জীবজগতের ভর!

যদি জিজ্ঞেস করা হয়, সমগ্র জীবজগতের ভর কত? কিংবা পুরো পৃথিবীতে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়ার মোট ভর কত? প্রশ্নগুলো শুনে একটু অদ্ভুত মনে হবে কি? আসলে পুরো পৃথিবীর জীবজগতের গঠন ব্যাখ্যা করা জীববিজ্ঞানের একটি মৌলিক দিক। তো এই গঠন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন। তবে সম্প্রতি জীবজগতের গঠন ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁরা যে পদ্ধতিটি বেছে নিয়েছেন, সেটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপকই বটে। কোন ধরনের প্রাণ জীবজগতের কত অংশ গঠন করেছে, সেটির হিসাব কষতে তাঁরা বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন প্রজাতির জীবের ভরকে। বহুমুখী বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন পদার্থের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনন্য ক্ষমতার কারণে পৃথিবীর সব অণুজীব এবং প্রাণীর গঠনের একক মূলত কার্বন। সব ধরনের প্রজাতির মধ্যে বিদ্যমান থাকায় কার্বনকে মূল ভিত্তি ধরে এ গবেষণাটি চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণাপত্রটি গত জুনে প্রকাশিত হয়েছে প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস জার্নালে। ক্যালটেক ও ইসরায়েলের ওয়াইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের একদল বিজ্ঞানী এ গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন। সেখান থেকে জানা গেছে, কার্বনের হিসাবে সমগ্র জীবজগতের ভর প্রায় ৫৫০ গিগাটন (১ গিগাটন = ১০০ কোটি মেট্রিক টন, ১ মেট্রিক টন = ১০০০ কেজি)।

পৃথিবীর সমগ্র মানুষের ভরকে যদি পৃথিবীর সমগ্র ব্যাকটেরিয়ার ভরের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তবে ব্যাকটেরিয়ার ভর মানুষের তুলনায় ১১৬৬ গুণ বেশি হবে। তথ্যটা চমকে যাওয়ার মতোই।

গবেষণাপত্রে উদ্ভিদ, ছত্রাক, প্রোটিস্ট (অ্যামিবাসদৃশ আণুবীক্ষণিক জীব), আর্কিয়া (ব্যাকটেরিয়াসদৃশ এককোষী অণুজীব), ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব ধরনের প্রাণের তুলনা করা হয়েছে। এখন এটা মনে হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক যে পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রায় সাড়ে সাত শ কোটি মানুষ যে পরিমাণ জৈব বস্তু ধারণ করে, তার তুলনায় আণুবীক্ষণিক ব্যাকটেরিয়া, প্রোটিস্ট কিংবা আর্কিয়ার ভর নিতান্তই নগণ্য। তো এই ধারণাটা পরিষ্কার করার জন্য একটা ছোট্ট তথ্য দেওয়া যাক। পৃথিবীর সমগ্র মানুষের ভরকে যদি পৃথিবীর সমগ্র ব্যাকটেরিয়ার ভরের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তবে ব্যাকটেরিয়ার ভর মানুষের তুলনায় ১১৬৬ গুণ বেশি হবে। তথ্যটা চমকে যাওয়ার মতোই।

তুলনা করতে পাশের ছবিগুলো খেয়াল করতে পারেন। শুধু বন্য স্তন্যপায়ী প্রজাতি, নেমাটোড (কৃমিজাতীয় পরজীবী) এবং বন্য পাখি ছাড়া পৃথিবীর আর সব স্থলজ প্রজাতিই মানুষের চেয়ে বেশি কার্বন ধারণ করে এবং এদের অধিকাংশের তুলনায়ই মনুষ্য প্রজাতির ভর নগণ্য। পৃথিবীর সমগ্র জীবজগৎকে যদি ১০০টি ফ্ল্যাটবিশিষ্ট একটা অট্টালিকার ভেতরে কল্পনা করা যায়, তাহলে অট্টালিকার আনুমানিক ৮০টি ফ্ল্যাটেরই ভাড়াটে হবে বৃক্ষকুল। অবশিষ্ট ২০টি ফ্ল্যাটের আনুমানিক ১৫টিরই দখল নেবে ব্যাকটেরিয়া। প্রাণিজগতের জন্য হয়তো ছোট্ট একটা দোকানের সমান জায়গা বরাদ্দ হতে পারে, যেখানে মানুষের স্থান হবে সেই দোকানের এক কোণে।

আরও পড়ুন

যদিও সমস্ত জীবজগতে মনুষ্য প্রজাতির ভরের পরিমাণ নিতান্তই নগণ্য, কিন্তু গবেষণাটি বলছে জীবজগতের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের প্রভাব স্পষ্টত বিদ্যমান। প্রতিনিয়ত মানুষের অগ্রগামিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমে চলেছে জীবজগতের বিভিন্ন প্রজাতি। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, পৃথিবীর বুকে মানুষ পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার পর থেকে বন্য স্তন্যপায়ীর পরিমাণ কমে এসেছে এক-সপ্তমাংশে, এমনকি তিমির মতো জলজ স্তন্যপায়ীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে এক-পঞ্চমাংশে। এ ছাড়া পৃথিবীতে মানবসভ্যতা শুরু হওয়ার পর মানুষ বন উজাড় করে শুরু করেছে চাষাবাদ, পরবর্তী সময়ে নগরায়ণ এবং জীবনধারণের জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে গাছপালার ওপর। এখন পর্যন্ত জীবজগতের প্রায় ৮০ শতাংশজুড়ে থাকা বৃক্ষের পরিমাণ মানবসভ্যতা শুরুর আগে এর দ্বিগুণ ছিল বলে বিজ্ঞানীদের মতামত। এমনকি আমাদের নিকটাত্মীয় প্রাইমেট বর্গের অর্ধেকেরও বেশি প্রজাতিকে আমরা হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছি।

এখন পর্যন্ত জীবজগতের প্রায় ৮০ শতাংশজুড়ে থাকা বৃক্ষের পরিমাণ মানবসভ্যতা শুরুর আগে এর দ্বিগুণ ছিল বলে বিজ্ঞানীদের মতামত।

গবেষণাটিতে বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইট এবং রিমোট সেন্সিংয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত উপাত্ত ব্যবহার করেছেন, যার ফলে তাদের পক্ষে সমগ্র পৃথিবীর জীব এবং এদের বিভিন্ন প্রজাতি নিয়ে কাজ করা সহজ হয়েছে। তবে এরপরও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁরা প্রাণের অস্তিত্বসম্পন্ন বেশ কিছু জায়গার তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। উদাহরণস্বরূপ, তাঁরা উল্লেখ করেছেন অ্যাকুইফারের কথা। অ্যাকুইফার হলো মাটির বেশ গভীরে একটি পানির স্তর, যেখানে বিভিন্ন প্রকারের পাথরের স্তর পানিকে ধরে রাখে। অ্যাকুইফারে থাকা তরল এবং তার আশপাশের পাথরে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব রয়েছে। সীমাবদ্ধতার কারণে সেখানে কী কী অণুজীব কী পরিমাণে রয়েছে, সেটা তাঁরা নির্ণয় করতে পারেননি। এ ছাড়া জৈব বস্তুর ভর হিসাব করার ক্ষেত্রে তাঁরা পরজীবীগুলোকে বাহক থেকে আলাদা করেননি। তবে পুরো গবেষণাটি সমগ্র জীবজগৎ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়ার জন্য চমৎকার এবং এ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিভিন্ন প্রজাতির সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।