ইনসুলিন ও বিজ্ঞানী ব্যান্টিং

লিওনার্দো থম্পসন নামের ১৪ বছর বয়সী বালকের বেঁচে থাকার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন ওর বাবা-মা। এর আগে পর্যন্ত টাইপ–১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু–কিশোরদের কেউই মাস কয়েকের বেশি বাঁচেনি। টাইপ–১ ডায়াবেটিস হচ্ছে এমন একটা রোগ, যেখানে রোগীর অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উত্পাদনকারী বিটা কোষগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। সেই ১৮ শতকের শেষ থেকেই বিজ্ঞানীরা অগ্ন্যাশয়ের এই বিশেষ হরমোন ইনসুলিন সম্পর্কে জানতে আরম্ভ করেছেন। ইনসুলিন নামের এই হরমোন আমাদের দেহের শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, কুকুরের অগ্ন্যাশয় ফেলে দিলে তার শরীরের শর্করা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে, প্রস্রাবের সঙ্গে প্রচুর শর্করা বেরিয়ে যেতে থাকে, ক্রমেই রক্তের পিএইচ কমে গিয়ে মারা যায় কুকুরটি স্বল্প সময়ের মধ্যে। তারও আগে ভারতের প্রাচীন চিকিত্সক চরক সুশ্রুতা এই রোগের নাম দিয়েছেন বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস। এ রোগ হলে প্রস্রাবের পরিমাণ যায় বেড়ে আর সেই প্রস্রাবে পিঁপড়া জমে, এটা খেয়াল করেছেন তাঁরা। তো এত কিছু জানার পরও টাইপ–১ ডায়াবেটিসে শিশু–কিশোরদের অকালমৃত্যু ঠেকাতে কিছুই করা যাচ্ছিল না। কেননা প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় থেকে এই বিশেষ হরমোন ইনসুলিন বের করতে বারবারই ব্যর্থ হচ্ছিলেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, প্যানক্রিয়াসেরই আরেকটা এনজাইম ট্রিপসিন মুহূর্তের মধ্যে ইনসুলিনকে ভেঙে দেয়।

১৯২০ সালের দিকে কানাডিয়ান বিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং এই ইনসুলিন নিষ্কাশন নিয়ে আলাপ করলেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজির অধ্যাপক জে জে ম্যাক্লিওডের সঙ্গে। প্যানক্রিয়াসের নালিগুলোকে বেঁধে দিলে ট্রিপসিন নামের এনজাইম আর আসতে পারবে না, ফলে বিটা কোষের আইলেট অব ল্যাঙ্গারহ্যানস থেকে ইনসুলিন নিষ্কাশন সহজ হবে—এটাই ছিল ব্যান্টিংয়ের আইডিয়া। ম্যাক্লিওড তাঁর গবেষণাগারে এটা নিয়ে কাজ করার সুবিধা করে দিলেন ব্যান্টিংকে, সঙ্গে নিজের ছাত্র চার্লস বেস্টকেও জুড়ে দিলেন। কসাইখানায় গিয়ে কুকুর আর বাছুরের শরীরের প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নিষ্কাশন করতে শুরু করলেন তাঁরা দুজন। শুনতে সহজ শোনাচ্ছে, কিন্তু এ রকম একটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কত কত প্রাণীর প্যানক্রিয়াস যে নিতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। অবশেষে ১৯২২ সালে তাঁদের মনে হলো, যথেষ্ট পরিশোধিত ইনসুলিন নিষ্কাশন করা বোধ হয় সম্ভব হয়েছে। কুকুরের প্যানক্রিয়াস ফেলে দিয়ে কৃত্রিম ডায়াবেটিস তৈরি করে এই নিষ্কাশিত ইনসুলিন ইনজেকশন দিয়ে কুকুরগুলোকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু মানুষের ওপর কীভাবে এই এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব? কে দেবে করতে?

এই সময় এগিয়ে এলেন লিওনার্দো থম্পসনের বাবা। তিনি জানতেন তাঁর ছেলে এমনিতেই মারা যাচ্ছে। বারবার কোমায় চলে যাচ্ছে লিওনার্দো, শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা যদি ওকে নিয়ে কোনো এক্সপেরিমেন্ট করতে চান, তো করুন। ১৯২২ সালের ১১ জানুয়ারি সেই দিন। লিওনার্দোকে বিশ্বের প্রথম ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়া হলো। বাছুরের প্যানক্রিয়াস থেকে নেওয়া ইনসুলিনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল তাঁর। আমরা জানি যে ইনসুলিন একধরনের প্রোটিন হরমোন আর ভিন্ন দেহের প্রোটিন সব সময়ই প্রতিক্রিয়া বা রি–অ্যাকশন করবে। লিওনার্দো ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল এতে। তারপর একসময় তার শরীর এটা সয়েও নিল। আবারও ইনজেকশন দেওয়া হলো তাকে। এবার একটু সুস্থ বোধ করতে লাগল সে। আশ্চর্যের ব্যাপার, শর্করা কমে আসতে দেখা গেল তার রক্তে। ডায়াবেটিক কোমা থেকে ঘুরে দাঁড়াল সে। আর কিছুদিন পর থেকে স্বাস্থ্যও ভালো হতে শুরু করল। ইনসুলিন ইনজেকশন নেওয়া শুরু করার পর আরও ১৩ বছর বেঁচে ছিল লিওনার্দো।

ব্যান্টিংয়ের এই আবিষ্কার ছিল অভাবনীয়। লিওনার্দোর পর ব্যান্টিং আর বেস্ট দুই বন্ধু হাসপাতালের ওয়ার্ডে ডায়াবেটিক কোমায় মৃত্যুপথযাত্রী শিশু–কিশোরদের বেড থেকে বেডে ছুটে বেড়াচ্ছেন আর তাদের তৈরি ইনজেকশন পুশ করে চলেছেন। এই দৃশ্য দেখা যেত প্রায়ই। শেষ বেডটিতে পৌঁছানোর আগে দেখা যেত প্রথম বেডের অচেতন শিশুটি ততক্ষণে চোখ মেলে উঠে বসেছে! আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়তেন তাঁরা এই দৃশ্য দেখে। গবেষণাজগতে এত সাড়া ফেলেছিল এই আবিষ্কার, ঠিক পরের বছর, ১৯২৩ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন ব্যান্টিং আর ম্যাক্লিওড। পুরস্কারের ঘোষণা শুনে একটু আহতই হয়েছিলেন ব্যান্টিং, কেননা ম্যাক্লিওডের গবেষণাগারে তাঁরা কাজ করেছেন ঠিকই, কিন্তু প্রিয় বন্ধু ও সার্বক্ষণিক সহচর চার্লস বেস্টের নাম নেই এই পুরস্কারে। ব্যান্টিং ঘোষণা করলেন যে এই পুরস্কারের অর্থ তিনি ভাগাভাগি করবেন বেস্টের সঙ্গে, কেননা এই আবিষ্কারে বেস্টের ভূমিকা অনস্বীকার্য বলে মনে করেন তিনি। ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং নামের মানুষটিকে বুঝতে হবে এ ঘটনা দিয়েই। এবং আরও অনেক পূর্বাপর ইতিহাস দিয়ে যা আমাদের শেখাবে কীভাবে একই সঙ্গে একজন মহান বিজ্ঞানী একজন মহৎ মানুষও হয়ে থাকেন।

অথচ এই লোকটি চিকিত্সক হিসেবে কখনো বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। জীবনের শুরুতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন মিলিটারিতে, কিন্তু কম দৃষ্টিশক্তির জন্য নেওয়া হয়নি। পরে মেডিকেলের পড়া শেষ করার পর যুদ্ধের ময়দানে অনেক চিকিৎসকের প্রয়োজন হওয়ায় তাঁকে আর্মিতে নেওয়া হয়। ১৯১৮ সালে বিখ্যাত কেমব্রিজ যুদ্ধে মারাত্মক আহত হন তিনি। কিন্তু নিজে আহত হয়েও ১৬ ঘণ্টা ধরে অন্যান্য আহত সেনার সেবা করে যাচ্ছিলেন ব্যান্টিং। একসময় বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে সবাই মিলে তাঁকে জোর করে থামায়। এ জন্য মিলিটারি ক্রস পুরস্কারও দেওয়া হয় তাঁকে। যুদ্ধ থেকে ফিরে অর্থোপেডিক সার্জন হিসেবে কাজ শুরু করেন। সুবিধা না করতে পেরে পাড়ি জমান লন্ডনে, জেনারেল প্র্যাকটিস শুরু করেন সেখানে। সেখানেও ব্যর্থ। পেট চালাতে প্র্যাকটিসের পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় লেকচার দিয়ে বেড়াতেন, ফার্মাকোলজি থেকে নৃবিজ্ঞান—কী না পড়াতে হয়েছে! এই পড়াতে গিয়েই ইনসুলিন নিয়ে আগ্রহের জন্ম। অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যানক্রিয়াস বিষয়ে লেকচার দিতে ডাকা হয়েছিল তাঁকে, সে সময়ই এ বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। বিষয়টা খুবই ভাবিয়েছিল তাঁকে, নিত্যনতুন আইডিয়া খেলা করছিল মাথায়। শেষে জে ম্যাক্লিওডের সঙ্গে তাঁর সেই সাক্ষাৎ, গবেষণার অনুমতি, বেস্টকে বন্ধু ও সহচর হিসেবে পাওয়া। এরপরের ইতিহাস বিশ্ব চিরকৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছে।

ফ্রেডেরিক ব্যান্টিংয়ের ইনসুলিন আবিষ্কার সারা বিশ্বের কোটি কোটি ডায়াবেটিস রোগীর প্রাণ বাঁচিয়ে চলেছে সেই ১৯২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত। টাইম ম্যাগাজিন মানব ইতিহাসের ১০০টি সেরা আবিষ্কারের তালিকায় একে প্রথম দিকেই রেখেছে। কেবল নোবেল পুরস্কার নয়, নানা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন এই বিজ্ঞানী। ব্রিটিশরাজ তাঁকে নাইট উপাধি দেন ১৯৩৪ সালে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর নামে প্রতিষ্ঠা করে ব্যান্টিং অ্যান্ড বেস্ট ডিপার্টমেন্ট অব মেডিকেল রিসার্চ। ব্যান্টিং লেকচার চালু হয় তাঁর নামে। চাঁদে একটি গর্তের নাম দেওয়া হয়েছে ব্যান্টিংয়ের নামে। কানাডায় তাঁর বাড়িকে ঘোষণা করা হয়েছে হিস্টোরিক সাইট হিসেবে। আর তাঁর জন্মদিন ১৪ নভেম্বর সারা বিশ্বে একযোগে পালিত হয় বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে।

আশ্চর্য বৈপরীত্য ছিল ব্যান্টিংয়ের স্বভাবে। অর্থোপেডিক সার্জন হয়ে ডায়াবেটিসের প্রাণ রক্ষাকারী ওষুধ আবিষ্কার, আপাদমস্তক গবেষক ও চিকিত্সক হয়েও দুর্দান্ত সব চিত্রকর্মের স্রষ্টা (গ্রুপ অব সেভেন আর্টিস্টয়ের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি, তাঁর চিত্রকর্ম দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না যে এই লোকটি আদতে চিত্রশিল্পী নন, একজন বিজ্ঞানী) আর ইনসুলিন আবিষ্কারের অভাবনীয় সাফল্যের পর সব ছেড়েছুড়ে রয়্যাল কানাডিয়ান এয়ারফোর্সের এক গোপন ক্লিনিক্যাল ইনভেস্টিগেশন ইউনিটে যোগদান—একটার সঙ্গে অন্যটার কোনো মিল নেই। ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই কাজ করতে গিয়েই এক মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নভোচারীদের জন্য বিশেষ ধনের জি-স্যুট তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন!

কানাডার অন্টারিও রাজ্যে স্যার ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং স্কয়ারে এখনো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে ফ্লেম অব হোপ বা আশার শিখা। যেদিন ডায়াবেটিস নির্মূল করা যায় এমন চিকিত্সা আবিষ্কৃত হবে, কেবল সেদিনই নেভানো হবে এই শিখা। পৃথিবী এখন সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে আছে।

ইনসুলিন কী?

ইনসুলিন একটি অতি জরুরি হরমোন। আমাদের অগ্ন্যাশয় বা প্যানক্রিয়াসের বিটা কোষ থেকে তৈরি হয় এই হরমোন। এটা একটা পেপটাইড হরমোন। মানে একের পর এক অ্যামাইনো অ্যাসিড মিলে তৈরি হয় ইনসুলিন। একটা ইনসুলিন অণুতে ৫১টি অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে। দুটো চেইন বা শৃঙ্খলে সাজানো আছে ওগুলো। চেইন দুটো পরস্পর লাগানো রয়েছে একটা সি পেপটাইড দ্বারা। ইনসুলিনের এই গঠন সম্পর্কে বিশদ জানার পর ল্যাবরেটরিতে বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে এখন ইনসুলিন উত্পাদন সহজ হয়েছে। স্যার ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং ও চার্লস বেস্ট প্রাণীর প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নিষ্কাশন করে তা ব্যবহার করতেন। এতে মানবদেহে প্রায়ই তীব্র প্রতিক্রিয়া হতো। পরে ১৯৫৮ ফেডেরিক স্যাংগার ইনসুলিনের সিকোয়েন্স আবিষ্কার করে নোবেল পুরস্কার পান। এরপর থেকেই চেষ্টা শুরু হয় অ্যামাইনো অ্যাসিডের সিকোয়েন্স সাজিয়ে গবেষণাগারে ইনসুলিন তৈরির প্রচেষ্টা। ১৯৭৮ সালে প্রথম বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে হিউম্যান ইনসুলিন তৈরি করে জেনেনটেক নামের একটি ফার্ম। এলাই লিলি কোম্পানি প্রথম হিউম্যান ইনসুলিন বাজারজাত করতে এগিয়ে আসে। একই কোম্পানি বিশ্বে প্রথম ১৯৯৬ সালে অ্যামাইনো অ্যাসিডের সিকোয়েন্স পাল্টে দিয়ে ইনসুলিনকে আরও আধুনিক, জেনেটিক্যালি মডিফাইড পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন করে মার্কেটে আনে। নভো নরডিস্ক প্রথম ১৯৮৫ সালে পেন ডেলিভারি সিস্টেমে ব্যথামুক্ত ইনসুলিন নিয়ে আসে। আর মেডট্রোনিক ১৯৯২ সালে নিয়ে আসে ইনসুলিন পাম্প, যা দেহে সার্বক্ষণিক বহন করা যায় ও একটি কৃত্রিম প্যানক্রিয়াসের মতো কাজ করে। ইনসুলিন নিয়ে এখনো সারা বিশ্বে নানা ধরনের গবেষণা চলছে।

লেখক: চিকিৎসক ও সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজম, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল