সাক্ষাৎকার

ভালো বিজ্ঞানীই শুধু ভালো পৃথিবী গড়তে পারে— মো. আনোয়ারুল ইসলাম, গবেষক

অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নিবেদিত গবেষক ও কর্মী। শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি বাংলাদেশের বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণে যুক্ত। এ কাজে অন্যদেরও উৎসাহিত করেছেন; সৃষ্টি করেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সংরক্ষণবিদ, যাঁদের অনেকেই দেশে আজ বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এগুলো করতে পেরেছেন তাঁর অতি যত্নে গড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ডটিমের মাধ্যমে।

সত্তরের দশকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পড়ার সময় বিজ্ঞান জাদুঘরে তরুণদের জন্য বিজ্ঞান ক্লাব সংগঠিত করার কাজে মন দেন। সেই সঙ্গে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞান জাদুঘরের জীববিজ্ঞান গ্যালারি উন্নয়নে কাজ শুরু করেন তিনি।

অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম মনে করেন, দেশ, তথা এই পৃথিবী তরুণদের কাছেই রেখে যেতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তরুণদের তাই বিজ্ঞানমনস্ক করতেই হবে। নিজের জীবন, চিন্তা, কাজ ও প্রাণিবিজ্ঞান গবেষণার আদ্যোপান্ত বিজ্ঞানচিন্তার কাছে খোলাখুলিভাবে বললেন। অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলামের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লেখক ও গবেষক কাজী আলিম-উজ-জামান

বিজ্ঞানচিন্তা:

বাংলাদেশে হাতি ও বাঘ নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত আপনি করেছিলেন। এ বিষয়ে আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।

আনোয়ারুল ইসলাম: আশির দশকের শেষ দিকে জাহাঙ্গীরনগরের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে বন্য প্রাণিবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা শুরু হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ষাটের দশকে এর গোড়াপত্তন করেন আমাদের সবার শিক্ষক অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেন।

তবে আজ বলতে ভালো লাগছে যে আমার নিজ হাতে শুরু করা একটা নবীন বিভাগে আমার তরুণ শিক্ষার্থীরা দেশে হাতি ও বাঘবিষয়ক গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে কানাডায় কর্মরত আবদুল্লাহ আল যাবেদ চুনতি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্ব নিয়ে আমার তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে। সে–ই প্রথম ১৯৯২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে এমএসসির থিসিস জমা দেয়। পরে এটি গবেষণা প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়। সরকার ১৯৮৬ সালে হাতি সংরক্ষণের জন্য চুনতির একটি বনাঞ্চল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। স্থানীয় জনগণের মতামত না নিয়ে ও তাঁদের সম্পৃক্ত না করে সংরক্ষিত এলাকায় যে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ করা একটি দুরূহ ব্যাপার, চুনতি অভয়ারণ্য তার একটি উদাহরণ। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিজ্ঞান বুঝতে হলে সামাজিক বিজ্ঞান গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ্যক্রমে থাকতে হবে। এই গবেষণা চলার সময়ে আমরা উপলব্ধি করেছি, বন্য প্রাণী সংরক্ষণে সংরক্ষণবিদ্যা ও সামাজিক বিজ্ঞানবিষয়ক বিদ্যার মিথস্ক্রিয়া কতটা জরুরি।

এ এইচ এম আলী রেজা নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী হন। সেটিই দেশে প্রথম বাঘ নিয়ে কাজ করে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন। কাজটি গবেষণা প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এ ছাড়া আইইউসিএন-বাংলাদেশ রেজার এমএসসি থিসিসটি পুস্তক আকারে প্রকাশ করেছিল। রেজা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছেড়ে বর্তমানে সেই দেশের সরকারের ‘ডিপ্লোম্যাট’।

আমার প্রাক্তন ছাত্র আজকের বাঘবিজ্ঞানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. মনিরুল হাসান খানও এমএসসি পর্যায়ে সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে গবেষণা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সে বছর আমার কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে ওকে পাখি নিয়ে কাজ করতে বলেছিলাম। যার সুফল আজ বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশ পাচ্ছে। মনিরুল একাধারে পাখিবিজ্ঞানী ও বাঘবিজ্ঞানী। এমএসসি শেষ করে মনিরুল আমাকে আইইউসিএন-বাংলাদেশ প্রকাশিত মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর রেড বুক সম্পাদনায় গবেষক হিসেবে সহযোগিতা করেছিল। আইইউসিএন ২০০০ সালে এটি পাঁচটি খণ্ডে পুস্তক আকারে প্রকাশ করে। এর পরপরই মনিরুল কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। সেখানে আমার বন্ধু ডেভিড চিভার্সের সঙ্গে সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এর বিকেলে মনিরুল যখন সুন্দরবনে অবস্থিত ওয়াইল্ডটিম কনজারভেশন বায়োলজি সেন্টারে টাইগার স্কাউটদের সঙ্গে বাঘের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা করছিল, তখন ওদের চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। আমি ভেতর থেকে একধরনের গর্ব অনুভব করলাম।

২০১৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার আরেক প্রাক্তন ছাত্র, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক এম এ আজিজ বিলেতের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুন্দরবনের বাঘের জিনতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে। আজিজ এখন জাতীয় পর্যায়ে বাঘ, হরিণ, হাতিশুমারিসহ বহু কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ২০১৬ সালে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সুপ্রিয় চাকমা আমার তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাঘ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে। সুপ্রিয়ও জাতীয় পর্যায়ে বাঘশুমারিসহ বিভিন্ন গবেষণার কাজে নিয়োজিত। একই বছর আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সামিয়া সাইফ বিলেতের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে গবেষণায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে। ভাবতে ভালো লাগে, নিজ হাতে গড়া আমার চার প্রাক্তন শিক্ষার্থীই এখন দেশে বাঘ শিক্ষা, গবেষণা ও সংরক্ষণে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমার সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ কাজের জন্য এখন সময়ে–অসময়ে ওদেরই শরণাপন্ন হই। একধরনের ভালো লাগা কাজ করে।

১৯৮২ সালে তামিলনাড়ুর কোদাইকানাল বনে সেলিম আলীর অধীনে লাফিং থ্রাশ নিয়ে পিএইচডি করার সময় আনোয়ারুল ইসলাম
বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি তো এ উপমহাদেশের প্রখ্যাত পাখিবিদ সালিম আলীর অধীনে পিএইচডি করেছেন। আপনার জীবনে ওনার প্রভাব কতটুকু?

আনোয়ারুল ইসলাম: সালিম আলীকে যাঁরা জীবনে দেখেননি, তাঁরাও তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নানাভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। আমার বাবার সঙ্গে সালিম আলীর কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু আমি সালিম আলীর ছাত্র, এটি তিনি যেকোনোভাবে তাঁর পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে বলার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতেন। একই কাজ করত আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে, যখন বুয়েটের শিক্ষার্থী ছিল।

একজন ব্যক্তিও যে একটি প্রতিষ্ঠান হতে পারে, ১৯৮২-৮৬ পর্যন্ত সালিম আলীর সান্নিধ্যে না থাকলে বুঝতে পারতাম না। আমি তাঁর শেষ ছাত্র ছিলাম। তাই হয়তো কিছুটা চোখে চোখে রাখা, উজাড় করে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করেছি। ১৯৮৭ সালে ৯১ বছর বয়সে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বটে, কিন্তু তিনি ভারতবর্ষের অগুনতি মানুষের জন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। সালিম আলী জীবনের মূল্যবান সময় দিয়েছেন তাঁর শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে এবং যত্নশীল ছিলেন বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির ভিত্তি মজবুত করতে। তিনিই আমাকে প্রভাবিত করেছিলেন প্রতিষ্ঠান ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে। এ চেষ্টা আমার অব্যাহত আছে। প্রকৃতিবিদ পণ্ডিত নেহরু ও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতাকে তিনি ভারতের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছেন। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে যে দেশে বন্য প্রাণী ও পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব, সালিম আলী সেটি প্রমাণ করেছেন।

সুন্দরবনে ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের সঙ্গে মিটিং করছেন আনোয়ারুল ইসলাম
বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি বন্য প্রাণী সংরক্ষণে প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। এ ক্ষেত্রে আপনার ভাবনা কী ছিল?

আনোয়ারুল ইসলাম: ২০০৩ সালে আমরা বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য ওয়াইল্ডটিম প্রতিষ্ঠা করি। জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুই প্রাণিবিদ্যার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে আলোচনা হতো। যেহেতু জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিষয়। তাই ওয়াইল্ডটিমে জীববিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেছেন, তাঁদেরও কাজ করার সুযোগ হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা বন্য প্রাণী সংরক্ষণে গবেষণা ছাড়া জনসচেতনতা তৈরি করতে পেরেছি; জনগণকে বন্য প্রাণী সংরক্ষণে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। সরকারের পলিসি পর্যায়ে মতামত দিতে পেরেছি। আমরাই প্রথম চট্টগ্রাম ও শেরপুর এলাকায় হাতি-মানুষ সহাবস্থানবিষয়ক কর্মশালা করে এলাকার মানুষকে তাঁদের করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে অবহিত করেছি। আমরা ২০১০ সালে বন বিভাগ ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের উদ্যোগে শকুন রক্ষায় দেশে ‘ডাইক্লোফিনাক’ ওষুধ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করি। ওয়াইল্ডটিম ২০১২ সালে বাঘ সংরক্ষণে মানুষের আচরণে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে ‘সুন্দরবন মায়ের মতন’ ক্যাম্পেইন শুরু করে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত বিশাল এই আয়োজন উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ওয়াইল্ডটিম বন বিভাগের সহযোগিতায় সুন্দরবনের খালের দুই পাড়ের বাঘের পায়ের ছাপের ‘ট্র্যাক’ অনুসরণ করে বাঘের আপেক্ষিক প্রাচুর্য নির্ধারণ করেছে।

ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটনকে সুন্দরবনের গাছে বাঘের আঁচড়ের দাগ দেখাচ্ছেন আনোয়ারুল ইসলাম
বিজ্ঞানচিন্তা:

আপনি সারা জীবন গবেষক তৈরিতে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আপনার ভাবনা কী ছিল?

আনোয়ারুল ইসলাম: গবেষকেরা আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে একটি রাষ্ট্রের সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মূলধন। একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে গবেষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সামাজিক উন্নয়নের প্যারামিটার বা পরিমিতি নির্ভর করে আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি কি না এবং আমাদের সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সমস্যা চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান দিচ্ছি কি না। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক মূল্যবোধের উত্তরণ, গুণগত শিক্ষার মান সংরক্ষণ ও মানুষের সব মৌলিক চাহিদার জোগান দিতে পারে শুধুই শিক্ষা ও গবেষণা। আমি যেহেতু বন্য প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করি এবং যেহেতু সংরক্ষণবিদ্যার সুফল নির্ভর করে আমরা সামাজিক বিজ্ঞান থেকে কতটা গবেষণাসমৃদ্ধ তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি তার ওপর, তাই চেষ্টা করেছি জীববিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীর একটি মিথস্ক্রিয়া তৈরি করতে। বর্তমান বিশ্বে অনেকেই সুখের মানদণ্ডের সূচক নির্ধারণ করেন, তাঁরা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কতটা সফল হয়েছেন, তার ভিত্তিতে।

১৯৮৩ সালে হিমালয়ে সালিম আলীর সঙ্গে
বিজ্ঞানচিন্তা:

শিক্ষকতাজীবনের দীর্ঘ সময় আপনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। পিএইচডি শেষ করে সেখানে যোগ দিলেন। সে সময় প্রাণিবিদ্যা বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতা যদি একটু বলতেন।

আনোয়ারুল ইসলাম: ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে সম্মান বিএসসি শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করে প্রাণবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধীনে। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শফিউল্লাহ ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা এবং আমিই একমাত্র শিক্ষক। অধ্যাপক শফিউল্লাহ বললেন, কিছুই নেই, শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। তাঁর বিভাগীয় কক্ষটিই দুজনে শেয়ার করতাম। সেটিই ছিল কয়েক মাস ধরে ইনস্টিটিউটের প্রাণকেন্দ্র। স্যার যেদিন শুনলেন আমি সালিম আলীর ছাত্র, গলা উঁচু করে বললেন, ‘কী, আপনি “সলিম আলীর” (উনি সলিম বলতেন) ছাত্র! উনি তো খুবই বিখ্যাত মানুষ। শুরু করেন, আপনিই পারবেন এটা গড়ে তুলতে।’

একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার সংকল্প নিয়েই তো বোম্বে থেকে ফিরেছিলাম। স্বপ্নের মতো পেয়েও গেলাম। উপাচার্য অধ্যাপক আ ফ ম কামালউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম প্রসারের জন্য কিছু নতুন বিভাগ খোলার আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রথম কয়েক বছর আমার মনে পড়ে না যে পরিবারের সঙ্গে কোনো ছুটির দিন কাটিয়েছি। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময়ও আমি ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে গেছি। শুরুর কয়েক মাস পর দুই বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি শ্রেণিকক্ষ ও একটি ব্যবহারিক ল্যাব পেলাম একটি অতি পুরোনো ভবনে। কিন্তু তাতে দমে যাইনি। জীবনের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি বিভাগ দুটি দাঁড় করাতে। আমার প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ত্যাগ ও সহনশীলতার সর্বোচ্চটার অনুশীলন করেছে। কখনো আমতলায়, কখনো আকাশমণিগাছতলায় অপেক্ষা করেছে, কখন ক্লাসরুম খালি হবে পরের ক্লাসের জন্য।

বিশ্ববিদ্যালয় ও আমার বিশেষ অনুরোধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেন ও অধ্যাপক সৈয়দ মো. হুমায়ুন কবির এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবার রহমান খান ও অধ্যাপক সৈয়দ হাদিউজ্জামান খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করতে রাজি হলেন। ভোরে ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে গিয়ে প্রায়ই শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাখি ও গাছ চেনানোর জন্য ক্যাম্পাসে ‘ফিল্ড ওয়ার্কে’ যেতাম। আমার শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের জলাশয়ের কচুরিপানা তুলছে, পরিযায়ী পাখি গণনা করছে, গাছগাছালির খোঁজখবর নিচ্ছে, ক্যাম্পাসে ওদের উপস্থিতি দৃশ্যমান হতে শুরু করল। সেখানে নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস সবাইকে আনন্দ দিতে শুরু করল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তো একটি পরিবার। ওই পরিবারের সব শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষার্থীর ভালোবাসায় ও সহযোগিতায় আমাদের মনেই হয়নি যে আমাদের কোনো অভাব বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

মাননীয় উপাচার্য সব সময়ই খোঁজখবর নিতেন। তিনি দেখলেন, ভালোই তো চলছে! একদিন আমাকে ফোন করে তাঁর বাসায় একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে বললেন। ভেবেছিলাম, তিনি শুধুই ইনস্টিটিউটের খোঁজখবর নেবেন। না। উপাচার্য বললেন, ‘আনোয়ার সাহেব, আগামী বছর চলুন আমরা ফার্মেসি শাখাও খুলে দিই।’ বললাম, ‘স্যার, এদের বসারও জায়গা নেই, নতুন শাখা শুরু করা কি ঠিক হবে!’ বললেন, ‘আপনি পারবেন, আপনাকে সবাই ভালো জানেন, ভালোবাসেন, চেষ্টা করুন, প্লিজ।’

নতুন সীমান্ত অন্বেষণে যাত্রা শুরু করলাম। একটি নতুন বিষয় সংযোজন করার প্রক্রিয়া শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই উপাচার্য অধ্যাপক কামালউদ্দিন ইন্তেকাল করলেন। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। একজন অভিভাবক হারালাম। এরই মধ্যে অধ্যাপক এ বি এম এনায়েত হোসেন ইনস্টিটিউটের হাল ধরেছেন। অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমেদ উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম আরও বেগবান করলেন। মাথার ওপর ছায়া পেলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহউদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, অধ্যাপক চৌধুরী মাহমুদ হাসান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. আবুল কাসেম চৌধুরীর সার্বিক সহযোগিতায় ১৯৮৭ সালে ফার্মেসি বিভাগ যাত্রা শুরু করল। ফার্মেসির প্রথম ব্যাচের কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী এখন বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক। তাদেরই একজন অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার বর্তমানে জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন। দেখা হলেই বলবে, ‘স্যার, প্রথম এক বছর তো জানতাম আপনিই আমাদের একমাত্র শিক্ষক!’ বিব্রতবোধ করলেও মনটা শীতল হয়। ড. জাহিদ মোজাফফর বিভাগে যোগ দিলেন। ১৯৮৯ সালে অধ্যাপক আবদুল গণি ফার্মেসি বিভাগের হাল ধরলেন।

অধ্যাপক এনায়েত ও অধ্যাপক আবদুল গণির ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আমি ইনস্টিটিউটের পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই ইনস্টিটিউটের নিজস্ব ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিই। অর্থনীতির অধ্যাপক আমীরুল ইসলাম চৌধুরী তখন উপাচার্য এবং ইতিহাসের অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান খান তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার। দুজনই আমার ভীষণ পছন্দের মানুষ, অধ্যাপক চৌধুরীর কাছে তো ১৯৮৬ থেকেই যেকোনো পরামর্শের জন্য ছুটে যেতাম। অধ্যাপক খান তো সালিম আলীর ভক্ত ছিলেন, সে সুবাদে আমি তাঁর পছন্দের তালিকার প্রায় শীর্ষে ছিলাম। কিন্তু টাকা তো নেই।

উপাচার্য মহোদয়ের সঙ্গে একান্তে বসলাম। বললেন, ‘টাকা দেওয়ার উপায় নেই, তবে তোমাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি।’ ‘কী?’ ‘কলা অনুষদের ভবন নির্মাণের টাকা পড়ে আছে। কারণ, অনুষদের শিক্ষকেরা ভবন নির্মাণের স্থান নির্বাচনে একমত হতে পারছেন না। কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আতাউর রহমান খান কলা অনুষদের ডিন ছিলেন। তিনি কলা অনুষদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে দেখো।’ কাজ হলো। এ দুজন মানুষের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম। ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে যোগ দেওয়ার আগে আমি প্রাণিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ভবনের কাজ শুরু করে দিয়ে আসতে পেরেছিলাম এবং লটারির মাধ্যমে কোন বিভাগ কোন ফ্লোরে যাবে, সেটিও নির্ধারণ করে এসেছিলাম। আজ ইনস্টিটিউট অনুষদে রূপান্তরিত হয়েছে। নতুন নতুন বিভাগ যুক্ত হচ্ছে, দূর থেকে দেখে ভালো লাগছে।

দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। কখন যে শিকড় অতটা গভীরে গেছে, বুঝিনি। এই শিকড় উপড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসাটা আমার পক্ষে সহজ ছিল না। আমার চলে আসায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন তখনকার রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আলী। একজন অসাধারণ মানুষ তিনি। চলে আসব জেনে তিনি আমাকে একটি পত্রও দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন ওই উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক বন্ধু জাহেদ উদ্দিন মাহমুদ খান। ‘জীবন বহতা নদীর মতো, থেমে নেই, থেমে থাকে না, তবে ফিরিবার পথ নাহি...।’ জাহাঙ্গীরনগরকে ভীষণ মিস করি।

২০২৩ সালে সুন্দরবনের টাইগারহাউসে জাপানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ও তাঁর স্ত্রীর কাছে ওয়াইল্ডটিমের টাইগারটিমের কার্যকলাপ ব্যাখ্যা করছেন
বিজ্ঞানচিন্তা:

পরে আপনি এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্য প্রাণী, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে আগ্রহ কেমন দেখলেন?

আনোয়ারুল ইসলাম: আগ্রহের কমতি দেখিনি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দমতো বিষয় বেছে নেওয়ার বিকল্প অনেক বেশি। ওরা দৃশ্যমান বাস্তবতার নিরিখে গবেষণার বিষয় নির্বাচন করে। সে বিচারে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর কাছে আমরা জাতীয়ভাবে বন্য প্রাণী সংরক্ষণবিষয়ক গবেষণা করার প্রয়োজনীয়তার গভীরতা তুলে ধরতে পারিনি। অনেকে ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের কথা চিন্তা করে সেখানকার চাহিদার নিরিখে সিদ্ধান্ত নেয়। তবে যারা এ-বিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা করে, তারা নিজের আগ্রহেই করে এবং তাদের অনেকেই ভালো করছে। যে শিক্ষার্থী বন্য প্রাণী নিয়ে পড়াশোনা করে, তাকে বাস্তুবিজ্ঞান বুঝতে হয় এবং সে বাস্তুবিজ্ঞানের একজন প্রকৌশলী হিসেবে সর্বত্র আদৃত হয়। যে শিক্ষার্থী পাখি নিয়ে কাজ করে, তাকে গাছ চিনতে হয়। গাছে কখন ফুল ও ফল হয়, জানতে হয়। পোকামাকড়, শুঁয়াপোকা, প্রজাপতি, মাছ ইত্যাদি চিনতে হয়। কারণ, পাখির প্রজনন, জীবনাচরণ, গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি নির্ভর করে অনেক গাছপালা ও বিভিন্ন প্রাণীর টিকে থাকা না-থাকার ওপর। বন্য প্রাণীর এই জীবনচক্র বুঝতে গিয়ে সে জীবজগতে নিজের অবস্থান নিয়েও ভাবার সুযোগ পায়। তবে ঘর থেকে বের হতে হবে। আমিই সম্ভবত অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেনের প্রথম ছাত্র, যে বনে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পাই। আমি মধুপুর জাতীয় উদ্যানের হনুমানের ওপর এমএসসি পর্যায়ের গবেষণার কাজ করি। এর আগে প্রায় সব কাজই শহর অথবা গ্রামকেন্দ্রিক ছিল।

১৯৮২ সালে ভারতের বোম্বের সঞ্জয় গান্ধী জাতীয় উদ্যানে সালিম আলীর সঙ্গে তাঁর ৮৬তম জন্মদিনে
বিজ্ঞানচিন্তা:

বাঘ সংরক্ষণে আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

আনোয়ারুল ইসলাম: বাংলাদেশের প্রায় সব বনেই একসময় বাঘ ছিল। ঢাকার ৫০ কিলোমিটারের ভেতর গাজীপুরের শালবনেও বাঘ ছিল। ভাওয়ালের রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায় ১৯০০ সালের দিকে সেখানে বাঘ শিকার করেছেন। বর্তমানে বাঘের শেষ আশ্রয়স্থল সুন্দরবন। এটি একটি জলাভূমির বন। চারপাশে শুধুই লোনাপানি। প্রায় ৪০০ নদী, শাখানদী, খাল ও নালা মাকড়সার জালের মতো ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারের বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনে ২০০টি ‘দ্বীপ’ সৃষ্টি করেছে। এই স্যাঁতসেঁতে বনটি বাঘের জন্য আদর্শ পরিবেশ নয়। সমুদ্রের পানি একটু বাড়লেই পুরো সুন্দরবন ডুবে যাবে। শ্বাসমূলের জন্য চলাফেরাও করা সহজ নয়। তার ওপর রয়েছে বাঘদের টিকে থাকার নানা হুমকি। বাঘ শিকার সম্ভবত বন্ধ নেই। বাঘের প্রধান খাবার হরিণ শিকার তো চলছেই। সুন্দরবনের চারপাশের ৩৫ থেকে ৪০ লাখ মানুষ সুন্দরবনের সম্পদের ওপর নির্ভর করে। ইদানীং বিষটোপ দিয়ে মাছ ধরা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

ওয়াইল্ডটিমের পক্ষ থেকে আমরা বন বিভাগের নেতৃত্বে বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে অনেকটাই সফল হয়েছি। বাঘ ও সুন্দরবনের হুমকির প্রধান কারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ। এই আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। যেহেতু প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের জন্য মানুষকেই অনেকাংশে দায়ী করা হয়, তাই আমাদের মনে হয়েছে, মানুষই শেষ কথা এবং মানুষকে সম্পৃক্ত করেই এর সমাধান খুঁজতে হবে। ওয়াইল্ডটিম তাই ২০০৭ সালে ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করে। বর্তমানে সুন্দরবনের চারপাশের ৪৯টি গ্রামে ৩৪০ জন স্বেচ্ছাসেবী ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিমের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। কোনো বাঘ বন থেকে গ্রামে এলে সব সময়ই মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। এখন এই টিম এসব বাঘকে বন বিভাগের সহযোগিতায় আবার বনে ফিরিয়ে দেয়। ২০১৮ সালের পর থেকে কোনো বাঘ গ্রামে এসে মারা পড়েনি। স্বেচ্ছাসেবীরা বনে ফেরত পাঠিয়েছেন।

ওয়াইল্ডটিম ফরেস্ট টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করেছে, যারা বনের ভেতর বাঘে আক্রান্ত মৃত বা আহত মানুষকে বন বিভাগের সহযোগিতায় উদ্ধার করে। অদ্যাবধি এ রকম শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। ওয়াইল্ডটিম এলাকার সৎ, বিশ্বাসী ও মান্যবরদের নিয়ে বাঘবন্ধু দল গঠন করেছে, কিশোর ও যুবকদের নিয়ে টাইগার স্কাউট দল গঠন করেছে। এরা এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। ওয়াইল্ডটিম সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জের পাঁচটি স্কুলে সুন্দরবন শিক্ষাকেন্দ্র সৃষ্টি করেছে। আমাদের এই মডেল ভারতীয় সুন্দরবনের বন্ধুরাও গ্রহণ করে এ ধরনের কার্যক্রম শুরু করেছে। আমরা সাতক্ষীরার তিনটি গ্রামকে ‘বাঘ সহনীয় গ্রাম’ হিসেবে ঘোষণা করেছি। আমরা মোংলার কাছেই জয়মনিতে ওয়াইল্ডটিম কনজারভেশন বায়োলজি সেন্টার নির্মাণ করেছি, সেখানে সুন্দরবন জাদুঘর ও তথ্যকেন্দ্রটি শিগগিরই দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া বাঘ সংরক্ষণ সম্ভব নয়। আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছি। তবে এ চেষ্টা অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই।

বিজ্ঞানচিন্তা:

নতুন প্রজন্মের গবেষকদের জন্য আপনি কোনো বার্তা দিতে চান?

আনোয়ারুল ইসলাম: জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন ও জীবনমানের উন্নয়নের জন্য বিজ্ঞানশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। যেহেতু বিজ্ঞানশিক্ষা এখনো বাংলায় জনপ্রিয় হয়নি, তাই বিজ্ঞানশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজির কোনো বিকল্প নেই। তরুণেরা অনুসন্ধিৎসু হবে, তবে লেগে থাকতে হবে, হাফ-হার্টেডলি কোনো কিছু করা যাবে না। মানুষের চারপাশের সব জীবের টিকে থাকার অধিকার আছে, এ সত্য মেনে নিয়ে তাদের সংরক্ষণে কাজ করলে নিজেও ভালো থাকা যাবে। দলে কাজ করা জরুরি, বৈরিতা পরিহার করে নিজের জ্ঞান ও গবেষণা দিয়ে অন্যকে আলোকিত করতে হবে। নিজের সফলতা ও দুর্বলতা নিরীক্ষা করে আগ্রহের বিষয়টি যাচাই করে সেদিকে ধাবিত হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। একজন বিজ্ঞানী মিথ্যাচার করেন না, হিংসা করেন না, পরচর্চা ও পরনিন্দা করেন না, মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেন। এই গুণাবলি না থাকলে তো একজন বিজ্ঞানীকে মানুষ বিশ্বাস করবেন না। শ্রদ্ধা করবেন না।

আমার বড় নাতি তানজিফ রায়হানের বয়স ১২ বছর, ছোট নাতি তওফিক রায়হানের ৮ বছর। তানজিফ এখনই আমাকে বলে, ‘নানা ভাইয়া, আমি বিজ্ঞানী হব। কারণ, বিজ্ঞানী হলে আমি সবার জন্য প্রয়োজনীয় মানুষ হতে পারব।’ তওফিক ডাক্তার হবে। কিন্তু আমি যেসব যন্ত্রপাতি বা ওষুধ আবিষ্কার করব, সেগুলো ব্যবহার করেই তো তওফিক ডাক্তারি করবে! তরুণেরা স্বপ্ন দেখবে, এটিই আমার প্রত্যাশা। এই দেশ, এই পৃথিবী ওদের কাছেই তো আমাদের রেখে যেতে হবে। ভালো বিজ্ঞানীই শুধু ভালো পৃথিবী গড়তে পারে।

বিজ্ঞানচিন্তা:

চমৎকার বলেছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আনোয়ারুল ইসলাম: ধন্যবাদ আপনাকেও।