দুই সপ্তাহের তীব্র বিতর্কের পর দুবাইতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৮) প্রায় ২০০ দেশের কূটনীতিবিদ একটি সুস্পষ্ট চুক্তিতে পৌঁছেছেন। গত ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত চলা এবারের সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সিদ্ধান্ত হয়েছে, ন্যায্য, সুশৃঙ্খল ও ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতিতে দেশগুলো এ দশকেই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে আসার প্রক্রিয়া দ্রুততর করবে। শতাব্দীর মধ্যভাগের ভেতরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ পুরোপুরি বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তির পরিমাণ বাড়িয়ে তিনগুণ করতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। যথাসম্ভব কম সময়ের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় বেশি ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেন নিঃসরণ কমানোর জন্য সব দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে এই চুক্তি দেশগুলোকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে না। কোনো সময়কালও নির্দিষ্ট করা হয়নি।
শতাব্দীর মধ্যভাগের ভেতরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ পুরোপুরি বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তির পরিমাণ বাড়িয়ে তিনগুণ করতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে
সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বের শীর্ষ ১০ তেল উৎপাদনকারী দেশের একটি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানির প্রধান নির্বাহী সুলতান আল-জাবের এবারের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সুলতান আল-জাবেরকে সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে অবশ্য প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। আরব আমিরাতের এই রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানিটি এই দশকে উৎপাদন বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিবিসিতে ফাঁস হওয়া নথি থেকে জানা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত নতুন তেল ও গ্যাস চুক্তিতে বাধা দেওয়ার জন্য এই সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে তাঁকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেছে। তিনি অবশ্য বলেছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রতিষ্ঠান মাসদারের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি বায়ু ও সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির সম্প্রসারণ দেখাশোনা করছেন।
এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিশ্ব নেতারা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্মেলনে যাননি। তবে দুই দেশের শক্ত প্রতিনিধিত্ব ছিল। যুক্তরাজ্যের রাজা চার্লস সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছেন। সম্মেলনে প্রায় ১ লাখ রাজনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ, সাংবাদিক ও ভিজিটর (দর্শনার্থী) অংশ নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছিলেন। এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের মধ্যে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ।
ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি আছে, এমন কিছু ছোট দ্বীপরাষ্ট্রের নেতারা তাঁদের দাবি তুলে ধরেছেন। তাঁদের অস্তিত্বের প্রশ্নটিও সম্মেলনে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়েছে। এমন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যেন বিভিন্ন দেশের চাহিদা ও স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। মূল দাবি করেছেন ইউরোপীয় নেতারা এবং জলবায়ুর কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। তাঁরা চাপ দিয়েছেন, আহ্বান জানিয়েছেন যেন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সৌদি আরবের নেতৃত্বে প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো প্রতিবাদ করেছে। শেষপর্যন্ত মাঝামাঝি একটি অবস্থানে সবাই সম্মতি দিয়েছে। এতে দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর নেতারা খুশি হননি। তবে আপস করেছেন। অনেক নেতা বলেছেন, এই সম্মেলন থেকে ধারণা করা যায়, জীবাশ্ম জ্বালানির যুগ শেষ হয়ে আসছে। গত পাঁচ বছর আগেও এমন সিদ্ধান্ত কল্পনা করা যেত না।
ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি আছে, এমন কিছু ছোট দ্বীপরাষ্ট্রের নেতারা তাঁদের দাবি তুলে ধরেছেন। তাঁদের অস্তিত্বের প্রশ্নটিও সম্মেলনে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়েছে। এমন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যেন বিভিন্ন দেশের চাহিদা ও স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে
কিছু কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবারের সম্মেলনে। এসব সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রগুলো একমত হয়েছে। ক্লাইমেট ফান্ড বা জলবায়ু তহবিলে অর্থ থাকলেও বরাদ্দের নীতি খুব কঠিন ছিল। ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে উন্নত দেশগুলো প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার এই তহবিলে দেওয়ার কথা বলেছিল। তবে এই লক্ষ্য ২০২২ সালেও পূরণ হয়নি। এই তহবিল থেকে অর্থ পাওয়া এখন সহজ হবে। এবার তহবিল নিয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত হয়েছে, কারা কী পরিমাণ অর্থ তহবিলে জমা দেবে।
অনেকেই ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে ক্ষয়ক্ষতি কমানো, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াসহ স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়গুলো সমাধান করা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছে বর্তমানে। তাঁদের প্রয়োজন উঁচু অঞ্চলে নতুন বসতি ও আশ্রয়
আগের সম্মেলনগুলোয় যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, সেগুলো মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে ছিল বেশ দূরে। যেমন বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দূর করতে হবে। এটি একটি সামগ্রিক সিদ্ধান্ত। এখানে ব্যক্তির তেমন ভূমিকা নেই। তবে ব্যক্তি-মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলো এবারের সম্মেলনে উঠে এসেছে। যেমন প্লাস্টিক দূষণ, বায়ু দূষণ ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির বিষয়গুলো সামনে এসেছে। এগুলো প্রতিরোধের উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এ ছাড়াও এবারের সম্মেলনে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন অর্থনীতি, মানুষের জীবনযাত্রার মান ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর আগে এমন সফল হয়েছিল ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন। সে সম্মেলনের সূত্র ধরে বিভিন্ন দেশ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারও কমিয়ে এনেছিল এর ফলে। এবার কৃষিতে কীভাবে খাপ খাওয়ানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সামনে এসেছে পানি ব্যবস্থাপনা ও মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলোও।
সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজ চুক্তি হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে যে অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা হুমকির মুখে, তাদের বাসস্থান ও কৃষিজমি ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। অনেকেই ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে ক্ষয়ক্ষতি কমানো, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াসহ স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়গুলো সমাধান করা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছে বর্তমানে। তাঁদের প্রয়োজন উঁচু অঞ্চলে নতুন বসতি ও আশ্রয়। এসব মানুষের জন্য গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে সহায়তা পাওয়া সহজ হবে।
আরেকটি চুক্তি সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কে কতটা কমাল, সে বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করবে দেশগুলো। এতে জানা যাবে কতটুকু লক্ষমাত্রা ছিল, কতটা অর্জিত হয়েছে ইত্যাদি।
জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। এতদিন জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলতেন, ন্যায্যভাবে বাংলাদেশের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দর কষাকষি করতেন বিজ্ঞানী সালিমুল হক। সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন। বাংলাদেশ তাই এবারের সম্মেলনে তেমনভাবে আলোচনায় আসেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশকে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের সহায়তা পাওয়ার সমস্যাগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে এবং প্রাপ্ত তহবিলের সঠিক ব্যবহার করে দেখাতে হবে।
ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স বা বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ) জাতিসংঘ আয়োজিত একটি বৈশ্বিক সম্মেলন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হয় এতে। জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকেন। এবারে এর ২৮তম আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে।
লেখক: সহসম্পাদক, কিশোর আলো
সূত্র: বিবিসি, ইউএনএফসিসিসি ডটইন্ট/কপ২৮, নিউইয়র্ক টাইমস