গভীরভাবে একবার শ্বাস নিন। বেশ বেশ! নিশ্চয়ই ভাবছেন, এই মুহূর্তে বুক ভরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন টেনে নিলেন। আরও ভালোভাবে বললে, ফুসফুস ভরে। কিন্তু আপনার ধারণাটা আংশিক সত্য, পুরোপুরি নয়। ভাবছেন কেন?
আসলে শুধু অক্সিজেন নয়, শ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে যা ঢুকেছে, তার সিংহভাগই নাইট্রোজেন। কারণটা আপনার অজানা নয়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৮০ ভাগই ওই গ্যাসে ভরা, বাকি প্রায় ২০ ভাগ অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাস। আমাদের টিকে থাকার জন্য অক্সিজেনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু নাইট্রোজেনের গুরুত্বও ফেলনা নয়।
এই গ্যাসের প্রধান ধর্ম হলো, এটি অন্যান্য মৌলের সঙ্গে কোনো বিক্রিয়া করে না বললেই চলে। শ্বাস নেওয়ার সময় আশপাশের বাতাস থেকে নাইট্রোজেন আপনার ফুসফুসে ঢুকে যায়। আবার কোনো ক্রিয়া-বিক্রিয়া না করে যেমন ছিল, তেমনি প্রশ্বাসের সঙ্গে তা সোজা বেরিয়েও আসে। যেনো মনভুলো কোনো পথচারী হাঁটতে হাঁটতে হুট করে ঢুকে গেছে ভুল ঠিকানায়। তাই কিছু ঘটার আগেই সেখান থেকে মানে মানে কেটে পড়ে পরক্ষণেই।
আমাদের জন্য নাইট্রোজেন বেশ দরকারী। কিন্তু সেটা রূপান্তরিত রূপে। যেমন অ্যামোনিয়া, যার রাসায়নিক সংকেত NH3। তার কারণ মানবদেহ সরাসরি নাইট্রোজেন ব্যবহার করতে পারে না। তাই গ্যাসটা রূপান্তরের প্রয়োজন। তবে মানুষের পক্ষে নাইট্রোজেনকে অ্যামোনিয়ায় রূপান্তর করা সম্ভব নয়। সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে ব্যাকটেরিয়া। তাদের সহযোগিতা ছাড়া পৃথিবীতে আমাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। কাজেই সময় থাকতেই এক্ষুণি অণুজীবদের একটা ধন্যবাদ জানিয়ে রাখুন।
আসলে নিজের দেহটাকে আপনি যতই নিজের বলুন না কেন, পুরোটা আপনার নয়। আপনার দেহটা আসলে কোটি কোটি অতিক্ষুদ্র জীব বা অণুজীবের বাড়িঘর। তাদের চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি। এই ভিটেমাটিতে বাস করে কিছু অণুজীব মানুষের ক্ষতি করে ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগ উপকারই করে। যেমন ধরুন, খাবার-দাবার হজম করার কথা। আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাই, তার বেশ কিছু আমাদের পক্ষে হজম করা সম্ভব নয় অণুজীবদের সাহায্য ছাড়া।
মানুষ জন্মের সময় বাবা-মায়ের কাছ থেকে যেসব জিন পায়, আমৃত্যু সেগুলোই বহন করে। জীবদ্দশায় তার আর নতুন বা ভালো কোনো জিন দেহে সংযোজনের কোনো উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে ব্যাকটেরিয়া।
বিজ্ঞানীদের হিসেবে, খাবার থেকে আমরা যে ক্যালরি বা শক্তি পাই, তার অন্তত ১০ ভাগের জন্য এসব অণুজীবের কাছে ঋণী। কারণ এই ক্ষুদ্র জীব ছাড়া এসব খাবার আমাদের পক্ষে ভেঙে হজম করা সম্ভব হতো না। অণুজীবেরা বিশেষ প্রক্রিয়ায় খাবার থেকে ভিটামিন বি২ ও বি১২ ও ফলিক এসিডের মতো দরকারী পুষ্টি উপাদান বের করে আনে। আরও আছে। খাবার হজমের জন্য মানবদেহে তৈরি হয় মাত্র ২০টি এনজাইম। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে ১০ হাজার এনজাইম। মানে মানুষের চেয়ে ৫০০ গুণ বেশি। কাজেই এসব অণুজীব ছাড়া আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানে ঘাটতি থেকে যেত।
এসব অণুজীব অতিক্ষুদ্র। খালি চোখে দেখা যায় না। একদল ব্যাকটেরিয়ার (যাদের একত্রে বলা হয় ব্যাকটেরিয়াম) ওজন গড়ে এক গ্রামের এক লাখ কোটি (বা এক ট্রিলিয়ন) ভাগের এক ভাগ মাত্র। তাদের আয়ুও ক্ষণস্থায়ী, সর্বোচ্চ ২০ মিনিট। কিন্তু দলগতভাবে এরা দুর্দান্ত ও সত্যিই শক্তিশালী।
মানুষ জন্মের সময় বাবা-মায়ের কাছ থেকে যেসব জিন পায়, আমৃত্যু সেগুলোই বহন করে। জীবদ্দশায় তার আর নতুন বা ভালো কোনো জিন দেহে সংযোজনের কোনো উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে ব্যাকটেরিয়া। কারণ একটা ব্যাকটেরিয়া অন্য ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে জিন বিনিময় করতে পারে। আবার মৃত ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএও কুড়িয়ে নিজের দেহে নিতে পারে অন্য ব্যাকটেরিয়া। একে বলা হয় হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার। এই বিশেষ প্রক্রিয়া যেকোনো পরিবেশে নিজেদের খুব সহজে অভিযোজন করে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাকটেরিয়াদের। তাই শত শত বছর চেষ্টা করেও রোগ সৃষ্টিকারী অনেক ব্যাকটেরিয়াকে পৃথিবী থেকে এখনও একেবারে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।
আবার ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএতে মিউটেশনও ঘটে প্রায়ই। এটাই তাদেরকে জেনেটিকভাবে তৎপর করে তোলে। তাদের জিনগতভাবে এই পরিবর্তনের গতির সঙ্গে আমরা কোনোভাবেই প্রতিযোগিতা করতে পারব না। যেমন ধরা যাক, আমাদের অন্ত্র বা নাড়িভুড়িতে বসবাস করা ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়ার কথা। প্রতিদিন এই অণুজীব ৭২ বার নিজেদের বংশবৃদ্ধি করতে পারে। তার মানে মাত্র তিনদিনে এদের যে পরিমাণ নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়, তা গোটা মানব ইতিহাসের সমান। সে হিসেবে তাত্ত্বিকভাবে একটা মাতৃ-ব্যাকটেরিয়া মাত্র দুই দিনের কম সময়ে যে পরিমাণ বংশবৃদ্ধি করতে পারে, তার ওজন পৃথিবীর সমান। আর তিন দিনে তাদের বংশধরদের ওজন দাঁড়াবে গোটা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের সমান! অবিশ্বাস্য, তাই না? কিন্তু ভাগ্যিস, বাস্তবে সেটা কখনো ঘটে না।
তবু বর্তমানে পৃথিবীতে তাদের যে সংখ্যা রয়েছে, তা অকল্পনীয়। পৃথিবীর সব অণুজীবকে যদি একজায়গায় বা পাল্লায় জড়ো করা হয় এবং বাকি সব জীবজন্তুকে জড়ো করা হয় আরেক পাল্লায়, তাহলে কোন পাল্লা ভারী হবে? কল্পনা করতে পারবেন?
গবেষকেরা হিসেব কষে দেখেছেন, এই ৪০ হাজার প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৯০০ প্রজাতি রয়েছে আপনার নাকের ভেতর, প্রায় ৮০০-এর বেশি রয়েছে আপনার গালে, প্রায় ১ হাজার ৩০০টির বসবাস আপনার মুখের মাড়িতে আর প্রায় ৩৬ হাজার রয়েছে আপনার গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইন ট্র্যাক্টে (খাদ্যনালী থেকে শুরু করে পরিপাক তন্ত্রের সব কটি অঙ্গ)।
অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু এর উত্তর হলো অণুজীবের পাল্লা। তাও একটু-আধটু ভারী নয়, তা হবে প্রায় ২৫ গুণ বেশি ভারী। কাজেই এই গ্রহটাকে যদি অণুজীবের বলা হয়, তাতেও কিন্তু খুব বেশি ভুল হবে না। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীতে আমরা না থাকলেও ওদের হয়তো কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমাদের যায়-আসে। কারণ তাদের ছাড়া পৃথিবীতে আমাদের টিকে থাকাই হয়ে দাঁড়াবে মুশকিল। অণুজীবদের ছাড়া আমরা সবাই নির্ঘাত মারা পড়ব।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, অণুজীবদের সম্পর্কে আমরা এখনও খুব কমই জানি। তার একটা কারণ হলো, ল্যাবরেটরিতে এদের জন্মানো কঠিন। তাই তাদের নিয়ে গবেষণা করাও সহজ নয়। এই মুহূর্তে আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, নিজের সঙ্গে আপনি প্রায় ৪০ হাজার প্রজাতির অণুজীব বহন করেছেন। বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো!
গবেষকেরা হিসেব কষে দেখেছেন, এই ৪০ হাজার প্রজাতির মধ্যে প্রায় ৯০০ প্রজাতি রয়েছে আপনার নাকের ভেতর, প্রায় ৮০০-এর বেশি রয়েছে আপনার গালে, প্রায় ১ হাজার ৩০০টির বসবাস আপনার মুখের মাড়িতে আর প্রায় ৩৬ হাজার রয়েছে আপনার গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইন ট্র্যাক্টে (খাদ্যনালী থেকে শুরু করে পরিপাক তন্ত্রের সব কটি অঙ্গ)। অবশ্য এই সংখ্যা ইদানিং মাঝেমধ্যে বদলে যাচ্ছে। কারণ নতুন নতুন গবেষণার কারণে অণুজীবের এমন নতুন সব প্রজাতি আবিষ্কার হচ্ছে, যার কথা আগে কখনো শোনা যায়নি। যেমন ইংল্যান্ডের ওয়েলকাম স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউটে ২০ জন মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে ১০৫টি নতুন প্রজাতির গাট মাইক্রোব আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের কাছে এগুলো ছিল অপ্রত্যাশিত।
আবার এদের সংখ্যা কোনো মানুষের বয়স, দেহের আকার, সে কার সঙ্গে ঘুমায়, অ্যান্টিবায়োটিক খায় কি না, দেহে চর্বির পরিমাণ ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে কম-বেশি হতে পারে। যেমন মোটা কারো চেয়ে হালকা-পাতলা কারো অন্ত্রে অণুজীবের পরিমাণ বেশি থাকে। এ তো গেলে প্রজাতির সংখ্যা। কিন্তু সব মিলিয়ে এদের মোট সংখ্যা কত?
২০১৬ সালে আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের প্রত্যেকের শরীরে প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন মানব কোষ এবং প্রায় ৩০ থেকে ৫০ ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া আছে (সংখ্যাটা নির্ভর করে মানুষের স্বাস্থ্য ও খাদ্যাভ্যাসের ওপর)।
এদের সংখ্যা হয়তো আপনার কল্পনার বাইরে। হিসেব কষে দেখা গেছে, গড়পড়তা একজন মানুষের দেহে কয়েক ট্রিলিয়ন বা কয়েক লাখ কোটি অণুজীব থাকতে পারে। আর ওজন আন্দাজ করতে পারবেন? প্রায় ৩ পাউন্ড বা ১.৩ কেজি। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, আপনার মস্তিষ্কের ওজনও প্রায় ৩ পাউন্ড। সে কারণে কেউ কেউ আমাদের দেহের অণুজীবগুলোকে পোষা অণুজীব বলতে চান। কেউ কেউ আবার এককাঠি সরেস। তারা এসব অণুজীবের দলকে আমাদের দেহের একটা অঙ্গ বলতে শুরু করেছেন! হাত-পা কিংবা পাকস্থলীর মতো আপনার দেহের আরেকটা অঙ্গের নাম যদি ব্যাকটেরিয়া হয়, তাহলে কেমন হবে ব্যাপারটা!
যা-ই হোক, সাধারণভাবে বলা হয়, আমাদের দেহের কোষের তুলনায় প্রত্যেকের দেহে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ১০ গুণ। কিন্তু ধারণাটি সঠিক নয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ভুল ধারণা ছড়িয়েছিল ১৯৭২ সালে লেখা এক গবেষণাপত্র থেকে। সেটি ছিল অনেকাংশেই অনুমান ভিত্তিক। ২০১৬ সালে আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের প্রত্যেকের শরীরে প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন মানব কোষ এবং প্রায় ৩০ থেকে ৫০ ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া আছে (সংখ্যাটা নির্ভর করে মানুষের স্বাস্থ্য ও খাদ্যাভ্যাসের ওপর)। আবার জিনতাত্ত্বিকভাবে বিবেচনা করলে, আপনার দেহে প্রায় ২০ হাজার জিন আছে, কিন্তু ব্যাকটেরিয়াল জিন আছে প্রায় ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, আপনি আসলে ৯৯ ভাগ ব্যাকটেরিয়াল। কাজেই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে হেলাফেলা করার আগে একবার ভেবে দেখবেন। সেটা করতে গেলে যে নিজেকেই হেলাফেলা করা হয়!