নতুন রূপে অমিক্রন

করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে আবারও। চীনে এটির নতুন প্রকরণ মহামারি রূপ ধারণ করেছে। ভারতেও আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। এগুলো কোত্থেকে এল, এ নিয়ে আমাদের কতটা চিন্তিত হওয়া উচিত, এ রকম নানা প্রশ্নের জবাব...

কোভিড অতিমারি যেন শেষ হয়েও হচ্ছে না। সম্প্রতি এর অমিক্রন প্রকরণের একটি উপপ্রকরণ BF.7–সহ বেশ কিছু উপধরন আবার গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। এগুলো এল কোত্থেকে? যাবেই–বা কোথায়? আমরা কতটা চিন্তিত হতে পারি? এসব নিয়ে আজকের লেখা।

অমিক্রনের মিউটেশনগুলো বুঝতে হলে আগে জানতে হবে প্রকরণ বা ভেরিয়েন্ট মানে কী। জেনেটিক তথ্য অনুলিপি হওয়ার প্রক্রিয়াটি নিখুঁত নয়। মিউটেশন নামক ভুল সেখানে প্রায়ই ঘটে। ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির বেলায় সেই ভুলের হার আরও বেশি। কেননা একটি ভাইরাস পোষক কোষে ঢুকে লক্ষাধিক নতুন ভাইরাস-কণা বানাতে পারে, যেখানে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা প্রতি প্রজন্মে সর্বোচ্চ দ্বিগুণ হারে বাড়ে। যত বেশি কপি, তত বেশি ভুল। যাহোক, এসব মিউটেশনের মধ্যে বেশির ভাগ কোনো কাজের নয়। ভাইরাসের কোনো সুবিধা হয় না, অসুবিধাও হয় না। কিছু মিউটেশন ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। সেগুলো শনাক্ত করা খুব কঠিন, কেননা সেই মিউটেশনধারী ভাইরাস তার পরবর্তী প্রজন্ম রেখে যেতে পারে না। ফলে ছড়ায় না। আর অল্প কিছু মিউটেশন রয়েছে, যেগুলো ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাই সেগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে গিয়ে আমরা তা শনাক্ত করতে পারি। তাই বলা যায়, ভাইরাস বেছে বেছে অধিক সংক্রমণক্ষম মিউটেশন ঘটায় না; বরং র৵ানডমভাবে হতে থাকা মিউটেশনগুলোর মধ্যে যেগুলো বেশি হারে সংক্রমণ ঘটায়, সেগুলো বেশি বেশি পাওয়া যায়। সেই প্রকরণগুলো বেশি করে শনাক্ত হয়। এর নাম প্রাকৃতিক নির্বাচন। ভাইরাসের একেকটি প্রকরণ বা ভেরিয়েন্ট বলতে এখানে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট মিউটেশনবিশিষ্ট একেকটি প্যাকেজ বোঝানো হচ্ছে, যেটি প্রাকৃতিভাবে নির্বাচিত হয়েছে।

মিউটেশন বা পরিব্যক্তি বলতে বোঝায় জিনগত পরিবর্তন, যেটা বংশপরম্পরায় বাহিত হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন ঘটে র‍্যানডমভাবে। একেকটি প্রকরণে একাধিক মিউটেশন থাকতে পারে। অন্যভাবে বললে, ভাইরাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিবর্তিত হতে হতে তার জিনে যখন বেশ কিছু মিউটেশন জমা হয়, তখন সেটাকে নতুন একটা প্রকরণ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। আগের ধাপের প্রকরণের সাপেক্ষে ঠিক কতগুলো মিউটেশন যোগ হলে সেটাকে নতুন প্রকরণ বলব, তার অবশ্য কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। যদি একই রকম কয়েকটি মিউটেশন বেশ কিছু নমুনায় একইভাবে পাওয়া যায়, তাহলে সাধারণত নতুন প্রকরণের লেবেল সেঁটে দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, মিউটেশন হয় জিনে (করোনাভাইরাসের বেলায় আরএনএ), কিন্তু তার প্রভাবে প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিড পাল্টে যায়। স্পাইক প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিবর্তন থেকে সরাসরি তার ক্ষতিকর প্রভাব, ছড়ানোর হার এবং টিকার কার্যকারিতার ইঙ্গিত মেলে। তাই এখানে মিউটেশন নির্দেশ করার ক্ষেত্রে জিনের সংকেত পরিবর্তনের চেয়ে অ্যামিনো অ্যাসিডের পরিবর্তনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেভাবে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। এসব চিহ্নের অর্থ পাঠোদ্ধার করা খুব কঠিন নয়। এ জন্য আগে জানতে হবে, কোন বর্ণ দিয়ে কোন অ্যামিনো অ্যাসিড নির্দেশ করা হয়:

A: অ্যালানিন; R: আরজিনিন; N: অ্যাসপারাজিন; D: অ্যাসপারটেট; C: সিস্টিন; Q: গ্লুটামিন; E: গ্লুটামেট; G: গ্লাইসিন; H: হিস্টিডিন; I: আইসোলিউসিন; L: লিউসিন; K: লাইসিন; M: মিথায়োনিন; F: ফিনাইলঅ্যালানিন; P: প্রোলিন; S: সেরিন; T: থ্রিয়োনিন; W: ট্রিপটোফ্যান; Y: টাইরোসিন; V: ভ্যালিন।

এবার নিচের মিউটেশনের উদাহরণগুলো লক্ষ করুন—

D614G: স্পাইক প্রোটিনের ৬১৪ নম্বর অবস্থানে অ্যামিনো অ্যাসিড হিসেবে অ্যাসপারটেট (D)-এর বদলে গ্লাইসিন (G) বসেছে।

del69-70: স্পাইক প্রোটিনের ৬৯ ও ৭০তম অবস্থানে পরপর দুটি অ্যামিনো অ্যাসিড বাদ পড়ে গেছে বা ডিলিট হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে আদি প্রকরণের ৭১ নম্বর অ্যামিনো অ্যাসিড রেসিডিউ, অমিক্রনের ৬৯ নম্বরে চলে আসবে।

ins214EPE: স্পাইক প্রোটিনের ২১৪ নম্বর অবস্থানে পরপর তিনটি অ্যামিনো অ্যাসিড—একটি গ্লুটামেট (E), একটি প্রোলিন (P) এবং তারপর আরেকটি গ্লুটামেট (E) নতুনভাবে ঢুকেছে। সে ক্ষেত্রে আদি প্রকরণের ২১৪ নম্বর অ্যামিনো অ্যাসিড রেসিডিউ, অমিক্রনের ২১৭ নম্বরে চলে যাবে।

del211/L212I: হয় স্পাইক প্রোটিনের ২১১ নম্বর অবস্থানে একটি অ্যামিনো অ্যাসিড ডিলিট হবে, নয়তো ২১২ নম্বর অবস্থানে লিউসিন (L)-এর বদলে আইসোলিউসিন (I) বসবে। দুটি একসঙ্গে হতে পারবে না।

উল্লিখিত নিয়ম মেনে স্পাইক প্রোটিনে পরিলক্ষিত যেকোনো মিউটেশন বোঝা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে অমিক্রন BF.7 ভেরিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনের কিছু মিউটেশনের কথা বলা যায়। যেমন del211/L212I। এর মানে, আগে যেমন বলেছি, স্পাইক প্রোটিনের ২১১ নম্বর অবস্থানে একটি অ্যামিনো অ্যাসিড ডিলিট হবে, অথবা ২১২ নম্বর অবস্থানে লিউসিন (L)-এর বদলে আইসোলিউসিন (I) বসবে। দুটি একসঙ্গে হতে পারবে না।

এরকম আরও কয়েকটির কথা বলি। যেমন Ins214EPE। এটা ও del211/L212I স্পাইক প্রোটিনের N-প্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত। আগের প্রকরণের সাপেক্ষে সৃষ্ট অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে। কিংবা R346T-এর কথা বলা যায়। এটি অ্যান্টিবডি বন্ধনকারী অঞ্চলে অবস্থিত। ভাইরাস নিষ্ক্রিয়কারী অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দিতে সক্ষম।

এ ছাড়াও G446S এবং L981F-এর মতো ১১টি মিউটেশন হয়েছে। এগুলো আদৌ প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত নাকি স্রেফ আকস্মিকভাবে চলে এসেছে, তা গবেষণাধীন। দ্বিতীয় সম্ভাবনা সঠিক হলে এগুলোর সম্ভবত বিশেষ কোনো গুরুত্ব নেই। আর যদি প্রথম সম্ভাবনা সঠিক হয়, তাহলে অমিক্রনের দ্রুত বিস্তারে নিশ্চয়ই এগুলো ভূমিকা রাখছে।

স্পাইক প্রোটিন ছাড়াও ভাইরাসের অন্যান্য অংশে (যেমন নিউক্লিওক্যাপসিড) এমন কিছু মিউটেশন (যেমন R203K ও G204R) পরিলক্ষিত হচ্ছে, যেগুলো আগেকার প্রকরণগুলোতে হয় একেবারে ছিল না, নয়তো একই সঙ্গে উপস্থিত ছিল না। অমিক্রনের উপধরনগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারার পেছনে এগুলোর ভূমিকা রয়েছে বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, সর্বশেষ উপধরনগুলো কোন দিক থেকে আলাদা? দেখা গেছে BF.7-এর সুপ্তিকাল বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড আদি প্রকরণের তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ কোভিডের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার পর থেকে লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার মধ্যে যেটুকু সময় লাগে, বেশির ভাগ মানুষে তা ছিল ১১-১২ দিন। BF.7-এর বেলায় তা মাত্র সাত দিন। একজন সংক্রমিত ব্যক্তিকে যদি এমন এক জনগোষ্ঠীতে ছেড়ে দেওয়া যায়, যেখানো কারোরই সেই জীবাণুর প্রতি প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি, তাহলে তার থেকে গড়ে যতজনে সেটা ছড়াবে, সেই সংখ্যাকে বলে বেসিক রিপ্রোডাকশন নম্বর (R0)। আগের প্রকরণ ও উপধরনগুলোতে তা ছিল মোটামুটিভাবে ২-৬–এর মধ্যে। BF.7 এর R0 কমপক্ষে ১০ এবং সর্বোচ্চ ১৮। তার মানে, একজন থেকে এটি ১৮ জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তার ওপর আবার এই উপধরন আগের সংক্রমণ বা টিকা থেকে অর্জিত সুরক্ষাকে আংশিকভাবে পাশ কাটাতে পারে। BF.7 বা অনুরূপ উপধরন দ্বারা সংক্রমণ ঘটলে জ্বর, সর্দি, মাংসপেশিতে ব্যথা, গা ম্যাজম্যাজ করা, দুর্বল লাগা, শুকনা বা শ্লেষ্মাযুক্ত কাশি, গলাব্যথাসহ বমি-ডায়রিয়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা ৭-১০ দিনের মধ্যে আপনা–আপনি সেরে যায়।

বাইরের কোনো জিনিস (অ্যান্টিজেন) দেহের মধ্যে প্রবেশ করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি নামে বিশেষ এক শ্রেণির প্রোটিন প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করতে থাকে। একটু আগে আমরা ভাইরাসের লিগ্যান্ড এবং কোষের রিসেপ্টরের মধ্যকার সুনির্দিষ্ট বন্ধন সম্পর্কে জেনেছি। তাদের সম্পর্ক তালা-চাবির মতো। অ্যান্টিজেনের সঙ্গে অ্যান্টিবডির সম্পর্ক অনেকটা সে রকম। তবে একটু পার্থক্য আছে। যেকোনো অ্যান্টিজেনের (যেমন স্পাইক প্রোটিন) আণুবীক্ষণিক ত্রিমাত্রিক গঠনের সাপেক্ষে তার বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে। একই অ্যান্টিজেনের ভিন্ন আকারবিশিষ্ট অংশগুলোকে বলে এপিটোপ। কোনো একটি এপিটোপের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, এমন কোনো অ্যান্টিবডি সেই একই অ্যান্টিজেনের ভিন্ন কোনো এপিটোপের সঙ্গে বন্ধন তৈরি না–ও করতে পারে। এ জন্য সংক্রমণ বা টিকার প্রতিক্রিয়ায় কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে কেবল এক প্রকারের অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হয় না; বরং এক সেট অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যার প্রতিটি কোনো না কোনো এপিটোপের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে যুক্ত হতে পারে। সে হিসেবে প্রতিটি অ্যান্টিজেন হলো এক সেট তালার (অর্থাৎ এপিটোপ) সমষ্টি, যার প্রতিটির জন্য কমপক্ষে একটি করে চাবি (অর্থাৎ অ্যান্টিবডি) তৈরি হয়। স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে এ রকম যত প্রকারের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তার সব কটি সংক্রমণ ঠেকাতে সমান কার্যকর নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আমাদের দেহে SARS-CoV-2–এর বিরুদ্ধে যেসব অ্যান্টিবডি অণু তৈরি হয়, তার মধ্যে যেগুলো স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর-বন্ধন অঞ্চল কিংবা N-প্রান্তীয় অঞ্চল (N-terminal domain)—এ দুটি এপিটোপের অন্তত একটিতে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেগুলো কেবল ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে। তাই ভাইরাসের এ দুটি অংশে কোনো মিউটেশন হলে এ আশঙ্কা যুক্তিসংগত যে আগে থেকে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি (সংক্রমণ কিংবা টিকার ফলে সৃষ্ট) হয়তো অমিক্রনের বিরুদ্ধে সমানভাবে কাজ করবে না। করোনাভাইরাসের আদি প্রকরণের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, BF.7–সহ অমিক্রনের সর্বশেষ উপধরনগুলোতে স্পাইক প্রোটিনের উল্লেখিত অংশগুলোতে সব মিলিয়ে অন্তত ৩০টি মিউটেশন রয়েছে। এই সংখ্যা আগের যেকোনো প্রকরণের চেয়ে অনেক বেশি।

কোনো জীবাণু দ্রুত ছড়াতে পারে, তার মানে সব সময় এই নয় যে তা অনেক বেশি প্রাণঘাতী। লক্ষ করুন, যে জীব বা তার যে বংশধর বেশি বেশি বংশবৃদ্ধি করতে পারবে, সে-ই দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকবে। কারণ, সে সংখ্যায় বেশি। প্রাকৃতিক নির্বাচনের সহজ হিসাব এটাই। কোনো ভাইরাসের কোনো প্রকরণ যদি এ নিয়মে বেশি সংখ্যায় ছড়িয়ে পড়ে, সেটাই তার টিকে থাকার পক্ষে যথেষ্ট। সে জন্য পোষককে মেরে ফেলা জরুরি নয়, বরং যেসব জীবাণু তার পোষককে খুব বেশি হারে মেরে ফেলে, সেই জীবাণুগুলো বেশি দূর ছড়াতে না পারার কারণে দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই পোষককে খুব বেশি অসুস্থ না করে যদি তার মাধ্যমে আরও অনেককে আক্রান্ত করার মতো মিউটেশন কোনো প্রকরণের মধ্যে জমা হয়ে থাকে, তাহলে সেই প্রকরণ একসময় প্রধান প্রকরণ হয়ে দাঁড়াবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। অমিক্রনের BF.7 প্রভৃতি উপধরনের বেলায় ঠিক এটাই ঘটছে কি না, তা আমরা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারি না। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, BF.7 আক্রান্তের হার বহুগুণ হলেও সে তুলনায় এর মৃত্যুহার বেশ কম।

আক্রান্তের সংখ্যা চীনে কেন এত বেশি হারে বাড়ছে, তা নিয়ে পর্যাপ্ত উপাত্ত আমাদের হাতে আসেনি। তবে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ হাইপোথিসিস হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

জিরো কোভিড নীতি কড়াকড়িভাবে আরোপ করার ফলে চীনের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ সরাসরি ভাইরাসের সংস্পর্শে আসেনি। ফলে তাদের মধ্যে কোনো প্রতিরোধ তৈরি হয়নি।

চীনের নিজস্ব টিকাগুলোর কার্যকারিতা পশ্চিমা টিকাগুলোর চেয়ে কম। আপৎকালে কম কার্যকর টিকাও জীবন রক্ষাকারী হতে পারে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে তা সুরক্ষা দিতে পারছে না।

চীনের জনসংখ্যার বেশির ভাগ বয়স্ক। তার ওপর আবার সেখানকার বয়স্ক জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ টিকার বুস্টার ডোজ এখনো পায়নি।

একই উপধরন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও পাওয়া গেছে, যদিও এগুলোর কারণে সেসব জায়গায় চীনের মতো খারাপ পরিস্থিতি এখনো হয়নি। তবে আগে যেমন বলেছি, চীনে কেন এমন বিপর্যয় দেখা দিল, তা বিশ্লেষণ করার মতো তথ্য-উপাত্ত তাদের সরকারের পক্ষ থেকে অবমুক্ত করা হয়নি বলে এ বিষয়ে গবেষণার সুযোগ সীমিত।

জীবজগৎ যত দিন থাকবে, প্রাকৃতিক নির্বাচন চলবে। প্রকৃতির এই নিয়ম পাশ কাটানোর উপায় নেই; বরং নতুন প্রকরণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুনভাবে টিকা বানানো যেতে পারে। ফাইজার, মডার্নাসহ বিশ্বের বড় বড় টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নতুন প্রকরণের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট টিকা তৈরির কাজে হাত দিয়েছে। তার মানে এই নয় যে বর্তমানে প্রাপ্য টিকাগুলো একেবারে অকার্যকর। নতুন প্রকরণগুলোর বিরুদ্ধে এখনকার টিকা কাজ কম করতে পারে, তারপরও যেটুকু করবে, তা সংক্রমণ প্রতিহত করতে না পারলেও মৃত্যুহার কম রাখার পক্ষে যথেষ্ট। তা ছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব টিকা হাতে আছে, সেগুলোর তৃতীয় ও চতুর্থ ডোজ BF.7–সহ অমিক্রনের প্রায় সব উপপ্রকরণের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ বজায় রাখতে সক্ষম। তাই বয়স্ক ব্যক্তি বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, এমন মানুষ এবং সম্মুখসারির করোনাযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তৃতীয় ও চতুর্থ ডোজ প্রদানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি যাঁরা এখনো টিকা পাননি, অতিদ্রুত তাঁদের টিকা দিতে হবে। কোভিড টেস্টের কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের জন্য বাধ্যতামূলক পিসিআর টেস্ট এবং মানসম্মত প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন চালু করতে হবে। এর কিছু কিছু করা হচ্ছে, বাকিগুলো করে ফেলতে হবে শিগগিরই। বাংলাদেশে অমিক্রনের নতুন উপধরনের প্রভাবে বিপর্যয়ের আশঙ্কা যেহেতু একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, সেহেতু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সুচিন্তিত ও সময়োচিত পদক্ষেপ অপরিহার্য। সব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে—এ পুরোনো কথা এখনো পুরোনো হয়ে যায়নি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নেচার মাইক্রোবায়োলজি, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন, covariants.org, cov-lineages.org

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ড. জেফরি ব্যারেট, পরিচালক, কোভিড-১৯ জেনোমিকস ইনিশিয়েটিভ অ্যাট দ্য ওয়েলকাম স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউট, যুক্তরাজ্য

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত