ছোট পাখি পানটুনি

বাগান থেকে বেরিয়ে ছোট জলা জমিটা পাড়ি দেয় দাঁড়াশ সাপটি। লম্বায় ফুট সাতেক তো হবেই। এ পারে ঘন বুনটের বাঁশবন ও ঘাসবন—মেশামেশি হয়ে আছে। খুবই সতর্ক সাপটি। শত্রুর তো কোনো অভাব নেই এটির। বেজি আছে ঘাসবন-বাঁশবন এলাকায়। বেজির নজরে পড়লে জীবন নিয়ে আর ফেরা হবে না। তবে সাপটির জানা আছে, দুপুরে বেজিগুলো মাটির গর্তে গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে। তাই এই ভরদুপুরে বেরিয়ে পড়া।

কাশ-ঘাসবনে পাখির বাসা পাওয়া যেতে পারে। ব্যাঙ-ঘাসফড়িং তো পাওয়া যাবেই। ইঁদুরও মিলে যেতে পারে। সাপটি ঘাসবনে ঢোকার আগমুহূর্তে দুটি পুঁচকে পাখি ‘টিক টিক’ ধাতব স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে এসে সাপটিকে বাধা দিতে চায়। পুঁচকেগুলোর কাণ্ড দেখে সাপটি বোধ হয় মনে মনে হেসে নেয়—বুঝে ফেলে ঘাসবনেই আছে পাখি দুটির বাসা। আহা রে! যদি পাওয়া যায় ডিম-ছানা! দুপুরের ভোজনটা তাহলে খাসা হবে। সাপটি ঢুকে পড়ে ঘাসবনে। এটির চলাচলকে ফলো করে পাখি দুটি বেজায় বিপৎসংকেত বাজিয়ে চলে। এবার ধমকধামক মারতে মারতে ফিঙে, শালিক, বুলবুলি পাখিগুলো এসে পুঁচকে পাখি দুটির সঙ্গে মিলে উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে সাপটিকে অনুসরণ করে চলল। খোলা জায়গা হলে আক্রমণে যেত।

ছোট পাখি পানটুনি

সাপটি পেয়ে যায় পুঁচকেগুলোর বাসার সন্ধান। প্রায় ছোট একটা ফুটবলের মতো বাসা বানিয়েছে ওগুলো ঘাসবনের কয়েকটি ঘাসদণ্ডকে অবলম্বন করে। মূল উপকরণ ঘাস, লতা ও শিকড়। সে বাসায় তিনটি তুলতুলে ছানা। নজরে পড়তেই সাপটি মাথা তুলে প্রায় চার ফুট উঁচু বাসাটির ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে তুলে নেয় একটি ছানা—পুঁচকে দুটি তো বাসায় ডাকাত পড়েছে দেখে মরিয়া আক্রমণ চালায়। আঁচড় ও ঠোকর মারে। সাপটি পাখির শোরগোলকে ভীষণ ভয় পায়। ভয় পায়, কারণ, পাখির ঘেরাও অভিযান দেখে বেজিরা চলে আসতে পারে। খাবার মুখে নিয়ে সে ঘাসবন থেকে বেরিয়ে ফিঙে-বুলবুলির গালাগাল ও আঁচড়-ঠোকর হজম করে নেমে পড়ে আবার জলা জমিটায়। পাখিগুলোর শোরগোলে বেজি আসে না বটে, তবে সাপখেকো খোঁপাবাজ (Crested serpet-eagle. এগুলোর মূল খাদ্যই হলো সাপ) হাজির হয় যমদূতের মতো। ডাইভ দিয়ে পাখিটা ডান পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে সাপটির ঘাড়ের নিচের অংশ। বাঁ পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে সাপের কোমরের ওপরটা। নখর-সাঁড়াশির প্রচণ্ড চাপে সাপটি যে কামড়াবে ইগলের পায়ে কিংবা শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে ধরবে ইগলের দুখানা পা, সে উপায়ও নেই। ইগলটি উড়ে গিয়ে দূরের মেঘশিরীষের গাছটাতে বসে।

এদিকে পুঁচকে দুটি বাসায় ফেরে। সব ঠিকঠাক আছে কি না, তা পরখ করে ‘টিক টিক’ ডাকতে ডাকতে বাকি ছানা দুটির জন্য খাবার আনতে যায়। পাখির শোক একেবারেই ক্ষণস্থায়ী।

ঘাস, কাশ, উলু, নলখাগড়া, হোগলাবন বা আখখেতের আখের আগা থেকে অ্যাক্রোব্যাটদের মতো মাটিতে নামতে পারা পুঁচকে পাখিটির নাম পানটুনি। সাধারণ বুনো টুনি নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Plain prinia. বৈজ্ঞানিক নাম Prinia inornata. দৈর্ঘ্য ১৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৭ গ্রাম। ডাক শুনে এগুলোর অবস্থান সঠিকভাবে নির্ণয় করা দুরূহ কাজ। উত্সস্থল খুঁজে পেতে গেলে বিভ্রান্ত হতে হয়। আত্মগোপনে খুবই পারদর্শী। দ্রুতবেগে দুলে দুলে ওড়ে। ডাকাডাকি চলতেই থাকে। পুঁচকে লেজটা দোলায় প্রায় সারাক্ষণ। পানের চাষ বেশি আছে যেসব অঞ্চলে, সেসব এলাকায় রাতের আশ্রয় এগুলো নেয় পানের বরজে। পানের বরজ এগুলোর অন্যতম খাদ্যস্থলও। মূল খাবার এগুলোর ছোট পোকামাকড়, ফুলের নির্যাস এবং সামনে পড়লে কেঁচো। বুক-পেট সাদা এগুলোর, মাথা ও পিঠ বাদামি, চোখের ওপর দিয়ে সাদাটে ছাইরঙা চমত্কার রেখা টানা। ওপরের ঠোঁট কালো, নিচের ঠোঁট হলুদ, পা হালকা গোলাপি। প্রজনন মৌসুমে এগুলোর রং কিছুটা বদলে যায়।

এই পাখিগুলোর বাসা বাঁধার ভরা মৌসুম হলো বর্ষাকাল। তবে গ্রীষ্ম, শরৎ ও হেমন্তেও বাসা দেখা যায়। ডিম পাড়ে দুই থেকে চারটি। দুটি পাখি পালা করে তা দেয় ডিমে। ডিম ফুটে ছানা হয় ১০-১৩ দিনে। ঢাকার শহরতলিসহ পানটুনির দেখা মিলবে সারা বাংলাদেশে। ধানখেতও এগুলোর প্রিয় চারণক্ষেত্র ও বাসা বাঁধার জায়গা।

লেখক: পাখিবিশারদ