প্রতিকূল পরিবেশে টিকে যাওয়া কিছু প্রাণী

পৃথিবীর জীবজগতের ওপর মানুষের প্রভাব অনস্বীকার্য। আশপাশের পাখি ও চতুষ্পদ প্রাণীদের ওপর এ প্রভাব স্পষ্ট। অনেক প্রাণীই ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারপরেও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে আছে কিছু কিছু প্রাণী। তাদের খাবারের ধরনেও পরিবর্তন এনেছে। কিছু প্রাণী পরিবর্তন এনেছে তাদের আকার, আকৃতি কিংবা রঙে। এসব কিছু করেছে স্রেফ টিকে থাকার জন্য।

আবার অনেক প্রাণী নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে চলে যাচ্ছে। যেমন একধরনের শিকারি পাখি আছে। নাম পেরেগ্রাইন ফ্যালকন। এরা মানবজাতির হাত থেকে বাঁচতে বেছে নিয়েছে দূর্গম পর্বত। আবার মানুষ স্বাভাবিক পরিবেশে এমন কিছু প্রাণীকে জায়গা দিয়েছে, যাদের কারণে অন্যান্য অনেক প্রাণী বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

এই যে পরিবর্তন, এটা স্থায়ী। ফলে বন্যপ্রাণীগুলো সম্পূর্ণ বন্য পরিবেশ পাচ্ছে না। এ রকম পরিবেশ আর কখনো ফিরে পাওয়া সম্ভবও নয়। প্রতিনিয়ত বিশ্বের নানা প্রান্তে বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে এখন আর খুব বেশি জায়গা নেই, যেটা এখনো এসব প্রাণীর উপযোগী ও সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক রয়ে গেছে। গভীর সমুদ্রের তলদেশেও পৌঁছে গেছি আমরা। সেখানে রয়েছে নানা ধরনের জলজ প্রাণী ও মাইক্রোপ্লাস্টিক। অন্যদিকে অ্যান্টার্কটিকার বরফও গলতে শুরু করেছে।

এই প্রতিকূল পরিবেশে যেসব প্রাণী টিকে থাকতে শিখে গেছে, নিজেরাও পরিবর্তিত হয়েছে পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে, তেমন কিছু প্রাণীদের নিয়েই এ আলোচনা।

সামুদ্রিক গাভী ( সি-কাউ)

এক হাজার পাউন্ডের বেশি ওজন তাদের। সি-কাউগুলোকে শিকারের জন্য তেমন ভাবতেও হয় না। কিন্তু প্রতি বছর শীতে অনেক সি-কাউ কোল্ড স্ট্রেসের কারণে মারা যায়। যদিও এ মাছগুলো দেখতে অনেকটা সিল বা সিন্ধুঘোটকের মতো, কিন্তু সামুদ্রিক গাভীদের শরীরে চর্বির স্তর থাকে না। সাধারণত সামুদ্রিক প্রাণীদের দেহে এ ধরনের চর্বির স্তর থাকে। তাই তারা হিমশীতল ঠান্ডা পানিতেও অনায়াসে বাস করতে পারে। কিন্তু সামুদ্রিক গাভী এদিক থেকে অক্ষম। আবহাওয়া অতিরিক্ত ঠান্ডা থাকলে সি-কাউর মতো প্রাণীরা হাইপোথারমিয়ায় ভোগে। হাইপোথারমিয়া মানে শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া। ফলে এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় অনেকাংশেই। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শরীর উষ্ণ করতে না পারলে মারাও যায়।

সামুদ্রিক গাভী বা সি-কাউ

সৌভাগ্যবশত, সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ ফ্লোরিডার একটি অপ্রত্যাশিত জায়গায় ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে সি-কাউদের। এরা নিজেরা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইলেকট্রিসিটি তৈরি করতে পারে। ফলে কিছুটা উষ্ণ রাখতে পারে শরীর। ২০০৬ সালে জার্নাল অব মেরিন সায়েন্স-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্লোরিডা উপসাগরের তাপমাত্রা অনেক সময় ৬৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে নেমে যায়। তখন অন্তত ৬০ শতাংশ সি-কাউ মাত্র ১০টি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে নির্গত পানি প্রবাহের কাছাকাছি থাকে। পানি প্রবাহের কারণে এরা সহজেই শরীর উষ্ণ রাখতে পারে। ফলে বেঁচে যায় কোল্ড স্ট্রেস থেকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য এটি তাদের নতুন এক ধরনের আবিষ্কার।

ধলাকোমর শ্যামা

আমরা সবাই জানি, শব্দ দূষণ জীবজগতের জন্য হুমকি। তিমি মাছ কোনো কারণে তীরের কাছাকাছি চলে এলে এরা এক ধরনের শব্দ করে। ‘নেভি সোনার’ নামে একধরনের যন্ত্র দিয়ে এ শব্দ শনাক্ত করা যায়। এই শব্দকে জীববিজ্ঞানীরা বেসুরো বা কর্কশ শব্দ বলেন। এই অতিরিক্ত শব্দ জেব্রা ফিঞ্চ পাখিদের আয়ু কমিয়ে দেয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে অতিরিক্ত কোলাহল জীবজন্তুকে সুবিধাও দেয়।

২০১৯ সালে অরনিথলজিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন নামে একটি জার্নালে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, এশিয়ার স্থানীয় ছোট্ট পাখি ধলাকোমর শ্যামার বাচ্চা উৎপাদনের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ট্রাফিকের কাছাকাছি এলাকায়। অর্থাৎ, যেখানে শব্দ দূষণের পরিমাণ বেশি! এসব প্রাণী সাধারণত মানুষের কাছাকাছি আসে না সহজে। তবে গবেষকদের মতে, যেসব পাখি মানববসতির কাছাকাছি থাকে, সেগুলো সাধারণত কম হুমকিতে থাকে।

নরম খোলসযুক্ত কচ্ছপ

চীন এবং ভিয়েতনামে নরম খোলসযুক্ত কচ্ছপ দেখা যায়। এর মধ্যে অনেক কচ্ছপই প্রায় বিপন্ন প্রজাতির। কিন্তু তবু মানুষ এই কচ্ছপগুলোকে শিকার করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এই প্রজাতির কচ্ছপগুলোকে ১৮৫০ সালের দিকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে এসেছিলেন এশিয়ার কিছু মানুষ। তবে সেখানকার জলাভূমিতে ছিল রেপটাইল নামে একধরনের প্রাণী। এরা কচ্ছপগুলোকে খেয়ে ফেলতে শুরু করে। কিন্তু কচ্ছপগুলো নিজেদের এমনভাবে পরিবর্তন করেছিল যে এমন বিরূপ পরিস্থিতেও তারা বেঁচে যায়। ওই দ্বীপের সামুদ্রিক প্রাণীদের জরিপ করা হলে প্রথমেই থাকবে নরম খোলস যুক্ত এসব কচ্ছপ। কারণ তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে!

সাদা পায়ের ইঁদুর
wallpaperflare.com

সাদা পায়ের ইঁদুর

শুধু খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ খেয়েই বেঁচে থাকতে পারে ইঁদুর। শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটানোর মাধ্যমে তারা এমনটা করতে পারে। ২০১৭ সালে মলিকুলার ইকোলজি নামে একটি জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের সেন্ট্রাল পার্কে যেসব ইঁদুর রয়েছে, সেগুলোর বিপাকীয় জিন বদলে গেছে। ফলে এসব ইঁদুর স্নেহ, শর্করা, শস্যদানা বা ফল খেয়ে হজম করতে পারে। অর্থাৎ শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ খেয়ে জীবনধারণ করছে তারা। বিশেষজ্ঞরা এই ধারণার নাম দিয়েছেন ‘চিজ বার্গার হাইপোথিসিস’।

কিন্তু শহরে থাকা ইঁদুরগুলো আবার অন্যভাবেও অভিযোজিত হতে পারে। যেমন ২০২০ সালে জার্নাল অব ম্যামোলজিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব ইদুর যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার পিটাসবার্গে বাস করে, তাদের মাথার খুলি গ্রামবাসী ইঁদুরদের চেয়ে বড়। এজন্য শহরে বাসকারী ইঁদুররা অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, শুধু পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য ইঁদুররা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন করে এখনো টিকে আছে!

আফ্রিকান হাতি

আফ্রিকান হাতি

হাতি প্রাণী হিসেবে বিশাল। ৬ ফুট লম্বা দুটি দাঁত দিয়ে নানা ধরনের কাজ করে। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, মোজাম্বিকের গোরংগোছা ন্যাশনাল পার্কে থাকা আফ্রিকান হাতিগুলো কোনো ধরনের দাঁত ছাড়াই জন্ম নিচ্ছে। ২০২০ সালে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ওই হাতির ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হাতির দাঁত না থাকা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। এটি আসলে হাতির ওপর একধরনের অত্যাচারের ফল। কিছু অসাধু লোক হাতির দাঁত ভেঙে কালো বাজারে বিক্রি করে। এসব অসাধু লোকের এমন কর্মকাণ্ডের কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাতির দাঁত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আসলে হাতি এমন বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকার জন্যই শারীরবৃত্তীয় বা জিনগত কার্যক্রমে পরিবর্তন এনেছে। এটাই তাদেরকে শিকারির শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করে চলেছে!

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

সূত্র: জার্নাল অব মেরিন সায়েন্স, মলিকুলার ইকোলজি, সায়েন্স, অরনিথলজিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন