আমি, তুমি নাকি আমরা?

ইমেরা শব্দটা শুনেছেন? ওই যে গ্রিক পুরাণের এক কাল্পনিক দৈত্য, যার শরীরটা সিংহের মাথা, ছাগলের দেহ ও সাপের লেজের সমন্বয়ে তৈরি। এখন অবশ্য কাইমেরা শব্দটি এই দৈত্যকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয় না। বরং একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি জিনিসের মিশ্রণ বোঝায় শব্দটি। জীবজগতে কিন্তু কাইমেরা এই গ্রিক পৌরাণিক কাহিনির চেয়েও পুরোনো। লক্ষ-কোটি বছরের অভিযোজন আমাদের শরীরে কাইমেরিক কোষের উদ্ভব ঘটায়।

১৯৫০ সালের দিকের সময়টাতে আর্থ্রাইটিস বা লুপাসের মতো রোগ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়। এই রোগগুলোকে বলা হয় অটোইমিউন রোগ। শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা শরীরের বিরুদ্ধেই সক্রিয় হয়ে উঠলে এসব রোগ হয়। আসলে আমাদের রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাগুলো সাধারণত শরীরের বিরুদ্ধে কাজ করে না। কারণ এগুলো আমাদের শরীরের সবকিছুর চেহারা তথা নিজস্ব অ্যান্টিজেনকে চেনে। যেসব জিনিস বাইরে থেকে আসে, যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ভিন্ন গ্রুপের রক্ত ইত্যাদি বহিরাগত অ্যান্টিজেনকে শনাক্ত করে ধ্বংস করে ফেলে। কিন্তু কখনো কখনো এসব প্রতিরোধব্যবস্থা বিদ্রোহ করে বসে এবং কোনো শরীরের অভ্যন্তরীণ অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধেই কাজ শুরু করে। আগে ধারণা ছিল রোগগুলো মেয়েদের যৌন হরমোনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই এ ধরনের রোগ সাধারণত মেয়েদের বেশি হয়। ১৯৮০ সালের দিকে আর্থ্রাইটিস নিয়ে গবেষণার সময় বিজ্ঞানী লি নেলসনের মনে হলো, যৌন হরমোনের সঙ্গেই যদি সম্পর্ক থাকবে, তাহলে রোগের প্রকাশ তো শিশুদেরই হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যায় রোগটি মূলত প্রাপ্তবয়স্কদের হয়। তবে কি এত বছরের এসব ধরাণা ভুল? এই চিন্তা নিয়েই কেটে গেল আরও অনেক বছর।

১৯৯৪ সাল। লি নেলসনের কাছে হঠাত্ তাঁর সহকর্মীর একটি ফোন এল। তিনি এক নারীর রক্তে পুরুষ ডিএনএর সন্ধান পেয়েছেন এবং ওই নারী এক বছর আগে একটি ছেলে জন্ম দিয়েছিলেন। নেলসন ভাবতে শুরু করলেন, এই বহিরাগত ডিএনএ মায়ের শরীরে কীভাবে টিকে আছে? মায়ের শরীরের ওপর এর প্রভাবই বা কিরূপ হতে পারে? যেহেতু মা ও বাবা উভয়ের ডিএনএ মিলিত হয়ে সন্তানের ডিএনএ তৈরি করে, তাই মায়ের শরীরের ভেতরে সন্তান জিনগতভাবে অর্ধবহিরাগত বিবেচিত হওয়ার কথা। তাহলে নিশ্চয়ই গর্ভাবস্থায় এমন কিছু ঘটে, যাতে দেহের প্রতিরোধক কোষগুলো সন্তানের কোষ ধ্বংস করে দেয় না!

গর্ভাবস্থায় সন্তান ও মায়ের শরীরের মধ্যে অনেক কোষের আদান-প্রদান হয়—এ আবিষ্কারটা বেশ পুরোনো। ১৮৯৩ সাল। জার্মান চিকিত্সাবিদ জর্জ গর্ভাবস্থায় হাইপারটেনসিভ ব্যাধির কারণে মায়েদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি মৃত মায়েদের শরীরে কিছু কোষ পেলেন, যেগুলো গর্ভাবস্থায় অমরাতে (মা ও শিশুর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে এই নালি, যার কিছু অংশ মায়ের ও বাকি অংশ ভ্রূণকোষ দিয়ে গঠিত) পাওয়া যায়। জর্জ দেখলেন, সুস্থ-স্বাভাবিক গর্ভবতী মায়েদের দেহেও এসব কোষ দেখা যায়। পরে বিজ্ঞানীরা দেখান, আসলে গর্ভধারণের এক সপ্তাহের ভেতরেই কোষের আদান-প্রদান শুরু হয়। আর মা ও শিশু একে অপরের অংশে পরিণত হয়। গর্ভাবস্থায় মায়ের রক্তের ১০ শতাংশ ডিএনএ আসে ভ্রূণ থেকে, যদিও জন্মদানের পর এর পরিমাণ অনেক কমে যায়, কিন্তু তারপরও কিছু কোষ রয়ে যায়। অপর দিকে সন্তানের শরীরে মায়ের শরীর থেকে আসা কোষগুলো আবার বংশবৃদ্ধিও করে এবং প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়ও এদের উপস্থিতি দেখা যায়। এমনকি গর্ভপাত কিংবা গর্ভস্রাব হলেও এই কোষগুলো মায়ের শরীরে দেখা যায়। অর্থাৎ এই কোষীয় আদান-প্রদান ভ্রূণের পুরোপুরি বৃদ্ধি কিংবা জন্মদানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং গর্ভধারণের সঙ্গে সম্পর্কিত।

মায়ের শরীরে প্রথম সন্তানের যে ডিএনএ ও কোষ আসে, তা কিন্তু পরবর্তী গর্ভধারণের সময় ভ্রূণের শরীরে প্রবেশ করে। অর্থাৎ, মায়ের শরীরের মাধ্যমে ভাই-বোনদের মধ্যেও ডিএনএর আদান-প্রদান ঘটে! কোনো মেয়েসন্তান তার মায়ের শরীর থেকে যে কোষ পায়, তা কিন্তু তার সন্তানের শরীরেও যেতে পারে। তাই বংশপরম্পরায় এই ডিএনএ বা কোষগুলোর আদান-প্রদান চলতে থাকে। বিজ্ঞানীরা লক্ষ করলেন, ভ্রূণ থেকে আসা কোষগুলো শুধু রক্তে নয়, বরং মায়ের পুরো শরীরেই থাকে, এমনকি হৃৎপিণ্ডের অংশেও পরিণত হয়! তার মানে দাঁড়াল, মায়েরা তাঁদের শরীরে তিন ধরনের কোষ বহন করেন—মা থেকে পাওয়া কোষ, নিজস্ব কোষ এবং সন্তানের ভ্রূণ থেকে পাওয়া কোষ। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন মাইক্রোকাইমেরা। মাইক্রো, কারণ এর ফলে মায়ের বাহ্যিক পরিবর্তন হয় না।

প্রশ্ন হলো, মায়ের শরীরের রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে কী করে এই কোষগুলো প্রবেশ করে এবং টিকে থাকে? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো জানা যায়নি। তবে কিছু বিজ্ঞানীর ধারণা, যেহেতু কোষগুলোর মায়ের কোষের সঙ্গে অর্ধেক মিল রয়েছে, তাই হয়তো তারা কোনোভাবে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারে। আবার কেউ কেউ ধারণা করেন, হয়তো গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার কার্যকলাপ ভিন্ন ধরনের হয়। হয়তো লক্ষ-কোটি বছর ধরে অভিযোজনের ধারাই মায়েদের শরীরকে এভাবেই সন্তান ধারণের উপযোগী করে তুলেছে।

এই মাইক্রোকাইমেরা কিন্তু শুধু গর্ভাবস্থায়ই দেখা যায় তা নয়; ১৯৯০ সালের দিকে বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেন, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সময়ও এরূপ কোষীয় আদান-প্রদান ঘটে থাকে। মাইক্রোকাইমেরা সম্পর্কে জানার পর বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, হয়তো গর্ভপাত বা মাতৃমৃত্যুর উচ্চহারের জন্য মাইক্রোকাইমেরা দায়ী। কিন্তু পরে আবিষ্কৃত হয় বিস্ময়কর ব্যাপার—দেখা গেল ভ্রূণ থেকে প্রাপ্ত এই কোষগুলো বরং মাকে অনেক রোগ থেকে রক্ষা করে। দেহের কোনো সাধারণ ক্ষত কিংবা সিজারিয়ান ক্ষত পূরণে এবং নতুন রক্তনালি তৈরিতে এই কোষগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখে। সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, এই কোষগুলো আকস্মিকভাবে কোনো কারণ ছাড়াই মায়ের শরীরে আসে না। প্রথম ভ্রূণ থেকে আসা কোষগুলো পরবর্তী গর্ভধারণের জন্য মায়ের শারীরিক ও জিনগত সুস্থতা ও উপযুক্ততা বজায় রাখে এবং মাইক্রোকাইমেরিক কোষগুলো ভাইবোনদের জিনগত মিল রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া এই কোষগুলো পরবর্তী ভ্রূণের ক্যানসার, অ্যালজাইমারসহ অনেক রোগের ঝুঁকি কমাতে এবং বিভিন্ন রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে দৃঢ় রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

শুরুতে নেলসন ও তাঁর আর্থ্রাইটিস নিয়ে গবেষণার কথা বলেছিলাম। কেন মেয়েদের মুখ্য প্রজননের বয়সগুলোতে আর্থ্রাইটিস হতে দেখা যায় না? এর কারণ খুঁজতে গিয়ে নেলসন মাইক্রোকাইমেরিক কোষের সংযোগ খুঁজে পান। নেলসনের মতে, এ কোষগুলো রীতিমতো এসব রোগের ক্ষেত্রে অনেকটা ভ্যাকসিনের মতো কাজ করে। যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা সাধারণত গর্ভধারণ করেন না এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মাইক্রোকাইমেরিক কোষগুলোর পরিমাণ কমতে থাকে, তাই তখন অটোইমিউন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ভাবতে পারেন, এই কোষগুলো নাকি মায়েদের দীর্ঘায়ুর সঙ্গেও সম্পর্কিত! ২০১২ সালে ডেনমার্কের প্রায় ৩ হাজার নারীর ওপর এক জরিপ থেকে এ ধারণা পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

মাইক্রোকাইমেরিক কোষগুলো যে শুধু মায়ের জন্য উপকারী তা কিন্তু নয়। এই কোষগুলো মায়ের শরীরকে সন্তান জন্মদানের জন্য বিভিন্নভাবে সহায়তা করে। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত হ্রাস পায়। এ ছাড়া মাতৃদুগ্ধ উত্পাদন এবং পরবর্তী গর্ভধারণের সময়ক্ষেপণ করার মাধ্যমে এই কোষগুলো সন্তানের ভবিষ্যৎ খাদ্য ও আশ্রয় সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এভাবেই প্রকৃতিতে প্রজাতির অতি প্রাচীন ও ক্রমোন্নত ধারা বজায় রাখার চেষ্টা চলছে।

সূত্র: এইয়েন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, নেচার