হাত পরিষ্কার রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস। সাধারণত হাত নোংরা হলে আমরা হাত ধুই। এছাড়াও নানা কারণেই আমাদের হাত ধুতে হয়। অনেকে অভ্যাসের বশে কিছুক্ষণ পরপর হাত পরিষ্কার করে। শুধু ভালোভাবে হাত ধুয়েই কমপক্ষে ২০ ধরনের অসুস্থতা থেকে বাঁচা যায়। হাত ধোয়ার অভ্যাস রপ্ত করে আমরা মানব ইতিহাসের মহামারি কলেরা ও ডায়রিয়াকে বাগে এনেছি। তবে পৃথিবীতে করোনা সংক্রমণের পর থেকে হাত ধোয়া আমাদের জীবনের বাঁচা-মরার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ২০১৯ সালে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সারা পৃথিবীর মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছে, হাত ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করা কতটা জরুরি। বলা হচ্ছে, সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস করোনার ভ্যাকসিনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং সর্বস্তরের মানুষের জন্য বেশি কার্যকরী।
কিন্তু ঠিক কবে থেকে হাত ধোয়ার প্রচলন শুরু হলো? কার হাত ধরে আজকের মানবসভ্যতা হাত ধোয়ার মতো এই গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাসটা রপ্ত করল? এর পেছনের গল্পটাই বা কি?
সেই সময়ে একজন ব্যক্তি বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটিয়ে সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করছিলেন। তাঁর নাম ইগনাজ সেমেলউইস। তিনি ছিলেন একজন হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক। তিনিই প্রথম হাত ধোয়ার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন।
উনিশ শতকের গোড়ার কথা। তখন অসুস্থ কোনো ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়াটা ভালো চোখে দেখা হতো না। কারণ, তখনকার হাসপাতালগুলোই ছিল সংক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু। আর তখন শুধু খুব অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রীদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হতো। বাড়িতে রেখে চিকিৎসাকেই মানুষ সবচেয়ে নিরাপদ মনে করত। কারণ, বাসাবাড়ি থেকে হাসপাতালের চিকিৎসায় মৃত্যুর হার ছিল ৩-৫ গুণ বেশি। হাসপাতালের প্রস্রাব, বমি এবং শরীর থেকে নির্গত অন্যান্য তরল মিলে এমন এক উৎকট গন্ধ তৈরি করত যে কর্মীদের অনেক সময় নাকে কাপড় বা রুমাল বেধে চলাফেরা করতে হতো। চিকিৎসকদেরও তখন নিজেদের হাত কিংবা চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ধোয়ার ঘটনা ছিল বিরল। চিকিৎসকরা যেমন নোংরা ও অপরিষ্কার থাকতেন, অপারেশন থিয়েটারগুলোর অবস্থাও ছিল তেমনই অস্বাস্থ্যকর। ফলে হাসপাতালগুলোকে বলা হতো ‘মৃত্যু ঘর’।
তৎকালীন বিশ্বে জীবাণু সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা ছিল না। সেই সময়ে একজন ব্যক্তি বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটিয়ে সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করছিলেন। তাঁর নাম ইগনাজ সেমেলউইস। তিনি ছিলেন একজন হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক। তিনিই প্রথম হাত ধোয়ার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। উনিশ শতকে ভিয়েনায় যখন জীবাণু সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছিল না, তখন তিনি এই অবিস্মরণীয় আবিষ্কারটি করেন। সেমেলউইস বুঝেছিলেন, অপরিষ্কার হাত এবং যন্ত্রপাতিগুলোই সংক্রমণের প্রধান কারণ। কিন্তু তাঁর এই সঠিক চিন্তাধারা এবং হাত ধোয়ার পরামর্শ একসময় তাকে সমাজ থেকে একঘরে করে দেয় এবং উন্মাদ হিসেবে আখ্যায়িত করে।
হাসপাতালে প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুহার বেশি দেখে সেমেলউইস প্রথম হাত ধোঁয়ার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। অন্যদিকে, যেখানে ধাত্রীরা দায়িত্ব পালন করতেন, সেখানে মৃত্যু হার ছিল তুলনামূলক কম। এই বৈষম্য দেখে সেমেলউইস অনুসন্ধান করে দেখলেন, নবীন চিকিৎসকেরা অ্যানাটমি ক্লাসে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করার পরে সরাসরি প্রসূতি ওয়ার্ডে ঢুকে যাচ্ছেন এবং রোগীদের চিকিৎসা করছেন। মূলত এগুলোই ছিল সংক্রমণের মূল কারণ।
সেমেলউইস তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে বুঝতে পারেন, এই ধরনের সংক্রমণ প্রতিরোধে হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি। তিনি হাসপাতালের ডাক্তারদের ময়নাতদন্ত কক্ষ থেকে প্রসব কক্ষে যাওয়ার আগে ক্লোরিনযুক্ত চুনের দ্রবণ দিয়ে হাত ধুতে বাধ্য করেছিলেন। ফলে মাতৃমৃত্যুর হার কমে যায় নাটকীয়ভাবে। হাসপাতালের মাতৃমৃত্যুর হার ১৮ শতাংশ থেকে কমে ২ শতাংশে নেমে আসে। তারপর যখন চিকিৎসার যন্ত্রপাতিগুলো ধোয়া শুরু করেন, তখন মৃত্যুর হার নেমে আসে ১ শতাংশে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সেমেলউইসের এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে সমাদৃত হয়নি। অনেকেই তাঁর এই তত্ত্বকে উপেক্ষা করেন এবং তাকে পাগল বলে অভিহিত করেন। ভিয়েনা হাসপাতালের সঙ্গে তাঁর চুক্তি নবায়ন না হলে, তিনি নিজ দেশ হাঙ্গেরিতে ফিরে যান। সেখানে তিনি তার কাজ চালিয়ে গেলেও সহকর্মীদের কাছ থেকে একই ধরনের বিরোধিতার সম্মুখীন হন।
সেমেলউইসের মৃত্যুর পরে তাঁর অবদান ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পরই লুই পাস্তুর তাঁর বিখ্যাত জীবাণু তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে সেমেলউইসকে ‘আধুনিক ইনফেকশন কন্ট্রোলের জনক’ বলা হয়।
অবশেষে সেমেলউইস মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং তাকে একটি মানসিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেখানে তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়। এ কারণে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকেন সেমেলউইস। ১৮৬১ সালে তিনি তাঁর আবিষ্কারের ওপর একটা বই প্রকাশ করেন। কিন্তু এটি খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি একটি পাগলাগারদে ছিলেন। সেখানে প্রতিভাবান এই ডাক্তারকে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। নির্যাতনের ১৪ দিন পর তার হাতে একটা গ্যাংগ্রিন বা পচন দেখা যায়। সেই পচন থেকে সংক্রমণ শুরু হয়। যে সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার যুদ্ধে নিজের পুরো জীবনটাই তিনি ব্যয় করেছেন, সেই সংক্রমণেই মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
সেমেলউইসের মৃত্যুর পরে তাঁর অবদান ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পরই লুই পাস্তুর তাঁর বিখ্যাত জীবাণু তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে সেমেলউইসকে ‘আধুনিক ইনফেকশন কন্ট্রোলের জনক’ বলা হয়। তাঁর আবিষ্কার ও তত্ত্বের কারণে আমরা আজ হাত ধোয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন। তবে দুর্ভাগ্যবশত, সেমেলউইস জীবিত থাকাকালে তাঁকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয়নি।
বর্তমানে প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী ‘গ্লোবাল হ্যান্ড ওয়াশিং ডে’ পালন করা হয়। বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা তৈরি এবং জনগণকে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে রোগ প্রতিরোধ করার উদ্দেশে এ দিবসটি প্রতিবছর পালিত হয়। সবাইকে হাত ধোয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা ও হাত ধোয়ায় উদ্বুদ্ধ করাই এ দিবস পালনের লক্ষ্য। ২০০৮ সাল থেকে এই দিবস পালন করা হয়।