মানবদেহ কী দিয়ে তৈরি?

মানবদেহ নানা রকমের প্রায় ৭ × ১০২৭টি পরমাণু দিয়ে গঠিত। আরও স্পষ্ট করে বললে, সংখ্যাটি ৭ বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন। আমাদের পরিচিত মোট ১১৮টি মৌল আছে। এর মধ্যে মানবদেহে রয়েছে প্রায় ৬০টি মৌলের উপস্থিতি। 

পরমাণুর সংখ্যা এবং মানবদেহের মোট ভরের কতটা কোন পরমাণু দিয়ে গঠিত, তার ওপর ভিত্তি করে উপাদানগুলোকে মোট তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রধান গাঠনিক উপাদান (ইংরেজিতে বলে, মেইন), মাধ্যমিক গাঠনিক উপাদান (সেকেন্ডারি) এবং অতি সামান্য গাঠনিক উপাদান (ট্রেস)।  

প্রধান গাঠনিক উপাদান বলতে বোঝায়, এ উপাদানগুলো মানবদেহে সবচেয়ে বেশি আছে। এই উপাদানগুলো মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। আর মানবদেহে যে উপাদানগুলো প্রধান উপাদানের চেয়ে কম কিন্তু পরিমাণে ঠিক অল্প নয়, সেগুলো মাধ্যমিক গাঠনিক উপাদান। অতি সামান্য উপাদানগুলো আসলেই মানবদেহে অতি সামান্য পরিমাণে থাকে। এর সবগুলো আবার মানবদেহের ক্রিয়াকলাপের জন্য কাজেও লাগে না। এবার চলুন, উপাদানগুলো সম্পর্কে জানা যাক। 

মানবদেহের প্রধান উপাদান চারটি। অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, কার্বন ও নাইট্রোজেন। আমাদের দেহের ৬০ শতাংশই পানি দিয়ে গঠিত। আর পানি গঠিত হয় দুটি অক্সিজেন ও একটি হাইড্রোজেন পরমাণু দিয়ে। সুতরাং মানবদেহে যে প্রচুর হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন থাকবে, তা বোধ হয় বুদ্ধিমান পাঠককে আবার বলার প্রয়োজন নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকে অক্সিজেন। আর হাইড্রোজেনের অবস্থান তালিকার তৃতীয়তে। একটি পানির অণুতে দুটি হাইড্রোজেন থাকা সত্ত্বেও কেন হাইড্রোজেনের চেয়ে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি?

একজন মানুষের মোট ভরের বেশিরভাগই অক্সিজেন।

আসলে হাইড্রোজেনের তুলনায় অক্সিজেন অনেক বেশি ভারী। অক্সিজেনের ভর প্রায় ২.৬ × ১০-২৩গ্রাম। একজন মানুষের মোট ভরের বেশিরভাগই অক্সিজেন। 

ধরুন, একজন মানুষের ভর ৭০ কেজি। তাহলে তাঁর শরীরে শুধু অক্সিজেনই আছে ৪৩ কেজি। যা তাঁর শরীরের মোট ভরের ৬৫ শতাংশ। অন্যাদিকে তাঁর শরীরে হাইড্রোজেন থাকবে ৭ কেজি। যা ওই ব্যক্তির শরীরের মোট ভরের মাত্র ১০ শতাংশ। 

৭০ কেজি ভরের একজন মানুষের শরীরে হাইড্রোজেন থাকে ৭ কেজি

কিন্তু আপনি যদি ভরের হিসাব না করে কতটি পরমাণু আছে সে হিসেব করেন, তাহলে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে হাইড্রোজেন। একজন মানুষের শরীরের মোট পরমাণুর ৬২ শতাংশই হাইড্রোজেন। অন্যদিকে অক্সিজেন থাকে ২৪ শতাংশ।

মানবদেহে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৌল কার্বন। এটি জৈবযৌগের কেন্দ্রীয় উপাদান। শরীরের মোট উপাদানের ১৮ শতাংশ কার্বন। পৃথিবীতে যত জীব আছে, সব জীবের প্রাথমিক উপাদানও এটিই।

প্রাচুর্যের দিক দিয়ে চতুর্থ স্থানে আছে নাইট্রোজেন। এই উপাদানটি একজন মানুষের শরীরের মোট উপাদানের মাত্র ৩ শতাংশ। তবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় নাইট্রোজেনই। শ্বাস নেওয়ার সময় আমাদের শরীরে অক্সিজেনের সঙ্গে প্রতিবার নাইট্রোজেন প্রবেশ করে। গ্যাসীয় নাইট্রোজেন শরীরে তেমন কোনো কাজে আসে না। তবে এ উপাদানটি অ্যামিনো এসিড এবং নিউক্লিক এসিডের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। 

মানবদেহের মোট ওজনের ১ দশমিক ৫ শতাংশ এই ক্যালসিয়াম। তবে এর ৯৯ শতাংশই থাকে দাঁত ও হাড়ে।

মাধ্যমিক গাঠনিক উপাদান বা সেকেন্ডারি উপাদানের মধ্যে আছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফার, সোডিয়াম, ক্লোরিন এবং ম্যাগনেশিয়াম। আপনি হয়তো জানেন, মানুষের হাড়ে থাকে ক্যালসিয়াম। প্রাচুর্যের দিক থেকে পঞ্চম স্থানে আছে এ মৌলটি। মানবদেহের মোট ওজনের ১ দশমিক ৫ শতাংশ এই ক্যালসিয়াম। তবে এর ৯৯ শতাংশই থাকে দাঁত ও হাড়ে। এ উপাদানটি পেশিকে সঙ্কুচিত করতে এবং প্রোটিন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

এরপরেই আছে ফসফরাস। মানবেদেহের মোট ওজনের ১ শতাংশ এটির দখলে। এ মৌলটি ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি এটিপি (অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট) অণু এবং হাড়ে পাওয়া যায়। 

ফসফরাসের পরে আছে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম। শরীরের মোট ওজনের ০ দশমিক ৩৫ শতাংশ পটাশিয়াম এবং ০ দশমিক ১৫ শতাংশ সোডিয়াম। এ দুটি উপাদান মানবদেহের তরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। 

সালফার শরীরের মোট ওজনের ০ দশমিক ২৫ শতাংশ। এটি ভিটামিন এইচ বা বায়োটিন(বি৭) ও থায়ামিনের (বি১) মতো কাজ করে। 

সীসা, অ্যান্টিমনি, থ্যালিয়াম, থোরিয়াম, ইউরেনিয়াম ও রেডিয়াম—এই মৌলগুলোও মানবদেহে অতি সামান্য পরিমাণে থাকে। তবে এগুলো দেহের জন্য ক্ষতিকর। 

এ ছাড়া মানবদেহে আরও যে দুটি উপাদান মোটামুটি বেশি পরিমাণে থাকে, সেগুলো হলো ক্লোরিন ও ম্যাগনেশিয়াম। শরীরের মোট ওজনের ০ দশমিক ১৫ শতাংশ ক্লোরিন। আর ০ দশমিক ০০৫ শতাংশ ম্যাগনেশিয়াম। হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড আকারে ক্লোরিন মানুষের পেটে পাওয়া যায়। এটি শরীরের পানি ও লবণের ভারসাম্য রক্ষা করে। এ ছাড়া এটিপিকে এডিপিতে রূপান্তরের সময় কাজ করে অনুঘটক হিসেবে। অন্যদিকে ম্যাগনেশিয়াম মানুষের বিপাকে সাহায্য করে। পাশাপাশি কাজ করে হাড় ও দাঁতের সুরক্ষায়। 

এ ছাড়াও মানবদেহে আরও ৪৯টি উপাদান অতি সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে, এসব উপাদানের সবগুলো দেহের কাজে না লাগলেও কোনো ক্ষতি করে না। যেমন অ্যালুমিনিয়াম, টাইটেনিয়াম, সিজিয়াম ও রূপা দেহের উপকার বা ক্ষতি কিছুই করে না। আবার অতি সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়, এমন উপাদানের মধ্যে কিছু মানবদেহের জন্য উপকারী। যেমন আয়রন বা লোহা, দস্তা, তামা, আয়োডিন, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, লিথিয়াম, মলিবডেনাম এবং কোবাল্ট। এর মধ্যে লোহা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি হিমোগ্লোবিন আকারে লোহিত রক্তকণিকায় অক্সিজেন পরিবহনে ভূমিকা রাখে। জিংক ও তামা নির্দিষ্ট প্রোটিনে পাওয়া যায়। আবার সিলিকন, বোরন, নিকেল এবং ভ্যানেডিয়ামের মতো কিছু উপাদান মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। এগুলো শরীরে খুব অল্প পরিমাণে থাকে। কিন্তু এগুলো শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। 

সীসা, অ্যান্টিমনি, থ্যালিয়াম, থোরিয়াম, ইউরেনিয়াম ও রেডিয়াম—এই মৌলগুলোও মানবদেহে অতি সামান্য পরিমাণে থাকে। তবে এগুলো দেহের জন্য ক্ষতিকর। 

লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, কাজী আকাশ 

সূত্র: সায়েন্স এবিসি ডট কম