বাংলাদেশে প্রথমবার চিংড়ির ভাইরাসের জিন বিন্যাস উন্মোচন

চিংড়ির ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও তিন প্রতিষ্ঠানের একদল গবেষকছবি: সংগৃহীত

চিংড়ির ক্ষতিকর হোয়াইট স্পট ভাইরাসের জিন বিন্যাস বা জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও তিন প্রতিষ্ঠানের একদল গবেষক। সেইসঙ্গে নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করেছেন এই গবেষক দল।

জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম রফিকুল ইসলাম, একই বিভাগের অধ্যাপক আদনান মান্নান, ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সের অধ্যাপক এস এম শরিফুজ্জামান ও শাহনেওয়াজ চৌধুরী। সহপ্রধান গবেষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুনায়েদ সিদ্দিকী এবং আইসিডিডিআর, বির বিজ্ঞানী এনায়েত হোসেন। গবেষণাগারে পরীক্ষণ এবং তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন রুবেল আহমেদ, কল্যাণ চাকমা, আশিকুর আলিম আকাশ এবং মোবারক হোসেন পারভেজ।

দেশের রপ্তানি আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস চিংড়ি খাত। এই চিংড়ির অন্যতম শত্রু হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাস। এই ভাইরাস আক্রমণের ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে চিংড়ি মারা যায়। এর সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক বা টিকা নেই। কারণ এই ভাইরাসের জিনোমের কোনো তথ্য জানা ছিল না দেশের বিজ্ঞানীদের। সম্প্রতি এই ভাইরাসের একটি নতুন ভ্যারিয়েন্ট দেখা গেছে। আর তা হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের জিনোম বিন্যাস উন্মোচনের মাধ্যমে নির্ণয় করেছেন এই গবেষক দল। কক্সবাজার ও সাতক্ষীরা জেলার হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করে তাঁরা আবিষ্কার করেছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টটি অন্যান্য দেশের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এর জিনের গঠন অনেকটা স্বতন্ত্র।

চিংড়ির হোয়াইট স্পট ভাইরাস
ছবি: সংগৃহীত

হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাস মূলত চিংড়ি মাছের সাদা বৃত্তাকার দাগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এটি প্রাণঘাতী ও ছোঁয়াচে ভাইরাস। কোনো পুকুরের একটি চিংড়িকে এই ভাইরাস আক্রমণ করলে এক সপ্তাহের মধ্যে সব চিংড়ি মারা যায়। এই ভাইরাস ক্রাস্টাশিয়ান পর্বের প্রাণী, যেমন চিংড়ি, লবস্টার ও কাঁকড়া জাতীয় প্রাণীকে আক্রমণ করে। তবে ভাইরাসটি অন্য কোনো পর্বের প্রাণীদের আক্রমণ করে না। কারণ ক্রাস্টাশিয়ান পর্বের প্রাণীর কোষে আনুষঙ্গিক প্রোটিন হিসাবে ‘রেব সেভেন’ নামে একধরনের রিসেপ্টর থাকে।

ভাইরাসটি এই রিসেপ্টরের সহায়তায় কোষে প্রবেশ করে। কোষে ঢুকেই চিংড়ির গুরুত্বপূর্ণ বিপাক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে সংখ্যা বৃদ্ধি করে, দুর্বল করে ফেলে চিংড়িকে। ভাইরাসের প্রতিষেধক বা টিকা তৈরির ক্ষেত্রে ভাইরাসের জিনোমের ধরন এবং চিংড়ি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। এই গবেষণা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাগদা চিংড়ি চাষ হয় কক্সবাজার ও সাতক্ষীরায়। এই দুই জেলায়ই সংক্রমণের হার ছিল সবচেয়ে বেশি। এটি মহামারি আকারেও রূপ নেয়। তাই এ গবেষণার জন্য কক্সবাজার ও সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্ভুক্ত সবগুলো উপজেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

কক্সবাজার ও সাতক্ষীরা থেকে চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৪ সালে কক্সবাজারের হ্যাচারিতে এই ভাইরাস প্রথমবার দেখা যায়। ১৯৯৮ সালে খুলনা অঞ্চলের ৯০ ভাগ চিংড়ি হ্যাচারিতে এ ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ মাইক্রোবায়োলজি ও মাইকোলজিতে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালে বছরে দেশের ২০ ভাগ চিংড়ি এই ভাইরাসের কারণে মারা যেত। ফলে রপ্তানিকৃত চিংড়ির পরিমাণ ২৬ হাজার টন থেকে নেমে যায় ১৮ হাজার টনে।

এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল, দেশে বিরাজমান হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের প্রকরণ ও জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের মাধ্যমে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ভিন্নতা শনাক্ত করা। তাহলে বোঝা যাবে, এ ভাইরাসের কোনো বিষাক্ত প্রোটিন বা জিন মাছের সংক্রমণ ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখে কি না। আরও জানা যাবে, এ ভাইরাসের উৎস কী এবং কীভাবে ছড়ায়। এই তথ্যগুলো ভবিষ্যতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিকল্পনায় ও প্রতিষেধক তৈরিতে মূল ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন গবেষকরা।

এর জিনোমের আকৃতি বৃত্তাকার হওয়ায় জিনোম সিকোয়েন্স করা দুরূহ বলে ভাবা হতো। আন্তর্জাতিকভাবে মাত্র ২০টি দেশে এর পরিপূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স রয়েছে।

বাংলাদেশে ১ হাজার ২৮০টি নতুন মিউটেশন বা জিনের ভিন্নতা পাওয়া গেছে। কক্সবাজার এবং সাতক্ষীরা অঞ্চলের ভাইরাসের জিনোমেও দেখা গেছে ব্যাপক পার্থক্য। ধারণা করা হচ্ছে, জিনের এই ভিন্নতার কারণ দেশের আবহাওয়া, পানির বৈশিষ্ট্য, লবণাক্ততা ও ভৌগলিক অবস্থান। সাতক্ষীররা তুলনায় কক্সবাজারে এই ভাইরাসের প্রকোপ বেশি। আবার শীতকালের তুলনায় বর্ষাকালে প্রকোপ বেশি থাকে। ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা গেছে, জুন থেকে জুলাই মাসে এর প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। ৩৫ ভাগ হ্যাচারিতেই এ ভাইরাস পাওয়া যায়।

এর জিনোমের আকৃতি বৃত্তাকার হওয়ায় জিনোম সিকোয়েন্স করা দুরূহ বলে ভাবা হতো। আন্তর্জাতিকভাবে মাত্র ২০টি দেশে এর পরিপূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স রয়েছে। এর কোনো টিকা বা প্রতিষেধক না থাকায় নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রায় অসম্ভব। জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের ফলে এমআরএনএভিত্তিক টিকা বা এ রকম কোনো প্রতিষেধকের কথা চিন্তা করা যেতে পারে এবার। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল ইনফরমেশন (এনসিবিআই) এবং আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজি থেকে এই জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য গৃহীত হয়েছে।