ছোটখাটো দেহের পেছনে বিজ্ঞানের কারিকুরি

অভিনেতা পিটার ডিংকলেজছবি: উইকিমিডিয়া

একজন সুশিক্ষকের পাঁচ ‘ব’-জাত গুণ থাকা নাকি অত্যাবশ্যক—বিদ্যা, বুদ্ধি, বাচন, বিনয় ও বপু। এর মধ্যে চারটি ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে, আর পঞ্চমটি অদৃষ্টের কৃপা। আমি বিদ্যার্জনে সুদূর মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমিয়েছি। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় মেতেছি গত দুই দশক। বাচনকে সুশ্রাব্য করার প্রয়াস ছিল বরাবরই। ছাত্রজীবনে বিতর্কের অনুশীলন, কণ্ঠের ওঠানামার চর্চা অবশেষে কাজে এসেছে। বিনয়টি স্বভাবজাত। আমি বিনয়ী, এমনটিই জানি; অন্তত লোকে তাই বলে। বিশেষভাবে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নিজের শিক্ষার্থীদের অভিমত আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। রইল বাকি এক—এই ‘বপু’র ‘ব’ নিয়েই যত বিড়ম্বনা।

আমার পরিবারে কেউ দীর্ঘকায় নয়। আমার কায়াও তাই দীর্ঘ হওয়ার কথা না। অগত্যা এই হ্রস্বদেহী (ছোটখাটো) আমার দীর্ঘদেহী মানুষের মার্কিন দেশেই নাকি অধ্যাপনা করতে হবে! অদৃষ্টের দোহাই দিই কিংবা আমার জেনেটিকসের, বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে ক্লাসে নতুন শিক্ষার্থীদের সমাগম ঘটে। তারা আমার নাম জানলেও পরিচয় হয় এই সময়টায়। আমি কিছুটা বিচলিত হই। দীর্ঘকায় স্বর্ণকেশী ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়ে আমার বপুর অপর্যাপ্ততা অনেক ক্ষেত্রেই একটি মানসিক ব্যবধান খাড়া করে। প্রশ্ন রাখি, দীর্ঘকায়ার জৈবিক কারণ কী? জিনের ভূমিকা আছে, তা মানি। তবে কোন সেলুলার বা কোষীয় প্রক্রিয়ায় দেহের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি ঘটে, তা জানার একটা কৌতুহল রয়ে যায়। এই এত দশক পর এর উত্তর খুঁজে পেলাম সিদ্ধার্থ মুখার্জির দ্য সং অব দ্য সেল গ্রন্থে। মানবদেহের যেকোনো অঙ্গ কিংবা টিস্যুর মতো হাড়ও জীবন্ত এবং নিয়ত পরিবর্তনশীল কোষের সমাহার। মানুষের হাড়ের বৃদ্ধি, মেরামত ও সংরক্ষণের পেছনের কারণ উন্মোচন করে দেখা যাক, হয়তো এতে আমার দুঃখ কিছুটা হলেও কমবে অবশেষে।    

জেনেটিক কারণে বয়ঃসন্ধিতে কারো কারো হাড়ের প্রান্তে, গ্রোথ প্লেটে অস্টিওকন্ড্রোরেটিকুলার স্টেম-কোষ বেশি জড়ো হয়, যা তরুণাস্থি তৈরির ইঙ্গিত পাঠাতে থাকে।

ভ্রূণ থেকে বেড়ে ওঠার সময় মানবশিশুর শরীরের কাঠামো গড়ে ওঠার প্রয়োজন পড়ে। তার দেহে অস্টিওকন্ড্রোরেটিকুলার স্টেম-কোষ নরম কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি তৈরি করে। এটা অস্টিওব্লাস্ট কোষের সহায়তায় অনমনীয় হাড় গঠন করে ক্যালসিয়াম ডিপোজিশন (জমা) প্রক্রিয়ায়। সেল নামে একটি বিখ্যাত জার্নালে ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে ড্যানিয়েল ওয়ার্থলি, সিদ্ধার্থ মুখার্জি ও তাঁদের সহগবেষকরা এ কথা বলেন। তাঁদের মতে, স্টেম-কোষের কার্যকারিতার জন্য প্রক্রিয়াটি নিজে নিজেই ঘটে। শৈশব থেকে যুবা বয়স পর্যন্ত এই স্টেম-কোষ হাড়ের টার্মিনাস বা প্রান্তে অবস্থান করে। তরুণাস্থি তৈরি এবং অস্টিওব্লাস্টের সহায়তায় হাড় নির্মাণ অব্যাহত থাকে। কায়ার দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে; কারণ এ স্টেম-কোষগুলো হাড়ের প্রান্তিক অংশে অবস্থান করে। এই বিশেষ স্টেম-কোষ যদি হাড়ের মাঝামাঝি থাকত, তাহলে হাড় দীর্ঘ না হয়ে পুরু হয়ে উঠত। প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষে মানুষে দৈর্ঘ্যের তারতম্যের কারণ কী? মানবদেহ একটা সময় পর আর দীর্ঘ হয় না কেন? দেহের হাড় পূর্ণাঙ্গতা পাওয়ার পর কি প্রাণহীন জড়ো কাঠামো হয়ে রয়ে যায়, নাকি এতে জীবনের গতিময়তা অবশিষ্ট থাকে? বয়ঃসন্ধিতে দুর্ঘটনা ঘটলে বা হাড়ে ফাটল তৈরি হলে তা দ্রুত সেরে যায়, অথচ বয়স্কদের ক্ষেত্রে এ নিরাময়ে সময় বেশি লাগে, কেন? এর কারণ কী? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর রোমাঞ্চকর। বিজ্ঞানীরা সেলুলার প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাড়ের বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের পেছনের কারণ খুঁজে চলেছেন। অস্টিওপোরোসিস, বাত, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ইত্যাদি রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করছেন তাঁরা।

জেনেটিক কারণে বয়ঃসন্ধিতে কারো কারো হাড়ের প্রান্তে, গ্রোথ প্লেটে অস্টিওকন্ড্রোরেটিকুলার স্টেম-কোষ বেশি জড়ো হয়, যা তরুণাস্থি তৈরির ইঙ্গিত পাঠাতে থাকে। বিজ্ঞানীরা এও ধারণা করছেন যে এসব স্টেম-কোষ হয়তো বেশি বছর অব্দি হাড়ের প্রান্তে অবস্থান করে এবং সহায়তা করে হাড়ের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধিতে (অর্থাৎ উচ্চতা বাড়াতে)। বয়ঃসন্ধির শেষদিকে এই স্টেম-কোষ গ্রোথ প্লেট ছেড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে কায়ার বৃদ্ধিও শ্লথ হয়ে পড়ে। এখানে বলে রাখা ভালো যে হাড়ের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়ার পরও হাড় কিন্তু স্থবির হয়ে যায় না। বরং অস্টিওক্লাস্ট নামে একধরনের কোষের উপস্থিতির জন্য হাড় ক্ষয় হতে থাকে। একদিকে অস্টিওক্লাস্ট হাড় ক্ষয় করে, অন্যদিকে অস্টিওব্লাস্ট তা মেরামত করে চলে।

বিজ্ঞানচিন্তার এ সংখ্যা কিনুন অথবা ৬ মাসের সাবস্ক্রিপশন নিন আজই। অর্ডার করতে ক্লিক করুন এই লিংকে। অথবা ফোন করুন ০১৭৩০০০০৬১৯-এই নম্বরে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, অস্টিওক্লাস্ট না থাকলেই তো তবে ভালো হতো। আসলে তা নয়। অস্টিওক্লাস্ট না থাকলে হাড়ে ক্যালসিয়াম জমতে জমতে এত পুরু হয়ে যেত যে এটা মেলোরিঅস্টিওসিস নামে একটি রোগের সূত্রপাত ঘটাতে পারত। অন্যদিকে পূর্ণবয়স্ক মানবদেহে কোনো দুর্ঘটনা থেকে হাড়ে ফাটল তৈরি হলে বা ভেঙে গেলে স্কেলেটাল স্টেম-কোষ অস্থি মেরামতের জন্য তরুণাস্থি তৈরির আয়োজনে লেগে পড়ে। এলিস জেফরি ও তাঁর সহগবেষকেরা ২০২২ সালে সেল স্টেম সেল নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত এক বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে এমনটাই দাবি করেছেন। তাঁরা বলছেন, বর্ষীয়ান ব্যক্তিদের হাড়ে এই স্টেম-কোষের উপস্থিতি কম থাকায় সম্ভবত ভাঙা হাড় জোড়া লাগতে বেশি সময় লাগে। হাড় তাই একটি নিয়ত পরিবর্তনশীল দেহাংশ, যা কোষীয় প্রক্রিয়ায় বৃদ্ধি পায় ও সংরক্ষিত হয়। 

ত্বকের রং, মুখমণ্ডলের আকার, দেহাংশের আকার পরিবর্তন যদি নীতিগতভাবে স্বীকৃত হতে পারে, তবে দেহের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধিতে বাধা কোথায়?

ষ্টেম-কোষ যদি হাড়ের বৃদ্ধির পেছনের কারণ হয়ে থাকে, তবে কি পূর্ণবয়স্ক মানবদেহের উচ্চতা বাড়ানো সম্ভব? সিদ্ধার্থ মুখার্জির বইয়ের এপিলগ বা পরিশেষ এমনটিই বলছে। লেখক বলছেন, আগামীতে স্টেম-কোষ ব্যবহারে কায়া দীর্ঘ করার চর্চা চালু হতেই পারে। ত্বকের রং, মুখমণ্ডলের আকার, দেহাংশের আকার পরিবর্তন যদি নীতিগতভাবে স্বীকৃত হতে পারে, তবে দেহের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধিতে বাধা কোথায়? স্টেম-কোষ গবেষণার কল্যাণে কয় দশক পরেই হয়তো কায়া দীর্ঘ করা সম্ভব হবে। আমার শিক্ষকতার কয়েক দশক পেরিয়ে যাবে তখন। এই অপর্যাপ্ত বপুর অভ্যস্থতাকে ডিঙিয়ে স্টেম-থেরাপি নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তখন জীবিত থাকবে বলে মনে হয় না। খেদ যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়, তখন তা অভ্যাসের নিত্যতায় ফিকে হয়ে আসে। আমার শিক্ষাজীবনের পাঁচ ‘ব’ প্রাপ্তির সাধনা তাই হয়তো দীর্ঘসূত্রিতাতেই গাঁথা রয়ে যাবে। 

লেখক: অধ্যাপক, পরিবেশ প্রকৌশল অনুষদ, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র

সূত্র: ১. Mukherjee, S. The Song of the Cell: An Exploration of Medicine and the New Human. 2022. Charles Scribner's Sons, New York, NY.

২. Worthley, D. L. et al. Gremlin 1 identifies a skeletal stem cell with bone, cartilage, and reticular stromal potential. 2015. Cell, 160, 269-284.

৩. Jeffery, E. C. et al. Bone marrow and periosteal skeletal stem/progenitor cells make distinct contributions to bone maintenance and repair. 2022. Cell Stem Cell, 29, 1547-1561.