থাইলাসিন এক অদ্ভুতদর্শন প্রাণী। একসময় অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া এবং পাপুয়া নিউ গিনির বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যেত। প্রাণীটির মুখ অনেকটা কুকুরের মতো, পিঠে বাঘের মতো ডোরাকাটা দাগ, আর লেজটা ক্যাঙ্গারুর লেজের মতো—যেন তিনটি প্রাণীর বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে তৈরি এক অদ্ভুত প্রাণী। এই বিশেষ প্রাণী ‘তাসমানিয়ান টাইগার’ নামেও পরিচিত। সেই হিসেবে একে অদ্ভুত দেখতে বাঘও বলতে পারেন।
থাইলাসিনের বৈজ্ঞানিক নাম থাইলাসাইনাস সাইনোসিফেলাস (Thylacinus cynocephalus)। দেখতে বাঘের মতো হলেও এরা আসলে মারসুপিয়াল উপশ্রেণির স্তন্যপায়ী প্রাণী। ক্যাঙ্গারুর মতো পাউচে (থলি) বাচ্চা পালন করে। থাইলাসিনিডে পরিবারের একমাত্র জীবিত প্রজাতি হিসেবে বেঁচে ছিল এই থাইলাসিন বাঘ।
একসময় পৃথিবীতে অনেক থাইলাসিন ছিল। ধারণা করা হয়, শুধু অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়াতেই কমপক্ষে পাঁচ হাজার থাইলাসিন বাস করত। কিন্তু ১৯ শতকের শুরুতে এই প্রাণীটির ভাগ্য বদলে যেতে শুরু করে। শিকারিদের নির্মম আক্রমণ, প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস এবং রোগবালাই—এসব মিলিয়ে থাইলাসিনের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। ২০ শতকে এদের সংখ্যা নেমে আসে হাতে গোনা কয়েকটিতে।
অস্ট্রেলিয়া এবং তাসমানিয়া অঞ্চলে বসবাসকারী ইউরোপীয়রা তাসমানিয়ান বাঘ বা থাইলাসিনকে তাদের হাঁস-মুরগি এবং ভেড়ার পালের জন্য হুমকি মনে করত। কারণ, লোকালয়ে ঢুকে এই প্রাণীগুলো পোষা প্রাণী খেয়ে ফেলত। এই কারণে তাদেরকে হুমকি হিসেবে ভেবে ব্যাপক হারে হত্যা করা হয়।
শিকারিদের এই নির্মম আক্রমণে থাইলাসিনের সংখ্যা কমতে কমতে ক্রমে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়। ১৯৩০ সালে মানুষের জানা শেষ বন্য থাইলাসিনটি এক শিকারির হাতে মারা যায়। এরপর এদের আর বনে দেখা যায়নি। তাসমানিয়ার হোবার্টের বোম্যারিস চিড়িয়াখানায় রাখা শেষ থাইলাসিনটিকে ‘বেঞ্জামিন’ নামে ডাকা হতো, সেটি মারা যায় ১৯৩৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। এর মাত্র ৫৯ দিন আগে প্রাণীটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করেছিল অস্ট্রেলিয়া সরকার। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অবশেষে ১৯৮৬ সালে থাইলাসিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
তবে থাইলাসিনকে ঘিরে কৌতূহল আজও ফুরায়নি। সাম্প্রতিক কিছু প্রতিবেদন বলছে, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে নাকি আবার থাইলাসিন দেখা গেছে। যদিও এই দাবিগুলো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবু অনেকেই আশায় বুক বাঁধছেন, হয়তো কোনোভাবে প্রকৃতির কোণায় লুকিয়ে থেকে প্রাণীটি আজও বেঁচে আছে।
আরও আশার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা প্রাণীটিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পাস্ক ও তাঁর সহকর্মীরা এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা ১১০ বছর আগে সংরক্ষিত একটি থাইলাসিনের নমুনা থেকে সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স করতে সক্ষম হয়েছেন। এই জিনোম সম্পাদনার মাধ্যমে ডুনার্ট নামে খুদে মারসুপিয়াল প্রাণীর স্টেম কোষে থাইলাসিনের ডিএনএ প্রবেশ করিয়ে ভ্রূণ তৈরির পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। এরপর সেই ভ্রূণকে একটি বাহক প্রাণীর দেহে স্থাপন করে থাইলাসিন জন্ম দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সফল হতে পারে। থাইলাসিন নিয়ে এই প্রকল্প মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও টেক্সাসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘কলোসাল’-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে।