প্রাণিজগতে অশনিসংকেত

মারা গেছে প্রায় ৪০০ হাতি

আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানা হাতির নিরাপদ আবাস হিসেবে পরিচিত। আফ্রিকান হাতির এক-তৃতীয়াংশ বসবাস করে এ দেশে। সংখ্যার দিক থেকে এ দেশে হাতি আছে ১ লাখ ৩০ হাজার। একক দেশ হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হাতি এখানেই পাওয়া যায়। আইন করে হাতি শিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই হাতিরা এখানে তুলনামূলক নিরাপদ। তবে গত মে-জুন দেশটিতে একটি বিপর্যয় ঘটে। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একসঙ্গে প্রায় ৩৩০টি হাতি মারা যায়। এক এলাকায় একসঙ্গে এত হাতির মৃত্যু আগে কখনো দেখা যায়নি। হাতির গণমৃত্যু সব শ্রেণির মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। গবেষকদের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিষাক্ত সায়ানো ব্যাকটেরিয়াযুক্ত পানি পান করে হাতির মৃত্যু হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানিতে বিষাক্ত সায়ানো ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে।

গত মে ও জুনে পৃথিবীতে খবর ছড়িয়ে পড়ে, বতসোয়ানায় একের পর এক হাতি মারা যাচ্ছে কোনো দৃশ্যমান কারণ ছাড়াই। হাতির গায়ে শিকারির গুলি নেই। দৃশ্যমান কোনো আঘাত নেই। তখন হাতির মৃত্যুর নানা কারণ অনুমান করা হয়েছিল। শিকারিদের সন্দেহ করা হয়েছিল। বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে কি না, খতিয়ে দেখা হয়েছে। কিন্তু এ রকম কিছু পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় হাতি রক্ষাকারী দল প্রথম হাতির মৃত্যু নিয়ে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে। তারা একটা তিন ঘণ্টার বিমানযাত্রায় ১৬৯টি মৃত হাতি দেখতে পায়। হাতিগুলো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এত অল্প সময়ের ভ্রমণে এত মৃত হাতির দেখা পাওয়া আশঙ্কাজনক বলে মনে করে তারা।

জলাশয়ের পাশে মৃত হাতি
সিজিটিএন আফ্রিকা

বন দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, অতি ক্ষুদ্র (মাইক্রোস্কোপিক) শেওলা থেকে উৎপন্ন বিষক্রিয়ায় মারা গেছে এই বিপুল পরিমাণ হাতি। শেওলার মধ্যে বিষাক্ত সায়ানো ব্যাকটেরিয়া জন্মেছে, যেগুলো পানি পান করার সময় হাতির পেটে গেছে।

এত দিন বিষয়টি অজানা ছিল। গবেষকেরা চার মাসের গবেষণায় এটি খুঁজে পেয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জিম্বাবুয়ের একদল গবেষক চালিয়েছেন গবেষণাটি।

জুনে গবেষকেরা দেখতে পান, হাতিগুলোর দাঁত সংগ্রহ করা হয়নি। এর মানে হাতির মৃত্যুতে চোরাচালানিরা যুক্ত নেই। অন্যান্য কারণও সন্দেহের তালিকায় রেখেছিলেন তাঁরা। এমনকি অ্যানথ্রাক্স রোগটাকেও সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছিল।

হাতিগুলো মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে জলাধারের পাশে। এ থেকে গবেষকেরা সন্দেহ করেন, পানিতে বিষাক্ত কিছু রয়েছে। যা পান করে বিষক্রিয়ায় মারা গেছে হাতি।

হাতির মৃতদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জিম্বাবুয়ের বিশেষ গবেষণাগারে পাঠানো হয়। গবেষণায় পাওয়া ফলাফল নিয়ে বন কর্মকর্তারা একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। জানিয়েছেন, নতুন পরীক্ষণে পাওয়া গেছে, হাতিগুলো সায়ানো ব্যাকটেরিয়াযুক্ত পানি পান করার ফলে নিউরোটক্সিক ক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। ফলে এতসংখ্যক হাতির মৃত্যু হয়। পরে জুনের শেষে হাতির মৃত্যু হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এর কারণ, তত দিনে হাতিগুলো যে পুকুরগুলো থেকে পানি পান করেছে,  সেগুলো শুকিয়ে গেছে।

বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, এসব ঘটনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। বৃষ্টিপাত বেশি ঘটায় বিষাক্ত শেওলা জলাশয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা পানির উৎসগুলো পরীক্ষা করবে। যেন আগামী বছর বর্ষার সময়ে হাতির মৃত্যুঝুঁকি কমানো যায়।

এখনো অবশ্য অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। যেমন কেন শুধু হাতিরই মৃত্যু হলো? কেন ওই এলাকাতেই এটি ঘটেছে? এ বিষয়ে কিছু অনুমিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখনো অনুসন্ধান চলছে।

আগস্টে জিম্বাবুয়েতে ২৫টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। এগুলোর নমুনা গবেষণার জন্য যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়েছে। গবেষকেরা ধারণা করছেন, এ দুই ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক থাকতে পারে। হাতি প্রয়োজনে মাটি খুঁড়ে পানি পান করে। এর রয়েছে খুব সংবেদনশীল স্নায়ু। স্মৃতিশক্তিও প্রখর। এরা দূর থেকে কোথায় পানি রয়েছে বুঝতে পারে। মাটির নিচে পানি থাকলেও বুঝতে পারে। তবে পানি যদি বিষাক্ত হয়, হাতির জীবন হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।

ওকাভ্যাঙ্গো ডেল্টা জলভূমিতে মৃত হাতি
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

বতসোয়ানায় এমন পানি পান করতে গিয়ে হাতির গণমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পানির উৎসগুলোতে দল বেঁধে হাতি পানি পান করে। দীর্ঘ সময় হাতি গোসল করে এবং প্রচুর পানি পান করে। মরুভূমিপ্রবণ এলাকায় হাতির পানির উৎস সীমাবদ্ধ হওয়ায় হাতিদের পানি পান করা কষ্টসাধ্য হয়। পানির উৎসে বিষাক্ত সায়ানো ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। সায়ানো ব্যাকটেরিয়াযুক্ত পানি পান করায় হাতির স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করেছে। মৃত হাতির ৭০ শতাংশকে পানির উৎসের কাছে মৃত অবস্থায় দেখা গেছে।

গবেষকেরা এখন জানতে পেরেছেন, হাতিগুলো মারা গেছে বিষাক্ত সায়ানো ব্যাকটেরিয়ার কারণে। শেওলার মধ্যে বাস করা সায়ানো ব্যাকটেরিয়া পানি পান করার সময় হাতি গ্রহণ করেছে এবং বিষক্রিয়ায় মারা গেছে।

সায়ানো ব্যাকটেরিয়া নীল-সবুজ শেওলা হিসেবে পরিচিত। সারা পৃথিবীতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে শান্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন পানিতে। এর কিছু প্রজাতি বিষাক্ত হয়ে থাকে, যারা মানুষ ও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। প্রাকৃতিকভাবে পানিতে জন্মে। উপযুক্ত প্রতিবেশ পেলে বড় এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সায়ানো ব্যাকটেরিয়ায় বিষাক্ত পানিতে মানুষ গোসল করে কিংবা পান করে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত হলে যে লক্ষণ দেখা দিতে পারে, চামড়ায় ফুসকুড়ি, বমি, ডায়রিয়া, জ্বর, মাথাব্যথা ইত্যাদি উচ্চমাত্রার সায়ানো ব্যাকটেরিয়ার বিষক্রিয়ায় পাখি, মাছ ও অন্যান্য প্রাণী আক্রান্ত হতে পারে।

আগেই বলা হয়েছে, বতসোয়ানায় প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার হাতি আছে। একক দেশ হিসেবে পৃথিবীতে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। বতসোয়ানায় বার্ষিক প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আয় করে হাতি ট্যুরিজম থেকে। অনেক সময়ই হাতি মানুষের ফসল নষ্ট করে। মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। হাতি ও মানুষের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। স্থানীয় মানুষ মনে করে, কিছু হাতি শিকার করা হলে হাতি মানুষের বসতি অঞ্চল থেকে দূরে থাকবে। বতসোয়ানায় হাতি বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। হাতিকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা অনেকে বলেন। কিন্তু সেখানে হাতি শিকার আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অবশ্য এ বছরের শুরুতে সে দেশের সরকার সাতটি পারমিট বিক্রি করেছে। যে পারমিটের বিনিময়ে প্রতি পারমিটের বিপরীতে ১০টি হাতি শিকার করা যাবে নির্দিষ্ট এলাকায়।

গবেষকেরা বলছেন, হাতি শিকারের পারমিট বিক্রি করা ভুল পদক্ষেপ। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। দেশটিতে গত পাঁচ বছরে হাতির সংখ্যা বাড়েনি, একই রয়েছে।

বতসোয়ানার হাতিই শুধু নয়। বিশ্বজুড়ে হাতিসহ বহু প্রাণী গণমৃত্যুর শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ার পশ্চিম উপকূলে প্রায় ৪০০ পাইলট তিমি মারা গেছে। তিমিগুলো সমুদ্র উপকূলে বালুতে পথ হারিয়ে উঠে আসে। ধারণা করা হয়, তিমির এ বড় দলকে  পথ দেখাচ্ছিল এক দলপতি তিমি। সেই তিমি ভুল করে তিমির বড় দলটিকে সৈকতে নিয়ে আসে। বালুর ওপরে পানির অভাবে তিমিগুলো মারা যায়। মোট তিমি মারা গেছে ৩৮০টি। স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ৭০টিকে। এতগুলো তিমি একসঙ্গে মারা যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম। এর আগে সর্বোচ্চ ৩২০টি পাইলট তিমির একত্রে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল।

এর আগে ২০১৫ সালে কাজাখস্তানের একসঙ্গে ২ লাখ সাইগা এন্টিলোপের মৃত্যু ঘটেছিল, যেগুলো ব্যাকটেরিয়ার বিষক্রিয়ায় মারা যায়। পাস্টেরেলা মালটোসিডা নামক ব্যাকটেরিয়াকে এ গণমৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়।

হাতি স্থলচর প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাণী। এশিয়া ও আফ্রিকায় দুই প্রজাতির হাতি দেখা যায়। দুটি প্রজাতিই ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সময় গর্ভধারণ করে। প্রায় ২২ মাস গর্ভে থাকে হাতিশাবক। বুনো পরিবেশে ৫০ থেকে ৬০ বছর আয়ু পাওয়া একটি আফ্রিকান হাতি গড়ে চারটি শাবক প্রসব করে। হাতির সবচেয়ে বড় শত্রু শিকারিরা। হাতির শরীরের অংশ থেকে বিভিন্ন রকম বিলাসদ্রব্য তৈরি করা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ দ্রব্য নিষিদ্ধ। তবে অনেক দেশে এটির বড় বাজার রয়েছে। মানুষের লোভ হাতির টিকে থাকার জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি। মানুষ বাদে আর কোনো প্রাণী হাতি শিকার করে না। মাঝেমধ্যে দুর্বল বা আহত হাতিকে সিংহ শিকার করে। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। তাই মানুষের হাত থেকে হাতিকে বাঁচালেই টিকে থাকবে হাতি।

লেখক: স্বেচ্ছাসেবক, বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি     

সূত্র: বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ও দ্য গার্ডিয়ান

প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ২০২২