প্রাণীদের অজানা ১০

পৃথিবী প্রাণের এক অপূর্ব সমারোহ। আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য কোটি কোটি প্রাণের বাস। এদের আচার-আচরণ, জীবনযাত্রা, রূপ-বর্ণ, আকার-আকৃতি নানারকম, নানা ধরনের। ক্ষুদ্র এককোষী প্রাণী থেকে শুরু করে বিশালাকৃতির স্তন্যপায়ী প্রাণী—প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব জীবনধারা, খাদ্য সংগ্রহের পদ্ধতি, প্রজনন প্রক্রিয়া এবং পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন বা মানিয়ে নেওয়ার রীতি। বৈচিত্র্যই পৃথিবীর নানা ধরনের অজস্র প্রাণীকে এত রহস্যময় ও বিস্ময়কর করে তুলেছে। যেমন ধরুন, চিংড়ির হৃৎপিণ্ড থাকে মাথায়। জিরাফ শব্দ করতে পারে না; আবার একটি গাভী দুই লাখ গ্লাস পর্যন্ত দুধ দিতে পারে! চলুন, প্রাণীদের নিয়ে এরকম বিস্ময়কর ও অজানা কিছু তথ্য জানা যাক।

১ / ১০

চিংড়ির হৃৎপিণ্ড থাকে মাথায়!

চিংড়ি আসলে মাছ নয়, একধরনের জলজ অমেরুদণ্ডী প্রাণী। অর্থাৎ এদের দেহে কোনো মেরুদণ্ড নেই। চিংড়ি ক্রাস্টেশিয়া বর্গের আর্থোপোডা পর্বের অন্তর্ভুক্ত। মজার ব্যাপার হল, এদের হৃৎপিন্ড মাথায় অবস্থিত।

শ্রিম্প বা ছোট চিংড়ির শরীরের দুটো অংশ—মাথা ও লেজ। হৃদযন্ত্রটি অবস্থিত থোর‍্যাক্স অঞ্চলে, ঠিক মাথার ওপরে। মাথা ও থোর‍্যাক্স ঢাকা থাকে একটি এক্সোস্কেলিটন বা বহিঃকঙ্কাল কাঠামো দিয়ে। এগুলোর একটি উন্মুক্ত সংবহনব্যবস্থাও রয়েছে। অর্থাৎ তাদের কোনো ধমনী নেই এবং তাদের অঙ্গগুলোতে সরাসরি রক্ত প্রবাহিত হয়। চিংড়ির দেহ শক্ত খোলসে আবৃত থাকে। জীবদ্দশায় চিংড়ি বেশ কয়েকবার খোলস পরিবর্তন করে। আবার কিছু প্রজাতির চিংড়ি তীক্ষ্ণ শব্দ তৈরি করতে পারে।

২ / ১০

শামুক তিন বছর ধরে ঘুমাতে পারে

শামুক প্রচণ্ড ধীরগতির স্থলচর প্রাণী। সাধারণত স্যাঁতস্যাঁতে, ছায়াযুক্ত জায়গায় বাস করে। শামুকদের শরীর শক্ত খোলসে আবৃত থাকে। এই খোলস তাদের শরীরকে রক্ষা করে এবং আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।

শামুকদের একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো দীর্ঘ সময় ঘুমানো। শামুকের কোনো কোনো প্রজাতি একটানা তিন বছর পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকতে পারে। এই ঘুমকে জীববিদ্যার ভাষায় বলা হয় ‘হাইবারনেশন’। বাংলায় বলা হয় শীতনিদ্রা। এ কৌশলে সাধারণত শীতে বা বৈরী আবহাওয়া পরিস্থিতিতে শরীরে জমা চর্বি ও পুষ্টির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে বিভিন্ন প্রাণী।শামুকদের ক্ষেত্রে, হাইবারনেশন তাদেরকে শীতকালে ঠান্ডা থেকে বাঁচতে সাহায্য করে।  

৩ / ১০

হাতি লাফ দিতে পারে না

বৃহত্তম স্থলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী হাতি। প্রোবোসিডিয়ান বর্গের সদস্য। অনেক কিছু করতে পারলেও এরা শরীরের গঠনের জন্য লাফ দিতে পারে না।

ভারী দেহ নিয়ে লাফ দিতে অনেক বেশি শক্তি প্রয়োজন। একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ আফ্রিকান হাতির ওজন ৬ টন পর্যন্ত হতে পারে। এই ভারী ওজনের কারণেই হাতি লাফ দিতে পারে না। এ ছাড়া হাতির পায়ের পাতা সমতল ও চওড়া। লাফ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় স্পঞ্জ পেশী তাদের পায়ে নেই।

একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ আফ্রিকান হাতির উচ্চতা ১৩ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। শুঁড়ে থাকে ৪০ হাজারের বেশি পেশী। এই বিশাল দেহের জন্য শুধু নাতি নয়, একইরকম অনেক প্রাণী—যেমন গন্ডার, জলহস্তীও লাফ দিতে পারে না। এ ছাড়াও হাতির বিশাল কান দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো হাতির মস্তিষ্ক। হাতি সহজে কিছু ভোলে না।

৪ / ১০

শ্লথের খাবার হজম হতে দুই সপ্তাহ লাগে

শ্লথ এক প্রকার স্তন্যপায়ী বৃক্ষচারী জীব। এই শ্লথরা অনেক ধীরে নড়াচড়া ও চলাফেরা করে। সে জন্যই তাদের অমন নাম—শ্লথ বা অলস। এরা গাছে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটায় ঘুমিয়ে।শ্লথ নিরামিষভোজী, অর্থাৎ পাতা, ফল ও ফুল খায়। বিজ্ঞানীদের মতে শ্লথের ধীরগতির পেছনের একটা বড় কারণ হলোএদের খাদ্যাভাস। শ্লথের খাবার হজম হতে দুই সপ্তাহ সময় লাগে। 

৫ / ১০

গাভী সারাজীবনে প্রায় দুই লাখ গ্লাস দুধ দেয়!

গৃহপালিত প্রাণী বললেই গরুর ছবি ভেসে ওঠে আমাদের মনে। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, মাংস, চামড়াজাত পণ্য ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। কখনো ভেবেছেন, গরু—ঠিকভাবে বললে, গাভী—সারা জীবনে কতটুকু দুধ দেয়? কিছু জাতের গাভী সাধারণত প্রতিদিন ছয় থেকে সাত গ্যালন এবং বছরে ২ হাজার গ্যালনেরও বেশি দুধ উৎপাদন করে। একটি গাভী জীবদ্দশায় প্রায় ১১ হাজার গ্যালন দুধ দেয়, যা প্রায় ২ লাখ গ্লাসের সমান! গরুর দুধ মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য। এতে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন এ এবং ডি থাকে। গরুর দুধ দিয়ে দই, পনির, মাখন, এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবার তৈরি করা হয়। 

৬ / ১০

জিরাফের কোনো ভোকাল কর্ড নেই

জিরাফ সামাজিক ও নিরীহ প্রাণী। বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা প্রাণীও বটে। জিরাফ সাধারণত বাস করে আফ্রিকার তৃণভূমিময় সাভানা অঞ্চলে। একটি পুরুষ জিরাফ লম্বায় প্রায় ১৮ ফুট এবং স্ত্রী জিরাফ ১৪ ফুটের মতো হয়। এদের গায়ে আঁকাবাঁকা দাগ থাকে। তবে দুটি জিরাফের গায়ের দাগ কখনো একরকম হয় না। ঠিক মানবদেহের ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙুলের ছাপের মতো।

মজার ব্যাপার হলো, প্রাণীজগতে জিরাফই একমাত্র প্রাণী যে শব্দ করতে পারে না। গলায় শব্দ উৎপাদন হয় ভোকাল কর্ডের মাধ্যমে। জিরাফের গলা এত লম্বা হওয়ায় ওদের কোনো ভোকাল কর্ড নেই। শব্দ উৎপাদনে সক্ষম ভোকাল কর্ড নেই বলেই জিরাফ কোনো শব্দ করতে পারে না। 

৭ / ১০
Yathin Krishnappa

উটপাখির চোখ মস্তিষ্কের চেয়ে বড়

পাখিদের সবচেয়ে বড় প্রজাতি উটপাখি।এদের উচ্চতা প্রায় ৯ ফুট (২.৭ মিটার) এবং ওজন প্রায় ৩০০ পাউন্ড (১৩৬ কেজি) হতে পারে। উটপাখি উড়তে পারে না, তবে দৌড়ানোয় অত্যন্ত দক্ষ। উটপাখির চোখ তাদের শরীরের তুলনায় আকারে অনেক বড়। চোখের ব্যাস প্রায় ৫ ইঞ্চি (১২.৭ সেমি), যা আকারে একটি আপেল বা খেলার বলের সমান। অন্যদিকে, উটপাখির মস্তিষ্কের আকার প্রায় ২.৫ ইঞ্চি (৬.৩ সেমি)। অর্থাৎ মস্তিষ্কের চেয়ে এদের চোখ বড়। আর উটপাখির ডিমও বিশ্বের বৃহত্তম ডিম।

৮ / ১০

দিনে ১০ হাজারবার ঘুমায় যে পেঙ্গুইন

সত্যি, একধরনের পেঙ্গুইন দিনে ১০ হাজার বার ঘুমায়। চিনস্ট্র্যাপ নামের এই প্রজাতির পেঙ্গুইনদের প্রতিবার ঘুমের স্থায়িত্ব মাত্র চার সেকেন্ড। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এক বিশেষ কৌশল ব্যবহার করে চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইন প্রতিদিন গড়ে ১১ ঘণ্টা ঘুমায়। বিজ্ঞানীরা কৌশলটির নাম দিয়েছেন ‘মাইক্রোস্লিপস’ বা ‘মাইক্রোন্যাপস’। চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনেরা এক ঘণ্টায় ৬০০ বার ঘুমায়। যখন তাদের প্রজনন মৌসুম আসে, তখন তাদের ডিম ও বাচ্চার দিকে নজর থাকে শিকারিদের। এ সময় নিজেদের বাসস্থান, ডিম ও বাচ্চাদের শিকারীর হাত থেকে বাঁচাতে পালাক্রমে পাহারা দেয় মা ও বাবা পেঙ্গুইন। ফলে একটানা ঘুমাতে পারে না চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইনেরা। সে জন্য তারা এই কৌশল কাজে লাগায়। ঘুমের ফাঁকে ফাঁকে নজর রাখে বাসস্থান, ডিম ও বাচ্চাদের দিকে।

৯ / ১০

একটানা ১৭ বছর মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে সিকাডা

ইংরেজি নাম সিকাডা (Cicada), তবে বাংলায় অনেকে সিডকা পোকা বলেন। উচ্চিংড়ে বা ঘুর্ঘরে নামেও পরিচিত। এগুলো আসলে হেমিপ্টেরা পতঙ্গ বর্গের সাইকাডোইডি পর্বের অন্তর্গত। এরা নিজেদের উজ্জ্বল রং, স্বচ্ছ ডানা এবং অনন্য ডাক বা শব্দের জন্য পরিচিত। সিডকা পোকা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এদের ডাক ১০০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ তৈরি করতে পারে।

সিডকা পোকার ডিম সাধারণত গাছের ডালপালায় ও পাথরের ফাটলে থাকে। পরে মাটিতে পড়ে যায়। ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়। লার্ভাগুলো মাটিতে থাকে এবং গাছের শিকড় থেকে রস খেয়ে বেড়ে ওঠে। প্রাপ্তবয়স্ক সিডকা পোকা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত জীবিত থাকে। কিন্তু কিছু সিডকা পোকার জীবনচক্র অনেক দীর্ঘ হতে পারে। প্রজাতিভেদে এরা ১৩ থেকে ১৭ বছর পর মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে। প্রাপ্তবয়স্ক সিডকা পোকা প্রজননের পর মারা যায়।

১০ / ১০

কবুতর  গুনতে জানে!

ঠিক পড়েছেন, কবুতর অংক করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কবুতর সংখ্যা গণনা করতে পারে, জ্যামিতিক পরিকল্পনা করতে পারে, এমনকি সরল গাণিতিক সমস্যাও সমাধান করতে পারে। কবুতরদের সংখ্যা গণনার ক্ষমতা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কবুতর এক থেকে চার পর্যন্ত সংখ্যা গণনা করতে পারে। তারা এমনকি বিভিন্ন আকারের দলে কতগুলো কবুতর রয়েছে, তা গুনতে পারে। আগে শুধু বানরের অঙ্ক কষার কথা জানা ছিল। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কবুতরও পিছিয়ে নেই। শুধু তাই নয়, কবুতর একটি নির্দিষ্ট আকৃতির খাদ্য পেতে কীভাবে পথ খুঁজে বের করতে হয়, তাও জানে। তারা এমনকি একটি জটিল কোনো স্থান থেকে খাদ্য পেতে প্রয়োজনে পথ পরিবর্তনও করতে পারে। 

সূত্র: নেচার স্টাডি সোসাইটি, দ্য হিউম্যান লিগ, আইএফএল সায়েন্স, ব্রিটানিকা ডটকম, সিএনএন, এনপিআর, সেন্টিয়েন্টমিডিয়া, উইকিপিডিয়া