বোস্টনের গুটিবসন্ত-কাণ্ড

১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের কলোনিগুলোয় ভয়াবহ এক সংবাদ ছড়িয়ে গেল। বসন্ত এসে গেছে—এই বসন্ত ঋতুরাজ বসন্ত নয়, গুটিবসন্ত। শুধু এসে বসে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের মতো সারা বোস্টনে। এ রোগের প্রথম শিকার ছিলেন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসা জাহাজের এক যাত্রী, সেই যাত্রীকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে বাইরে একটা লাল পতাকা ঝুলিয়ে দেওয়া হলো, পতাকায় আবার কিছু কথাবার্তা লেখা, ‘ঈশ্বর, এই বাড়িতে করুণা বর্ষণ করুন’। পতাকা লাগানো দেখেই কলোনি থেকে লোকজন এলাকা ছেড়ে পালানো শুরু করে দিয়েছে, জানের ভয় সবারই আছে।

ভয়ের কারণ আছে অবশ্য। এই ভাইরাস ছিল ভয়াবহ রকমের সংক্রামক এবং ছড়ায় দাবানলের মতো। রোগের প্রচণ্ড জ্বর, ক্লান্তি আর সারা শরীরে গুটিতে ভরে যেত। কেউ বেঁচে গেলেও সারা শরীরে বিচ্ছিরি ক্ষত তৈরি করত। আক্রান্ত মানুষের মধ্যে মারা যেত শতকরা ৩০ জন।

১৭২১ সালে দেখা দেওয়া গুটিবসন্তটা ছিল একটু আলাদা। রোগ সারা শহরে ছড়িয়ে গিয়ে হাজারো মানুষ মরার কথা। কারণ, এখনকার মতো আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা তখন তো ছিলই না। রোগটা কিসের কারণে হচ্ছে, তা-ও মানুষ জানত না। তারপরও ঘটনা আলাদা হওয়ার কারণ একজন আফ্রিকান ক্রীতদাস, নাম ‘ওনেসিমাস’। মানুষটা গুটিবসন্ত থেকে বাঁচার এক বিচিত্র উপায় বললেন, সেই উপায় নিয়ে কাজ করলেন একজন সাহসী ডাক্তার ও মন্ত্রী—রোগ আটকাল। এ সময়ে আমেরিকায় আবার ছিল জমজমাট দাস ব্যবসা।

বোস্টনে তখন এ রকম দাস বিক্রির জন্য হ্যান্ডবিল বা পোস্টার দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হতো।

প্রাচীন পৃথিবীতে গুটিবসন্ত এক প্রাণঘাতী রোগের নাম। ইতিহাসবেত্তা সুজান প্রায়োরের মতে, ‘অল্প কিছু প্রাণঘাতী রোগ ওই সময় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেত এবং গুটিবসন্ত তার মধ্যে একটা।’ কলোনিস্ট জাতিগুলো দেখল, এ রোগ সবারই হয়, গায়ের বর্ণ সাদা-কালো কোনো ঘটনা নয় এবং শুধু কলোনিস্টদের কারণে নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে গুটিবসন্তের প্রকোপ দেখা দিয়ে গোত্রের পর গোত্র নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

ক্রীতদাসবাহী জাহাজে করে গুটিবসন্ত ছড়িয়েছে ক্রীতদাসদের মাধ্যমে। জাহাজের ভেতর ক্রীতদাসদের রাখা হতো একসঙ্গে, ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, খুব সহজেই একজনের কাছ থেকে আরেকজনের শরীরে রোগ সংক্রমিত হতো। রোগ ছড়িয়েছে এক কলোনি থেকে আরেক কলোনিতে। যুক্তরাষ্ট্রে ক্রীতদাসপ্রথা এবং ব্যবসার মূল কেন্দ্র ছিল ম্যাসাচুসেটস, এখানে প্রথম দাস ব্যবসা শুরু হয় ১৬৩৮ সালে। ১৭০০ সালের মধ্যেই দেখা গেল এখানে হাজারের ওপরে ক্রীতদাস বিকিকিনি হয়েছে। এরা সবাই থাকত কলোনিতে, বেশির ভাগই বোস্টনে।

১৭০৬ সালে কট্টরপন্থী এক প্রভাবশালী মন্ত্রী কটন ম্যাথার সমিতির পক্ষ থেকে নিজের জন্য পশ্চিম আফ্রিকান এক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস কিনে নাম দিয়ে দিলেন ‘ওনেসিমাস’। নামটা এক পৌরাণিক কাহিনির দাসের, অর্থ ‘দরকারি’। ম্যাথার ‘সালেম উইচ ট্রায়াল’-এর খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ, বিশ্বাস করতেন ক্রীতদাসদের খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত ও ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত করা খুবই দরকার। যদিও উনি বিশ্বাস করতেন, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষগুলোর অধিকার বলে কিছুই থাকা উচিত নয়, সমান অধিকার দিলেই তারা বিদ্রোহ করে বসবে। বিদ্রোহ খুবই ঝামেলার ব্যাপার।

ওনেসিমাসকে খুব একটা বিশ্বাস করতেন না ম্যাথার, সব সময় চোখে চোখে রাখতেন। তাঁর মনে হতো, ওনেসিমাসের চেহারাসুরতে ‘চোর চোর’ ভাব আছে, ‘শয়তান’ ও ‘অলস’ ধরনের। কিন্তু ১৭১৬ সালে ওনেসিমাস যখন বলল যে তার একবার গুটিবসন্ত হয়েছিল এবং সে জানে কীভাবে গুটিবসন্ত ঠেকাতে হয়, তখনই প্রথম তার কথা বিশ্বাস করলেন ম্যাথার। তিনি তখন আবার তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন, ‘ওনেসিমাস ব্যাটা বেশ চালাক-চতুর আছে, বলল কী একটা ছোট অপারেশন করে তাতে গুটিবসন্তের কী একটা দিয়ে নিজেকে গুটিবসন্ত থেকে সারা জীবনের জন্য রক্ষা করেছে...যার কাজটা করার সাহস আছে, তার আর কোনো দিন গুটিবসন্ত হবে না।’

কটন ম্যাথার

অপারেশনটা আসলে তেমন জটিল কিছু নয়, একজন সংক্রমিত মানুষের গুটিবসন্তের গুটি থেকে পুঁজ নিয়ে হাতের ত্বক কেটে তাতে একটু পুঁজ লাগিয়ে দেওয়া। জিনিসটা ভ্যাকসিনেশন না, যাতে স্বল্প ক্ষমতার ভাইরাস শরীরে ঢুকিয়ে দিয়ে পূর্ণ ক্ষমতার ভাইরাসের বিপক্ষে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করা হয়। ওনেসিমাসের গল্প বিশ্বাস করলেন ম্যাথার এবং প্রথম প্রয়োগ শুরু করলেন সেই ক্রীতদাসদের ওপরেই। তার আগে অবশ্য খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারলেন, এ পদ্ধতি অনেক আগে থেকেই চীন ও তুরস্কে চালু আছে। কিন্তু বোস্টনে সেই রকম কাজ শুরু করে তিনি মোটামুটি টিকার প্রচারক হয়ে গেলেন। কথাবার্তা মোটামুটি গোটা ম্যাসাচুসেটসে ছড়িয়ে গেল যে ‘আশা আছে’। গুটিবসন্ত ঠেকানো সম্ভব।

ম্যাথারের মোটামুটি ধারণা ছিল, একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ বা ক্রীতদাসের কথায় কাজ করাটা শ্বেতাঙ্গ লোকজন পছন্দ করবে না, এ নিয়ে তিনি তেমন একটা উচ্চবাচ্যও করেননি। তিনি নিজেই যেখানে নিজের ক্রীতদাসকে বিশ্বাস করতে পারেননি, সেখানে অন্য কোনো শ্বেতাঙ্গ অবিশ্বাস করলে তার কোনো দোষ দেওয়া যায় না। সেখানে আবার অশিক্ষিত একটা ক্রীতদাসের বলা একটা গোটা মেডিকেল প্রসিডিউর, লোকজন বিশ্বাস করে কী করে? নিন্দার একটা ঢিঢি পড়ে গেল চারদিকে, দ্য নিউ ইংল্যান্ড ক্যুরান্ট নামের এক পত্রিকা ম্যাথারকে নিয়ে বেশ ব্যঙ্গাত্মক লেখা ছাপল। কুৎসিত রেসিজম আর রেসিস্টরাও খেপে গেল। বাদ গেল না ধর্মও। চার্চের পাদরিরা বললেন, ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর সন্তানদের বিপজ্জনক রোগে আক্রান্ত করা ঈশ্বরের নীতির বিরুদ্ধাচরণ।

১৭২১ সালে ম্যাথার সঙ্গে পেলেন জাবদিয়েল বয়েলস্টোন নামের এক চিকিৎসককে। বোস্টনের এই একমাত্র চিকিৎসক ম্যাথারের প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেছেন। ১৭২১ সালেই ওনেসিমাসের বলা প্রক্রিয়া বেশ বড় পরিসরে প্রয়োগের সুযোগ এল, আবার গুটিবসন্তের প্রকোপ দেখা দিল বোস্টনে। এবার গুটিবসন্ত বোস্টনে এল জাহাজে চড়ে। বোস্টনের মোটামুটি অর্ধেক জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হলো গুটিবসন্তে। বয়েলস্টোন কাজে নেমে পড়লেন। প্রথমে নিজের ক্রীতদাসদের, এমনকি নিজের ছেলের হাতের ত্বক কেটে গুটিবসন্তের পুঁজ লাগিয়ে দিলেন। এরপর কাজে নেমে পড়লেন বোস্টনের বাসিন্দাদের নিয়ে। মোট ২৪২ জনকে এ পদ্ধতিতে টিকা দিলেন বয়েলস্টোন, এর মধ্যে মারা গেলেন ৬ জন। প্রতি ৪০ জনে ১ জন। অন্যদিকে যাঁরা এই টিকা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রতি ৪০ জনে মারা গেলেন ৭ জন।

এই মহামারিতে বোস্টনের ৮৪৪ জন মানুষ মারা গেলেন, মোট জনগোষ্ঠীর ১৪ শতাংশ মানুষ। কিন্তু এতে পরের মহামারিগুলোর ব্যাপারে কী কী করা যায়, সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেল। ১৭৯৬ সালে এডওয়ার্ড জেনার কাউপক্স থেকে এই স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের একটি কার্যকর টিকা তৈরি করেন। ম্যাসাচুসেটসে পরবর্তী সময়ে গুটিবসন্তের টিকা বাধ্যতামূলক করা হয়।

ম্যাথারকে বলা প্রক্রিয়া কতটা কাজ করেছে, তা দেখার জন্য ওনেসিমাস বেঁচে ছিলেন কি না, আমরা জানি না। মানুষটার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে খুব একটা জানা যায়নি, শুধু জানা গিয়েছিল যে তিনি আংশিক স্বাধীনতা কিনতে পেরেছিলেন, পুরোপুরি ক্রীতদাস ছিলেন না। অবশ্য সে জন্য স্টিভেন জে নিভেন নামের এক ইতিহাসবিদ ম্যাথারকে আরেকজন ক্রীতদাস কেনার অর্থ দিয়েছিলেন।

লেখক: গবেষক, সিএসএফ গ্লোবাল

সূত্র: হিস্ট্রি ডটকম

*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত