ফিরে আসবে বরফযুগের ম্যামথ!

আইস এজ সিনেমার ম্যানির কথা মনে আছে? হস্তীকায় লোমশ শরীর নিয়ে হেলেদুলে বরফযুগের ভূমিতে যে চরে বেড়ায়? অ্যানিমেশনের ম্যানি পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে চার হাজার বছর আগেই। কিন্তু এগুলো তাদের অস্তিত্বের চিহ্ন রেখে গেছে ফসিলের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা আগ্রহের সঙ্গে বিশ্লেষণ করছেন ফসিল থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ। এই ডিএনএর সাহায্যেই পৃথিবীতে আবার ফিরে আসবে ম্যামথরা। এমন আশাই দেখাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। চলুন আরেকটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক ম্যামথের পুনর্জন্ম নিয়ে।

শুরু করা যাক আদি ম্যামথের কথা দিয়ে। আফ্রিকান হাতির উপপ্রজাতি হিসেবে ৪০ লাখ বছর আগে উৎপত্তি এই ম্যামথের। এরও ১০ লাখ বছর পর আফ্রিকা ছেড়ে ইউরোপে পাড়ি জমায় এই ম্যামথগুলো। ধীরে ধীরে বিভিন্ন তাপমাত্রায় অভিযোজিত নতুন প্রজাতির ম্যামথগুলো ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া ও নর্থ আমেরিকায়। ১০ লাখ বছর আগে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের লোমশ ম্যামথ সর্বশেষ ম্যামথের প্রজাতি হিসেবে সবার নজর কেড়েছে। লোমশ ম্যামথ ওজনে ৫-৬ টন এবং উচ্চতায় ৩-৪ মিটার লম্বা হয়, অনেকটা আফ্রিকার হাতির মতোই। তবে বরফশীতল পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এগুলোর শরীরে ছিল মোটা চর্বির স্তর ও ঘন লোম, যাতে শরীরের উত্তাপ ধরে রাখা সহজ হতো।

কেন বিলুপ্ত হয়ে গেল এই বিশালকায় প্রাণীটি? বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক এলাকার বরফ গলতে শুরু করে। ম্যামথের জন্য বাসস্থান ও খাদ্যসংকট দেখা দেয়। প্রস্তরযুগের মানুষের নির্বিচার শিকারের কারণেও হারিয়ে যেতে পারে ম্যামথ। ২০১৯ সালে মেক্সিকোতে ৮২৪টি ম্যামথের হাড়ের সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল মানবসৃষ্ট ফাঁদ। এ ছাড়া সংগৃহীত ম্যামথের হাড়ে বর্শার আঘাতের চিহ্ন, ম্যামথের বিলুপ্তির জন্য মানুষের দায়ভারকে আরও জোরালোভাবে প্রমাণ করে। নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মতে, জিনে ক্ষতিকর মিউটেশনের কারণে বিলুপ্ত হতে পারে ম্যামথ। ক্ষতিকর মিউটেশনের কারণে ধীরে ধীরে ম্যামথের ঘন লোম পাতলা হয়ে যায়, হজমে সমস্যা দেখা দেয় অথবা ঘ্রাণশক্তি হ্রাসের কারণে ফেরোমন শনাক্তে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল ম্যামথ, যার ফলে সঙ্গী খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়েছে এগুলোকে।

আফ্রিকান হাতির উপপ্রজাতি হিসেবে ৪০ লাখ বছর আগে উৎপত্তি এই ম্যামথের। এরও ১০ লাখ বছর পর আফ্রিকা ছেড়ে ইউরোপে পাড়ি জমায় এই ম্যামথগুলো। ধীরে ধীরে বিভিন্ন তাপমাত্রায় অভিযোজিত নতুন প্রজাতির ম্যামথগুলো ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া ও নর্থ আমেরিকায়। ১০ লাখ বছর আগে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের লোমশ ম্যামথ সর্বশেষ ম্যামথের প্রজাতি হিসেবে সবার নজর কেড়েছে। লোমশ ম্যামথ ওজনে ৫-৬ টন এবং উচ্চতায় ৩-৪ মিটার লম্বা হয়, অনেকটা আফ্রিকার হাতির মতোই।

বিলুপ্তির কারণ যা–ই হোক না কেন, ম্যামথ অস্তিত্বের জানান দিয়েছে এগুলোর ফসিলের মাধ্যমে। যেহেতু এগুলো বরফযুগের প্রাণী, সাইবেরিয়া অঞ্চলে পুরু বরফের স্তরে এগুলোর ফসিল চাপা পড়ে ছিল যুগের পর যুগ। অতি নিম্ন তাপমাত্রায় এগুলোর দেহের পচন ঘটেছে খুব ধীরে। তাই লাখ লাখ বছর পরও ম্যামথের উন্নত মানের ফসিল সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, যেখান থেকে কার্যকর ডিএনএ উদ্ধার করা সম্ভব। ২০১৯ সালে জাপানের কিন্দাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ইউকা নামের এক ম্যামথের অস্থিমজ্জা ও পেশিকলা সংগ্রহ করেন। ইউকার ফসিল উদ্ধার করা হয় উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়ার ইউকাগির নামের গ্রাম থেকে। জাপানি গবেষকেরা ইউকা থেকে নিউক্লিয়াস–জাতীয় বস্তুর দেখা পান। এরপর একে যুক্ত করেন ইঁদুরের ডিম্বাণুতে। ইউকার কোষগুলো এতে বেশ কার্যকর হয়ে ওঠে। আর দশটা স্বাভাবিক কোষের মতোই আচরণ করতে দেখা যায় একে। বিজ্ঞানীরা একে ম্যামথের পুনর্জন্মের একটি বড় ধাপ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জর্জ চার্চ ২০১৫ সালে ম্যামথকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন একটু ভিন্নভাবে। তিনি ক্রিসপার জিন সম্পাদনার কৌশল ব্যবহার করে ম্যামথের ডিএনএকে হাতির কোষে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চার্চ ম্যামথকে ফিরিয়ে আনতে চান হাতির রূপে, অর্থাৎ হাতির মধ্যে থাকবে ম্যামথের বৈশিষ্ট্য। চার্চ এখনো কাজ করে যাচ্ছেন ম্যামথের উন্নত মানের ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহের জন্য। তিনি আশা করেন, ২০৩০ সালের আগেই পৃথিবীর বুকে আবার জন্ম নেবে হারিয়ে যাওয়া ম্যামথ।

তবু কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। যদিও–বা ম্যামথকে ফিরিয়ে আনা যায় আবার, তা পৃথিবীর জন্য কতটুকু সুফল বয়ে আনবে? যে প্রাণীকে ধরণি লাখ লাখ বছর আগেই পরিত্যাগ করেছে, তাকে জোর করে ঠাঁই দিয়ে ইকোসিস্টেমের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া কতটা বুদ্ধিমানের? হয়তো নতুন ম্যামথ নিয়ে আসতে পারে নতুন কোনো রোগ। হয়তো নতুন ম্যামথ হতে পারে বিদ্যমান অন্য কোনো প্রাণীর বিলুপ্তির কারণ। আশা করি, সবদিক মাথায় রেখেই বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নেবেন ম্যামথের পুনর্জন্মের ব্যাপারে।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব জেনেটিকস, জাপান

সূত্র: সায়েন্স ইলাস্ট্রেটেড