পিঁপড়াদের শিশু চুরি

প্রাণিজগতে চুরির ঘটনা দুর্লভ কিছু নয়। বৃশ্চিক মাছিরা খাবারের জন্য মাকড়সার জাল থেকে পোকা চুরির জন্য বিখ্যাত। একে অপরের কাছ থেকে খাবার ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য শঙ্খচিলদের নামই হয়ে গেছে উপকূলীয় জলদস্যু। তবে চৌর্যবৃত্তিতে এক ধাপ এগিয়ে ভারতীয় কালো পিঁপড়া।

ভারতীয় এক গবেষণায় দেখা গেছে, একেবারে অন্য বসতি থেকে অন্য পিঁপড়ার শিশু চুরি করে নিয়ে আসে তারা। এরপর সেই শিশুদের ক্রীতদাস বানিয়ে নেওয়া আর প্রয়োজনমতো খাটিয়ে নেওয়া। এমনকি এসব ক্রীতদাস পিঁপড়াকে খেতেও দেয় না এরা। খাবারের জন্য বেচারা ক্রীতদাসদের করতে হয় আলাদা পরিশ্রম। শুনতে অবাক লাগলেও দেখা গেছে, পপেরিন গোত্রের পিঁপড়ারা এই কাজই করে খুব দক্ষতার সঙ্গে।

গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন কলকাতার বাঙালি বিজ্ঞানীরা। বিষয়টি গবেষকদের নজরে আসে প্রথম ২০১৬ সালে। সেই থেকে দুই বছর এ বিষয়ে কাজ করে এই ফলাফলে পৌঁছেছেন তাঁরা। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইসার) বিজ্ঞানী সুমনা আন্নাগিরির নেতৃত্বে পরিচালিত হয় গবেষণাটি।

এর আগেও পিঁপড়াদের শিশু বা ডিম চুরির ঘটনা দেখা গেছে। পলিয়েরগাস রুফেসেন্স ও ফরমিকা স্যাংগুইনিয়া নামের পিঁপড়ার প্রজাতির মধ্যে দেখা গিয়েছিল এই আচরণ। তবে এবারের ফল একটু বেশিই নজরকাড়া। এই পিঁপড়ারা শিশু চুরি করে নিজেদেরই প্রজাতি থেকে। বসতিটা কেবল আলাদা।

বিশেষ এই পিঁপড়াদের প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম ডায়াকামা ইন্ডিকাম। ভারতের গ্রামাঞ্চলেই মূলত এদের বেশি দেখা যায়। লম্বায় প্রায় ১ সেন্টিমিটার। পনেরিন গোত্রের এই পিঁপড়াদের বৈশিষ্ট্য আমাদের দেখা কালো পিঁপড়াদের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়।

তবে বলা যেমন সহজ, অন্য বসতি থেকে ডিম চুরি করে নিয়ে আসা কিন্তু ততটা সহজ নয়। পিঁপড়াদের শরীর থেকে ফেরোমন নামের একটি পদার্থ বের হয়। এর গন্ধ থেকে সহজেই পিঁপড়ার উপস্থিতি টের পেয়ে যায় অন্য পিঁপড়ারা। ভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়াদের মধ্যে এর গন্ধে কিছু ভিন্নতা থাকে। ভিন্নতা থাকে একই প্রজাতির ভিন্ন বসতির পিঁপড়াদের মধ্যেও। তাই অল্প সময়ের মধ্যেই চুরির কাজ শেষ করে ফিরতে হয় অপহরণকারী পিঁপড়াদের। গায়ের গন্ধের জন্য ১০-১৫ সেকেন্ডের বেশি সময় পায় না এরা। তাই চুরির জন্য এমন বসতি বেছে নেয় ওরা, যেখানে শৃঙ্খলার ঘাটতি আছে। বাসার পরিবেশ যেখানে একটু এলোমেলো বা ভাঙাচোরা।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য অপহরণকারীদের ব্যর্থ হয়েই ফিরতে হয়। সফলতার হার ৩০ থেকে ৩৬ শতাংশ। কখনো কখনো আবার হাতেনাতে ধরাও পড়ে যায়। তখন পেতে হয় শাস্তি। আচ্ছামতো কামড়ে কামড়ে একসময় তাড়িয়ে দেওয়া হয় গুপ্তচরটিকে!

আর সফল হলে একেকটি প্রচেষ্টায় ২৫ থেকে ২৮টি পর্যন্ত শিশু নিয়ে আসতে পারে তারা। একটি বসতির সব পিঁপড়া আবার অপহরণকারী হয় না। বড়জোর ৪ শতাংশ পিঁপড়া এই গুরুদায়িত্ব পালন করে।

গবেষকেরা একই সঙ্গে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম পরিবেশে গবেষণাটি পরিচালনা করেন। সংগ্রহ করেন এই প্রজাতির পিঁপড়ার ২০টি নমুনা। আলাদা করে চেনার সুবিধার্থে প্রাপ্তবয়স্ক, শিশু ও লার্ভা আলাদা করে রং করা হয়েছিল। দেখা গেল, পিঁপড়াদের ভালো বাসাগুলোয় চুরির ঘটনা ঘটছে না। যখন একটি বাসা কিছুটা ভেঙে দেওয়া হলো এবং পিঁপড়ারা অন্য কোথাও যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখনই ঘটল চুরির ঘটনা। গড়ে ১১ মিনিটেই একবার করে।

গবেষণার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল পশ্চিবঙ্গের নদীয়া জেলার মোহনপুর এলাকা থেকে। জলবায়ুর দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ক্রান্তীয় এলাকা।

লেখক : প্রভাষক, পরিসংখ্যান বিভাগ, পাবনা ক্যাডেট কলেজ

সূত্র: জার্নাল: প্লাস ওয়ান, দ্য হিন্দু ডট কম