সেচ পাম্পে বন্যা প্রতিরোধ

বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলই সমভূমি। আর এ দেশের জলবায়ু খুবই অস্থিতিশীল। এই দুইয়ে মিলিয়ে বড় সমস্যা তৈরি হয় কৃষকদের জন্য। শুষ্ক মৌসুমে ফসলে দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না বৃষ্টি থেকে, আর ভরা বর্ষায় বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব। এই দুটো সমস্যা থেকে বাঁচার বহুল পরিচিত সমাধান- বাঁধ নির্মাণ। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এর আরও ভালো সমাধান খুঁজে নিয়েছেন কৃষকরা। পাম্প ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে কৃষিকাজে দারুণ উন্নতি করেছেন তাঁরা। সম্প্রতি সায়েন্স-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে, এই সেচ প্রযুক্তি শুধু কৃষিকাজে উন্নতিতেই ভূমিকা রাখছে না, পাশাপাশি হয়েছে উঠেছে বন্যা প্রতিরোধী এক চমৎকার ব্যবস্থা!

সেচ প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে গত অর্ধ শতকে। এর হাত ধরে কৃষিজ ফলন বেড়েছে বহুগুন। বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে উৎপন্ন ধান বা ভাতের ৯০ শতাংশই উৎপাদিত হয় এশিয়ার কৃষকদের হাতে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির এরকম ঢালাও ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নেমে যাওয়ার কথা। পানির অভাব তৈরি হওয়া ও মাটির স্তর নেমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে এর ফলে। বিকল্প হিসেবে যদি বাঁধের কথা ভাবা হয়, তাহলে খুব একটা লাভ নেই। বাঁধ নির্মানের জন্য পর্বত ও উপত্যকা, অর্থাৎ উঁচুভূমি প্রয়োজন। যাতে বন্যা ঠেকানোর পাশাপাশি জলাধারে পানি সংরক্ষণ করে পরে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ এলাকাই সমতল প্লাবনভূমি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র কয়েক ফুট উঁচু এসব ভূমিতে বাঁধ তেমন কার্যকর নয়।

সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র

এ নিয়েই গবেষণা করেছেন ১৫ সেপ্টেম্বর সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত 'বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন: কোয়ান্টিফায়েড ফ্রেশওয়াটার ক্যাপচার ইন বাংলাদেশ' গবেষণাপত্রের গবেষকরা। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের (ইউসিএল) ইন্সটিটিউট ফর রিস্ক এন্ড ডিজ্যাস্টার রিডাকশন-এর ভূতত্ত্ববিদ মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ভূগোলবিদ ও গবেষক রিচার্ড জি টেইলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মো. ইজাজুল হক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সারা নওরিন, বাংলাদেশ ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের গবেষক আনওয়ার জাহিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ-এই ছয় গবেষক সারা বাংলাদেশে সেচ ব্যবস্থা মনিটরিংয়ের কাজে নিয়োজিত ৪৬৫টি সরকারি স্টেশন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বোঝার চেষ্টা করেছেন, সেচ পাম্প দিয়ে পানি ওঠানোর ফলে পানির স্তর আসলেই নিচে নেমে যাচ্ছে কি না। গেলে, কী হারে নেমে যাচ্ছে।

এ গবেষণার ফলাফল রাতারাতি চমকে দেওয়ার মতো। তাঁরা দেখেছেন, ১৯৮৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত গত ৩০ বছরে প্রায় ১৬ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৬০ লাখ কৃষক ছোট পরিসরে সেচ পাম্প ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে কৃষিকাজে ব্যবহার করেছেন। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে ভূগর্ভে ছোট ছোট গর্ত বা জলাধার তৈরি হয়েছে। এসব জলাধার ৭৫-৯০ ঘন কিলোমিটার আয়তনের পানি জমিয়ে রাখতে পারছে, যা তিনটি জর্জ বা হুভার বাঁধের সমতুল্য। এসব সেচ পাম্পের নাম তাঁরা দিয়েছেন 'বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন' বা 'বঙ্গীয় জলযন্ত্র'।

১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে প্রকাশিত সায়েন্স জার্নালের প্রচ্ছদ।

পুরো পদ্ধতিটা একটা চমৎকার ও টেকসই পানিচক্রের কাজ করে। এর পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে বাংলাদেশের নদীগুলোর। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র হিমালয় থেকে পলিমাটি বয়ে আনে। এই পলিমাটি জমা হয় নদীর তলদেশে। এভাবেই মূলত গড়ে উঠেছে বঙ্গীয় বদ্বীপ বা বেঙ্গল ডেল্টা, আর এসব পলিমাটিই বাংলাদেশের জমিগুলোকে উর্বর করে তুলেছে। এভাবে জমা হওয়া পলিমাটিতে অগণিত ছোট ছোট গর্ত তৈরি হতে পারে। ভারী বৃষ্টি হলে মাটি সেই পানি শুষে নেয়। বাংলাদেশের পলিমাটিতে তৈরি হওয়া গর্তগুলো তখন জলাধারের কাজ করে। ফলে বন্যার ভাসিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়, আবার অনেকটা পানি জমা হওয়ার ফলে শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা সেই পানি ব্যবহার করতে পারেন। শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজে পানি ব্যবহার করলে ভূগর্ভে আরও জায়গা তৈরি হয়। ফলে বর্ষায় আরও বেশি পানি শুষে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে মাটি। এভাবেই চক্রাকারে কাজ করে বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন বা বঙ্গীয় জলযন্ত্র।

গবেষণা দলের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মতিন আহমেদ বলেন, 'এ ধরনের কাজের জন্য স্থান নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেন মাটির স্তর বা মাটির নিচের পানির স্তর নিচে নেমে না যায় ও ব্যবস্থাটি কৃষকদের সর্বোচ্চ সহায়তা করে কৃষিকাজে।' তাঁর এ বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ঢাকার মতো যেসব অঞ্চলে মাটির ওপরাংশের বেশিরভাগটা জুড়ে রয়েছে কংক্রিটের আবরণ, সেসব জায়গা বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন হিসেবে কাজ করবে না ঠিকভাবে। কারণ, কংক্রিটের আবরণের বাধার ফলে মাটি বৃষ্টি বা বন্যার পানি যথেষ্ট পরিমাণে শুষে নিতে পারে না। তবে যথার্থভাবে স্থান নির্বাচন করে এ ধরনের সেচ প্রকল্প করা হলে তা একদিকে যেমন ভবিষ্যতে খাদ্য যোগানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তেমনি কার্যকর ভূমিকা রাখবে বন্যা নিয়ন্ত্রণে।