মেছো বিড়ালের নাম শুনেছেন কখনো? এটি মাঝারি আকারের বন্য বিড়াল। সাধারণত জলাভূমি ও নদীসংলগ্ন এলাকায় বাস করে। দেহ শক্তিশালী। মাথার অংশে ৬-৮টি গাঢ় রেখা কপাল বেয়ে ঘাড়ের নিচের দিকে চলে গেছে। মাথা গোলাকার ও কিছুটা চওড়া। এদের শরীর লম্বাটে ও মজবুত, দেহে ধূসরাভ সবুজ-বাদামি রঙের পশম থাকে। গায়ের রং ধূসর থেকে জলপাই-বাদামি। শরীরজুড়ে অসংখ্য গাঢ় ছোপ ছোপ কালো বা বাদামি দাগ দেখা যায়, যা শিকারের সময় ছদ্মবেশ হিসেবে কাজ করে। লেজসহ লম্বায় সাড়ে তিন ফুট। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের ওজন ৮-১৪ কেজি। স্ত্রী মেছো বিড়াল সামান্য ছোট হলেও ওজন প্রায় ৫-৯ কেজি। মাছ শিকারের জন্য পানিতে ডুব দেওয়ার সময় এরা কান ভাঁজ করে পানি প্রবেশে বাধা দেয়। এদের পায়ের পাতায় আংশিক জালিকা (Webbing) রয়েছে, যা পানিতে দক্ষতার সঙ্গে সাঁতার কাটতে সাহায্য করে।
মেছো বিড়ালের ইংরেজি নাম Fishing Cat। বৈজ্ঞানিক নাম Prionailurus viverrinus। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়ার নির্দিষ্ট অঞ্চলে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এদের প্রধান বিস্তৃতি সুন্দরবন, হাওর-বিল, নদী তীরবর্তী অঞ্চল এবং কিছু বনভূমিতে। জলাভূমি, ম্যানগ্রোভ বন, ধানক্ষেত সংলগ্ন বনভূমি, নদী ও বিলের আশপাশের গাছপালা ঘেরা অঞ্চল এদের আদর্শ আবাসস্থল।
বাংলাদেশের জলাভূমি অঞ্চলে একসময় প্রচুর মেছো বিড়াল দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে এদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। মূলত আবাসস্থল ধ্বংস, খাদ্য সংকট এবং মানুষের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের ফলে এই প্রাণী আজ হুমকির মুখে, আজ এদের অস্তিত্ব বিপন্ন।
বর্তমানে এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ জলাভূমি ধ্বংস, বন উজাড়, খাদ্য সংকট এবং মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। কৃষি সম্প্রসারণ ও নগরায়ণের ফলে এদের আবাসস্থল সংকুচিত হচ্ছে। ফলে এরা মানুষের বসতিতে ঢুকে পড়ে এবং ক্ষতির শিকার হয়। মেছো বিড়াল মূলত মাছ, ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী (যেমন ইঁদুর) ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে। শীতকালে জলাভূমি ও নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে এদের খাদ্য সংকট দেখা যায়। ফলে হাঁস-মুরগির খামারে প্রবেশ করে এবং অনেক সময় মানুষের হাতে মারা পড়ে। কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণার কারণে অনেক মানুষ মেছো বিড়ালকে বাঘ বা বাঘের বাচ্চা মনে করেও মেরে ফেলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ২৮৯টি দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটেছে মানুষ ও মেছো বিড়ালের মধ্যে। এসব ঘটনায় ৩৬৯টি মেছো বিড়ালের মধ্যে মারা গেছে ১৩০টি। বাকি ২২৪টি উদ্ধার করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি সপ্তাহে গড়ে একটি মানুষ-মেছো বিড়াল দ্বন্দ্বের ঘটনা ঘটে এবং প্রতি ১৫ দিনে একটি মেছো বিড়াল মারা যায়। এরকম দ্বন্দ্বের ৫টি হটস্পট রয়েছে। (ছবিতে দেখুন)
মেছো বিড়াল সংরক্ষণে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় বাসিন্দাদের এই প্রাণীটির পরিবেশগত ভূমিকা সম্পর্কে জানানো হলে মানুষ-মেছো বিড়াল দ্বন্দ্ব কমবে। বিশেষত গ্রাম ও জলাভূমি সংলগ্ন এলাকার মানুষকে বোঝাতে হবে যে মেছো বিড়াল প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেছো বিড়াল জলাভূমি এবং আশপাশের পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিকারি প্রাণী। এটি খাদ্যশৃঙ্খলে শীর্ষ স্তরের শিকারি প্রাণী। বিশেষ করে মাছ, উভচর ও ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখে। মেছো বিড়াল জলাশয়ের অসুস্থ মাছ শিকার করে যা অন্যান্য মাছসহ উভচর, সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর মধ্যে রোগের সংক্রমণ রোধ করে। এদের উপস্থিতি কোনো অঞ্চলের জলাভূমির স্বাস্থ্যকর অবস্থা নির্দেশ করে। মেছো বিড়াল অনেক সময় ক্ষেতের ইদুর ও সাপসহ ক্ষতিকর প্রাণী শিকার করে মানুষের উপকার করে।
তাই স্থানীয় সম্প্রদায়কে এই প্রাণীর প্রতি সংবেদনশীল করে তুলতে প্রচার, কর্মশালা এবং শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। গত ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ প্রথমবারের মতো সারা বাংলাদেশে বন বিভাগের উদ্যোগে ‘বিশ্ব মেছো বিড়াল দিবস ২০২৫’ পালিত হয়, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর প্রতিপাদ্য ছিল ‘জনগণ যদি হয় সচেতন, মেছো বিড়াল হবে সংরক্ষণ’।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জলাভূমি, বিল এবং নদীশাসন প্রকল্পের ফলে মেছো বিড়ালের আবাসস্থল ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত আবাসস্থল এবং জলাভূমিগুলো পুনরুদ্ধার করা গেলে মেছো বিড়াল লোকালয়ে কম আসবে। মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনে স্থানীয় জনগণ, প্রশাসন এবং গবেষকদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর সহব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা গেলে তারা এ প্রাণী সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পাবে। মেছো বিড়ালের আচরণ, খাদ্যাভ্যাস এবং প্রজনন সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা সংরক্ষণ কার্যক্রমের সফলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্র বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও সচেতনতার মাধ্যমে মানুষ-মেছো বিড়ালের দ্বন্দ্ব হ্রাস করা সম্ভব।