ্মমঞ্চে, মুগ্ধ চোখে দেখছে সে স্ত্রী পাখিটিকে। নাচ কি আর সে-ও কম জানে কিছু! নাচছে ওটাও। শরতের নির্মেঘ নীল আকাশের নিচের যে বিলে এই মধ্যদুপুরে প্রেমনৃত্য প্রতিযোগিতায় মেতেছে পাখি দুটি, সেই বিলের নামও পদ্মবিল। হয়তোবা বহু বছর আগে এই বিল ছিল পদ্মবন-পদ্মফুলের দখলে। গোলাপি রঙে ছেয়ে যেত বিশাল বিলটি। ১৯৬৮ সাল, বিলের দুই পাশে তখন ধানখেত। হোগলাবন, শোলা, হিজল, শাপলা, পানিফল, নলখাগড়া। ১৯৬৯ সালের শরতেও প্রায় পাঁচ বিঘা জোড়া পদ্মবন ছিল, পদ্ম ফোটার মৌসুমে বিলটি পদ্মগন্ধী হয়ে যেত।

সেই পদ্মবনে পুরুষ পাখিটি তার লম্বা লেজটি দোলাচ্ছে, বারবার বুকটা ফুলিয়ে-দুলিয়ে স্ত্রীটিকে যেন বলছে, ‘দেখো দেখো, কত ভালোবাসি আমি তোমাকে!’ স্ত্রী পাখিটি বেশি একটা পাত্তা দিচ্ছে না মনে করে পুরুষ পাখি এবার উড়াল দেয়। নামে গিয়ে স্ত্রী পাখিটির পদ্মমঞ্চে। অমনি পদ্মপাতাটি একটু যেন ডুবে যায়। জল ওঠে মঞ্চে। ঝট করে উড়াল দেয় স্ত্রীটি। পেছনে চলল পুরুষটি—পাঁচ বিঘা জোড়া পদ্মবনটার পদ্মফুল ছুঁই ছুঁই করে উড়ল কয়েক পাক। তারপরে গিয়ে বসল আবার একটি পদ্মফুলে। পুরুষটিও বসল অন্য একটি ফুলে।

১৯৬৯ সালের শরতের শেষ ভাগে বাবার সঙ্গে বিলটার দক্ষিণ প্রান্তের আমগাছে বসে ছিলাম আমি। বাবার হাতে বন্দুক। একঝাঁক বালিহাঁস রোজই নামে পদ্মবিলে, সেই ঝাঁকে গুলি করতে চান বাবা। বাবা আমাকে পাখিগুলোর নাম বলেছিলেন, বর্ণনা দিচ্ছিলেন। নেশাদার শিকারি বাবা সব সময় আমাকে পাখি চেনাতেন, দেখাতেন, নাম বলতেন। পদ্মবিলে সেই দুপুরে ছিল কয়েক প্রজাতির বক, ডুবুরি বা ভিলভিলের ঝাঁক, জলপিপি, মেটেহাঁস, পানকৌড়ি, ডুংকর বা জলমুরগি, দুই প্রজাতির খেনি, একটিমাত্র সাপপাখিসহ অন্যান্য পাখি।

বিল কাঁপিয়ে হোগলাবনে ডাকছিল কোড়া পাখি। কিছু ডাহুক দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু কোড়া ও মেটেহাঁস বাদে ওই ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বাকিগুলোকে শিকারযোগ্য পাখি মনে করতেন না বন্দুক শিকারিরা। নলখাগড়ার ভেতর থেকে কালিমের উঁকিঝুঁকি দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু বাইরে আসছিল না।

পদ্মবনের সুন্দর পাখি দুটির নাম পদ্মপিপি। মেওয়া, জলময়ূর, নেও নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Pheasant-tailed jacana। বৈজ্ঞানিক নাম Hydrophasianus chirurgus। দৈর্ঘ্য ৩১ সেন্টিমিটার। প্রজনন মৌসুমে পুরুষের সুন্দর লম্বা লেজটির দৈর্ঘ্য শরীরের দৈর্ঘ্যের প্রায় সমান, ২৭-৩১ সেন্টিমিটার। এই লেজ এগুলোর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। লেজটিকে লাগে উল্টো তরবারির মতো। ওটাকে ওগুলো দোলাতে পারে শৈল্পিক ভঙ্গিতে। জলময়ূরের শরীরের ওজন ১৩৫ থেকে ১৪৫ গ্রাম।

সুদর্শন জলাভূমির জলময়ূরের বা পদ্মপিপির (মূলত পদ্মবন ঘিরেই এগুলোর জীবন আবর্তিত) কপাল-গলা-বুকের উপরিভাগের একটু জায়গায় ও চোখের চারপাশটা কার্পাস তুলা বা শরতের সাদা মেঘের মতো সাদা। মাথার পেছন দিকটুকু কালো বটে, পিঠের প্রান্ত পর্যন্ত টকটকে হলুদ। চোখের মণি খোসা ছাড়ানো বঁইচি ফলের মতো জ্বলজ্বলে কালচে বাদামি। ঠোঁট চকচকে নীলচে, পা ও পায়ের আঙুলের রংও চকচকে নীলচে। পায়ের আঙুল-নখ লিকলিকে লম্বা, মনে হয় বড়সড় মাকড়সা একটা। এ রকম ছড়ানো আঙুলের জন্যই এগুলো ভাসমান জলজ উদ্ভিদের পাতার ওপরে পা ফেলে হাঁটতে পারে অনায়াসে, পাতা জলে ডোবে না।

পদ্মপিপি বা জলময়ূরের গলা-ঘাড়-চিবুক-মাথার রঙের আশ্চর্য সুন্দর কম্বিনেশন যেন করেছে কোনো ধ্রুপদি শিল্পী। দেখলে মুগ্ধ হতেই হয়। প্রকৃতি পাখিগুলোর শরীরে রং মেখেছে মনের মাধুরী মিশিয়ে। আর প্রজননের সময় জলময়ূরের ডানার ওপরের বড় এক ছোপ সাদা রং, পিঠ-বুকের কালো রংও কি কোনো নিপুণ শিল্পীর চিত্রকর্ম না হয়ে পারে! আবার স্বাভাবিক সময়ে লম্বা-সুন্দর লেজটি থাকে না, পিঠের ওপরের কালো রংটা বদলে সবুজাভ বাদামি হয়ে যায়। বুক-পেটের তলাটা হয়ে যায় কাশফুলের মতো সাদা। এটাও প্রকৃতিশিল্পীর কারুকাজ।

মূল খাদ্য এগুলোর জলজ উদ্ভিদের কচি ডগা, পাতা, বীজ, কচি উদ্ভিদের শিকড়, অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের ডগা-পাতা, জলজ ছোট পোকামাকড়, টাকি–শোলের ছোট পোনা, খুদে শামুক ইত্যাদি। পদ্মফুলের ভেতরের ‘পদ্মটুনা’ এগুলোর অতি প্রিয় খাবার। শাপলা, শালুক, পদ্মপাতায় পা ফেলে ফেলে এগুলো খাবার খোঁজে। পানিফলের পাতাসহ শাপলা-পদ্মপাতা উল্টে উল্টে তলদেশে লেগে থাকা জলজ পোকা খায়। ভয় পেলে ‘নেও নেও’ বা ‘মেঘ হও মেঘ হও’ বলে কান্নার মতো করুণ স্বরে ডাকে।

বাসা তৈরির মৌসুম এগুলোর গ্রীষ্ম থেকে হেমন্ত। ভাসমান জলজ উদ্ভিদ, ভাসমান পানিফলগাছের স্তূপ, কচুরিপানার স্তূপে বাসা করে। কখনো কখনো স্রেফ বড় পাতার ওপরে ডিম পাড়ে। পদ্মপাতা থেকে ডিম গড়িয়ে জলে পড়ে না, কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া। পদ্মপাতার মঞ্চের নাচ ও ডিম আমি জীবনে বেশ কয়েকবার দেখেছি। বাল্য, কৈশোর ও তরুণবেলায় বর্ষা, শরৎ, হেমন্তে আমরা মাঠ-বিল-জলাশয় হয়ে মাছ ধরার চাঁই পাততে যেতাম, নাহয় তালের ডোঙায় চেপে যেতাম বড়শি বাইতে। মাঠ–ঘাটভরা টলটলে জল, সেই জলে মাথা উঁচিয়ে আমন ধানের খেত—খেতের পরে খেত। ওই বয়সে ডাহুক, পদ্মপিপি, জলপিপি, ডুবুরি, কোড়া পাখির ডিম পেলে বাড়িতে এনে ভেজে খেতাম, ছানা পেলে বাড়িতে এনে পোষার চেষ্টা করতাম। এখন বুঝি, প্রকৃতির সঙ্গে কী দারুণ অন্যায় করেছি আমরা!

জলময়ূরী ডিম পাড়ে চারটি। একেবারে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রেখার আশ্চর্য সুন্দর কারুকাজ ডিমের ওপরে। এখানে একটি মজার কথা বা তথ্য হলো, ডিম পেড়েই চম্পট দেয় স্ত্রী পাখিটি। জলময়ূরী দূরে গিয়ে অন্য কোনো জোড়া জুটিয়ে নিয়ে আবারও ডিম পাড়ে। প্রকৃতির এ এক গোপন-গূঢ় রহস্য। এদিকে পুরুষটি একাই ডিমে তা দিয়ে ২৩-২৫ দিনে ছানা ফোটায়। ছানাগুলোকে একাই লালনপালন করে, জীবনের জরুরি ট্রেনিংগুলো দেয়। এগুলোর ডিম-ছানার শত্রুদের মধ্যে আছে দাঁড়াশ সাপ, গুইসাপ, ভোঁদড়, চিল, বাজ, ইগল। ভয়ানক আকাশ–শত্রু হলো বাজ তুরমতি। এগুলো বিলের আকাশে হোভারিং করে, চলন্ত ছানা নজরে পড়লেই বোমারু বিমানের মতো ডাইভ দিয়ে ছানা তুলে নেয়। তবে বাবা পাখি কৌশলে ছানাগুলোকে দুই পাখার তলায় ঢেকে রাখে বিপদের গন্ধ পেলেই।

১৯৬৯ থেকে ২০২১ সাল। বাগেরহাট জেলায় আজ আর জলময়ূর দেখা যায় না। বহু জটিল কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করে কি একটি পাখি কোনো একটি এলাকায় টিকে থাকতে পারে? তবে দেশের বড় বড় বিল-হাওরে আজও দেখা মেলে এগুলোর। স্বাধীনতার পর থেকেই বন্দুকের টার্গেট হয়ে পড়ে জলময়ূর। গুলিতে যদি একখানা পা আহত হয় বা পা–খানা ভেঙে ঝুলে যায়, তাহলে কালিম ও জলপিপি পাখির মতো এগুলোও একখানা পা ঠোঁটে চেপে ধরে উড়ে পালিয়ে যায়। সুন্দর এই পাখিগুলো এখন পেশাদার জাল-ফাঁদ শিকারিদের হাতে ধরা পড়ে, বিক্রিও হয়ে যায়। এয়ারগানধারীরা শিকার করেন। আজও চুরি হয় ডিম-ছানা। মুরগির তায়ে ছানা কি আজকাল ফোটায় কোনো দুষ্টু বালক! বন্য প্রাণী আইনে এগুলো দণ্ডনীয় অপরাধ।