বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ

প্রতিনিয়ত বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহারছবি: সংগৃহীত

এক হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতিকে বলা যায়, পৃথিবী ডুবে গেছে প্লাস্টিকের সাগরে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। সঙ্গে বাড়ছে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাও। প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ থেকে ২ কোটি ৩ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জলজ বাস্তুতন্ত্রে ছড়িয়ে পড়ছে। প্লাস্টিক দূষণ হয়ে উঠছে চরম পরিবেশগত সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাস্তুসংস্থান এবং সংশ্লিষ্ট জীবন। কীভাবে হচ্ছে এসব? এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনো উপায় আছে?

এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশ বা আফ্রিকার দেশগুলোতে প্লাস্টিক দূষণ বেশি হয়। কারণ এসব জায়গায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিবেশবান্ধব নয়। কিন্তু কম রিসাইক্লিং হারের কারণে কিছু উন্নত দেশেও প্রচুর প্লাস্টিক দূষণ হয়। প্লাস্টিকের উৎপাদন এবং গণহারে ব্যবহারের ইতিহাস সর্বোচ্চ ১০০ বছরের পুরোনো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হাজার হাজার নতুন প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন ও বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। আর এখন প্লাস্টিক ছাড়া বিশ্বকে কল্পনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সব দেশ ইচ্ছামতো প্লাস্টিক ব্যবহার করে। দূর্ভাগ্যবশত প্লাস্টিক শত শত বছরেও নষ্ট হয় না। তাই এটা এখন মানুষের মাথাব্যথায় পরিণত হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে
ছবি: সংগৃহীত

শুধু ২০২০ সালেই বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক শিল্প থেকে প্রায় ১৮০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমপরিমাণ গ্যাস নির্গত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাক আর্থার ফাউন্ডেশনের তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে প্লাস্টিকের প্যাকেট তৈরিতে ১ কোটি ৪৬ লাখ মেট্রিক টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে। যা মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় ২৮ শতাংশ। এই প্যাকেটগুলো আবার যাচ্ছে নদী বা সাগরে। সেখানে বিভিন্ন প্রাণীরা একে গ্রহণ করছে খাদ্য হিসেবে। ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে প্লাস্টিকগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। ইউটিউবে এমন অনেক ভিডিও দেখা যায়, যেখানে সী লায়নের শরীরে প্লাস্টিক বাজেভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিকের আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার ভিডিও অনেক আছে অনলাইনে। 

এখানেই শেষ নয়। প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বাতাসে বিষাক্ত পদার্থ মিশে বাতাসকে দূষিত করছে। আর সেই বাতাস আমাদের দেহের ক্ষতি করছে। প্লাস্টিক দূষণের ফলে পরিযায়ী পাখিরাও অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এমনকি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক প্রজনন। বিভিন্ন প্রাণীদের মতো মানুষের রক্তেও পাওয়া গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। আপনার নিষ্পাপ শিশুটাও শিকার হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণের। পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর!

প্লাস্টিক দূষণ বাস্তুতন্ত্রের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস করে এবং লাখ লাখ মানুষের জীবিকা, খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা ও সামাজিক কল্যাণকে সরাসরি প্রভাবিত করে

এরই মধ্যে আবার নতুন বিপদের কথা শুনিয়েছেন সুইডেনের ইউনিভার্সিটি অব গোথেনবার্গের গবেষকেরা। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারও অনিরাপদ। কারণ রিসাইকেল প্লাস্টিকেও তাঁরা বিষাক্ত পদার্থ খুঁজে পেয়েছেন। মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য যা খুব মারাত্মক।

প্লাস্টিক দূষণ প্রাণীদের স্বাভাবিক বাসস্থান এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলোকে পরিবর্তন করতে পারে। বাস্তুতন্ত্রের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস করে এবং লাখ লাখ মানুষের জীবিকা, খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা ও সামাজিক কল্যাণকে সরাসরি প্রভাবিত করে। ইউএনইপি-এর কর্মশালা থেকে জানা যায়, এই পলিমারিক উপাদানটির পরিবেশগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলিকে অন্যান্য পরিবেশগত চাপের পাশাপাশি মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদেরকে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।

লেখক: জীববিজ্ঞান সেক্রেটারি, বোসন বিজ্ঞান সংঘ

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, উইএনইপি ডট অর্গ, দ্য গার্ডিয়ান, সায়েন্স ডেইলি