বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র
নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র
সুনির্মল বসুর কবিতাটির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। আসলে মানুষের জন্মই হয় ছাত্র হয়ে! সেখানে পুরো পৃথিবীটাই তার পাঠশালা। একটি মানবশিশু তার জন্মের পর প্রথম তিন বছরে যত কিছু শেখে, সেটা নাকি বাকি সারা জীবন যত নতুন কিছু শেখে তার সমান! যে শিশু জন্মের পর মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারে না, ধীরে ধীরে কেমন করে সে ধরণির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হয়ে ওঠে, সে কথাই বলব আজ।
জন্ম
মানব ভ্রূণের বয়স ৩৫ সপ্তাহ হয়ে গেলেই মায়ের গর্ভে থাকা তার জন্য অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে। কারণ, এই অবস্থায় শিশুর চাহিদা এত বেড়ে যায় যে মায়ের শরীর তাকে ক্রমাগত শক্তি, জায়গা বা খাবার সরবরাহ করতে পারে না। শিশুর প্রথম পৃথিবীতে আগমন একটা বড় ধরনের ধাক্কার মতো। জীবনের প্রথম দিনটি তাই প্রত্যেক শিশুর জন্য খুবই কঠিন। জন্মের ঠিক এক সেকেন্ড আগ পর্যন্ত সে ছিল নিশ্চিন্ত, নির্ভার। তার সব চাহিদা পূরণ করত তার মা। মায়ের গর্ভে নির্দিষ্ট উষ্ণতায় সে থাকত। গর্ভে থাকাকালে তাকে নিজে খেতেও হয়নি, এমনকি অক্সিজেনের জন্য নিশ্বাসও নিতে হয়নি। অথচ জন্মের পর তার নিজের বেঁচে থাকার জন্য এসব কাজ তার শরীর নিজ থেকে করা শুরু করে। ডেলিভারি রুমের ঠান্ডা হাওয়ায় প্রথম সে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়।
এত দিন তার ফুসফুস ছিল একদম অকেজো। ফুসফুস ভরা ছিল অ্যামনিয়োটিক তরলে। প্রথমবার শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসে তরলের জায়গায় স্থান পেল বাতাস। এ এক বিরাট কর্মযজ্ঞই বটে! অন্যান্য অঙ্গ, যেগুলো এত দিন অলস ছিল, সেগুলোও কাজ করা শুরু করে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্ত্র কর্মক্ষম হয়ে যায়। এ সময় অন্ত্রের মধ্য দিয়ে গাঢ় সবুজ রঙের মিকোনিয়াম নামের একধরনের তরল শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এরপরই শিশুর খাদ্যনালি দুধ হজম করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। অবশ্য মার্বেল সাইজের একটা ছোট্ট পাকস্থলীতে ফ্যাট–সমৃদ্ধ দুধ হজম হয় না সহজে। তবে মায়ের প্রথম দুধ বা শালদুধ সদ্য কর্মক্ষম পাকস্থলীতে সহজে হজম হয়ে যায়। এতে থাকে কোলোস্ট্রাম। এটি শিশুর খাদ্যনালি সঞ্চালনে সাহায্য করে। এর সবচেয়ে বড় গুণ হলো এতে থাকে নবজাতকের রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি। যদিও প্লাসেন্টাতে থাকার সময়, মায়ের শরীর অ্যান্টিবডি দিয়ে ভ্রূণকে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর দূষিত পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করতে তার চাই কোলোস্ট্রামে থাকা অ্যান্টিবডি। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুশরীর নিজ থেকেই অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করতে শুরু করে।
পৃথিবীর আলো দেখার আগেই শিশু প্রাকৃতিকভাবে কিছু আচরণ করতে শেখে। চোখের পলক ফেলা, খাবার গেলা বা মল–মূত্র ত্যাগ করা তাকে শিখতে হয় না। জন্ম থেকেই এই গুণ নিয়ে জন্মায় মানবশিশু। আরও কিছু সাধারণ সহজাত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যেমন গাল স্পর্শ করলে মুখ নিজে থেকে হাঁ হয়ে যাওয়া অথবা হাতের তালু বা পায়ের পাতা স্পর্শ করলে আঙুল গুটিয়ে ফেলা।
প্রথম সপ্তাহ
নবজাতকের প্রথম সপ্তাহের পাঠক্রমে থাকে যোগাযোগের দক্ষতা অর্জন। সে শব্দ শুনতে পারে, কোথাও শব্দ হলে তা বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে কাছে থাকা মানুষের চেহারা চিনতে পারে। সপ্তাহখানেক পর তার এই দক্ষতা আরও বাড়ে। প্রথম সপ্তাহে নবজাতক কেবল তার চোখের সামনে থাকা বস্তু দেখতে পায়। চোখ ঘুরিয়ে দেখার দক্ষতা তখনো সে অর্জন করে না। নিজের হাত-পা দেখতে পেলেও এগুলোকে কী কাজে ব্যবহার করতে হয়, তা সে তখনো বুঝে উঠতে পারে না। এ জন্য বেশির ভাগ সময়ই তার হাত থাকে মুষ্টিবদ্ধ। এ সময় তার খাদ্যনালি ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের এনজাইম তৈরি করা শুরু করে।
দুই মাস বয়সী শিশু
যেহেতু শিশু বেশির ভাগ সময়ই খেয়ে আর ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়, এ সময় তার শারীরিক বৃদ্ধি হয় খুব দ্রুত। গর্ভে থাকাকালে শিশুর শরীরে কোষসংখ্যা বাড়ে। জন্মের পরও কোষের আকার বাড়ে। মাংসপেশি ও স্নায়ুকোষের ভেতরে আগে যেখানে তরল ছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে সাইটোপ্লাজম দিয়ে ভরে ওঠে। মাংসপেশি প্রসারিত হতে শুরু করে। স্নায়ুকোষগুলো মস্তিষ্কে আরও জটিল থেকে জটিলতর সংযোগ স্থাপন শুরু করে। নতুন শক্তি সঞ্চার করে মাস পার করা শিশু যেন ব্যালেন্স ফিরে পায়। এলোমেলো শারীরিক চলন বাদ দিয়ে অনেক গোছানো হতে শুরু করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নড়াচড়া। চামড়ার নিচে চর্বি জমা হয়ে তার শরীরকে উষ্ণতা দেয়। দুই মাসেই মানবশিশু সামাজিকতা শিখে ফেলে। সে লোকজনকে চিনতে পারে, হাসতে পারে, কাঁদতে পারে।
অর্ধবছর পূর্তিতে
১৬ সপ্তাহ পার হলেই শিশু মাথা শক্ত করে ব্যালেন্স রাখতে পারে। বসতে পারে সোজা হয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে চলতে পারে, কোনো কিছু ধরে দাঁড়ানোও শিখে যায়। চোখ আর হাত একসঙ্গে ব্যবহার করতে পারে। হাতে কিছু ধরে রাখতে পারে। তবে হাতের জিনিসকে আরও ভালোভাবে পরখ করার জন্য সে সব জিনিস মুখে দিয়ে ফেলে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন জিনিস ধরে অন্যের হাতে পৌঁছে দিতে পারে।
বিভিন্ন রং সম্পর্কে তার ধারণা হয় ছয় মাস বয়স থেকেই। অন্যের মুখের ভঙ্গি সে নকল করতে চেষ্টা করে। মুখ দিয়ে ছোট ছোট শব্দ যেমন ‘বা’, ‘গা’, ‘ডা’ করে সে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। শিশুর নাম ধরে ডাকলে সাড়া দিতে পারে।
এই যে এত কিছু নতুন শিখতে হয় ছয় মাস বয়সী শিশুকে, তার জন্য তরল দুধ আর পর্যাপ্ত থাকে না। তাকে শক্তির জোগান দিতে শক্ত খাবার দেওয়া শুরু করতে হবে। এ সময় তার খাদ্যনালিও শক্ত খাবার নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। নবজাতকের হজমশক্তি থাকে কম। কারণ, তার খাদ্যনালি সব এনজাইম তৈরি করতে পারে না। আবার তার পাকস্থলী কাজ করে ভিন্ন pH মাত্রায়। কিন্তু ছয় মাসেই খাদ্যনালি পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করে। পাশাপাশি শক্ত খাবার চিবিয়ে খাওয়ার জন্য মাড়িতে দেখা যায় নতুন দাঁত।
প্রথম জন্মদিন
এক বছরে পা দেওয়া শিশুটি এখন আর নিতান্তই অসহায় নয়। এখন তার দক্ষতা অনেক। বস্তুকে সঠিকভাবে সে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। সে নিজের চাহিদা অনুযায়ী ভাব প্রকাশ করতে পারে। মাথা ঝাঁকিয়ে, হাত নাড়িয়ে সাড়া দিতে পারে। আধো আধো বোলে সাধারণ শব্দ উচ্চারণ করতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নতুন পাঠ হলো নিজ পায়ে হাঁটতে শেখা। মস্তিষ্কে মিলিয়ন মিলিয়ন স্নায়ুসংযোগ বাড়তে থাকে। ফুসফুসের বায়ুথলির সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা করতে পারে।
এই গেল মানুষের জীবনের প্রথম বছরের সারকথা। কী অসহায় আর করুণ অবস্থাতে জন্ম হয় মানবশিশুর। অথচ এই শিশুই একদিন হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান আর শক্তিধর প্রাণী।