মেনডেল: একজন অনুসন্ধিৎসু যাজক

৬ জানুয়ারি ছিল জীববিজ্ঞানী, জিনতত্ত্বের জনক গ্রেগর জোহান মেনডেলের ১৩৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই বিজ্ঞানীকে বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা।

জোহান গ্রেগর মেনডেলের জন্ম ১৮২২ সালের ২২ জুলাই। সে সময়ের হ্যাবসবার্গ সাম্রাজ্যে, বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রে। বাবা অ্যান্টন মেনডেল ছিলেন কৃষক, ভূ-স্বামীর অধীনে কাজ করতেন। তবে নিজস্ব জমিজমা এবং সম্পত্তির বিচারে তিনি হতদরিদ্র ছিলেন, বলা যাবে না। মেনডেল পরিবার যেখানে থাকতেন, সেখানে কাজের পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল। ফলে ছেলে একটু পরিণত হয়ে পৈতৃক কাজে-কর্মে লেগে যাবে—এমনটাই ইচ্ছা ছিল তাঁর বাবা-মায়ের। কিন্তু প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি হয়ে যান।

স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর পরই তাঁর মেধা শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এমন মেধাবী ছেলে গ্রামের সাদামাটা এক স্কুলে পড়ে মেধার অপচয় করবে! তাই শিক্ষকেরা তাঁকে উন্নতমানের একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ তৈরি করে দেন। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে পরের বছর প্রবেশ করেন উচ্চবিদ্যালয়ে। প্রথম দিকে ছেলেকে নিয়ে উচ্চ স্বপ্ন না দেখলেও পরে কিন্তু বাবা-মা ছেলের লেখাপেড়ার খরচ জোগাতে কার্পণ্য করেননি। ছেলের পড়াশোনার খরচ দিয়ে গেছেন নিয়মিত। কিন্তু পরে প্রতিকূল আবহাওয়ায় ফসল আর ঠিকমতো হচ্ছিল না। ফলে অর্থের জোগান বন্ধ হয়। বাধ্য হয়ে মেনডেলকে তখন গৃহশিক্ষকের কাজ বেছে নিতে হলো। পাশাপাশি নিজের পড়াশোনাটাও চালিয়ে গেলেন।

১৮৪০ সালে যখন বিদ্যালয়ের পাঠ সম্পন্ন হয়, তখন মেনডেলের বয়স আঠারো বছর। সেকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে অতিরিক্ত দুই বছর দর্শন পাঠ বাধ্যতামূলক ছিল। একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি দর্শন পাঠ শেষ করেন। তবে সময়টা মেনডেলের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না। একে তো আর্থিক সমস্যা, অন্যদিকে মানসিক অসুস্থতা। মেনডেলের একটা বড় সমস্যা ছিল, তিনি মানসিক চাপ একদমই নিতে পারতেন না। চাপা উত্তেজনা তাঁর স্নায়ুর ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলত। এই মানসিক অস্থিরতা তাঁকে পীড়া দিয়ে গেছে আমৃত্যু। এরই মধ্যে তাঁদের পৈত্রিক সম্পত্তি বোনদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। মেনডেল স্ব-ইচ্ছায় খামারবাড়ির কর্তৃত্ব ছেড়ে দেন। ফলে সেটার দায়িত্বভার পড়ে তাঁর বড় বোনের স্বামীর ওপর। মেনডেলের আর্থিক সমস্যা তখন তুঙ্গে। তখন ছোট বোন তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পদার্থবিজ্ঞান, দর্শনশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র ও গণিত পড়া শুরু করেন। আর্থিক ও মানসিক অস্থিতিশীলতার কারণে শেষ অব্দি তা সম্পন্ন করতে পারেননি। ১৮৪৩ সালে তিনি ব্রুনোর সেন্ট টমাস আশ্রমে চাকরির জন্য আবেদন করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সহায়তায় খুব সহজেই সেটা পেয়ে যান।

আশ্রমে গিয়ে মেনডেল পছন্দের পরিবেশটাই পেয়েছিলেন। সহকর্মীরা সকলেই ছিলেন আন্তরিক, মঠাধ্যক্ষ ছিলেন যরপরনাই বিনয়ী মানুষ। ব্রুনোর অগাস্টিনীয় আশ্রমের মঠাধ্যক্ষ ছিলেন এফ সি ন্যাপ। এই লোকটা মেনডেলের ভেতরকার প্রতিভা দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান পড়তে উৎসাহ দিতেন তিনি। আশ্রমে কর্মরত সকলেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। সেখানে গ্রন্থাগার ছিল, ছিল পাঠোপযোগী পরিবেশ। তাছাড়া আশ্রমের অনেকেই ব্রুনোর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন। ন্যাপ নিজেও শিক্ষক ছিলেন।

আশ্রমে মেনডেলের কাজ ছিল হাসপাতালে গিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের ধর্মীয় সান্ত্বনা দেওয়া। খুব শিগগির এ কাজে মেনডেলের বিতৃষ্ণা চলে আসে। ন্যাপের কাছে এ কাজ থেকে অব্যহতি দিতে অনুরোধ জানান তিনি। তাঁর বাসনা ছিল শিক্ষকতা করার। তিনি নিজেই বলতেন যে প্রাকৃতিক জ্ঞানের সমুদ্রে ডুবে থাকাই ছিল তাঁর সবচেয়ে পছন্দের কাজ। ন্যাপ সেটা ভালো করেই জানতেন। স্থানীয় একটি স্কুলে মেনডেলের জন্য সুপারিশ করেন তিনি। মেনডেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেননি, তাই স্কুলের চাকরি পাওয়ার সহজ ছিল। কিন্তু ন্যাপের সুপারিশে মেনডেলের একটা গতি হয়, যদিও বেতন অন্যদের অর্ধেক। পূর্ণ বেতনভুক্তির সুবিধা পেতে কয়েক স্তরের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও উত্তীর্ণ হয়ে তবেই শিক্ষকদের খাতায় নাম লেখাতে হতো। মেনডেল সেই রকম একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তাঁকে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাকৃতিক ইতিহাস পড়ার পরামর্শ দেন ন্যাপ।

মেনডেল ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু বছর পড়াশোনা করেন। তাঁর পরবর্তী বৈজ্ঞানিক জীবনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। এখানেই মেনডেলের পরিচয় হয় সে সময়ের সেরা সব জীববিজ্ঞানী ও পদার্থবিজ্ঞানীদের সঙ্গে। এ সব পরিচিতিই মূলত মেনডেলকে তাঁর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে সাহায্য করেছিল। পদার্থবিজ্ঞানের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান ডপলারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল এখানে। পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত তাঁর পাঠ্যবিষয় ছিল। এখানে শেখা বা জানা বিষয়গুলোর একটা প্রভাব দেখা যায় তাঁর পরবর্তী বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। প্রাকৃতিক ঘটনাবলী ব্যাখ্যায় গণিতের প্রয়োজনীয়তা ও এর ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারেন পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে।

বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী ফ্রাঞ্চ আংগার ছিলেন তাঁর শিক্ষক। উদ্ভিদের ক্রমবিকাশ, সঙ্করায়ণ ইত্যাদি ছিল আংগারের গবেষণার বিষয়। তখন মনে করা হতো যে একই প্রজাতির দুটি ভিন্নধর্মী উদ্ভিদের মধ্যে প্রজনন ঘটানো হলে প্রথম প্রজন্মে সব সমধর্মী বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রজন্মের উদ্ভিদগুলো নিয়ে পুনরায় প্রজনন ঘটানো হলে দ্বিতীয় প্রজন্মে এসে মূল উদ্ভিদ প্রজাতির কিছু বৈশিষ্ট্য আবারও প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এই সব বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য কোন গাণিতিক সংখ্যা ব্যবহার করা হতো না। এরই মাঝে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এল এল লিট্রোর প্রকৃতির জ্ঞান অন্বেষণে সম্ভাব্যতার নীতির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। মেনডেল নিয়মিত এসব বিষয়ে খোঁজখবর রাখতেন ও গুরুত্ব উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন।

১৮৫৩ সালে মেনডেল তাঁর ব্রুনোতে ফিরে আসেন এবং আশ্রমের কাজে নিয়োজিত হন এবং একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রাকৃতিক ইতিহাস ও পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পাশাপাশি শুরু করেন মটরশুঁটি নিয়ে তাঁর সেই বিখ্যাত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা—বংশগতি কী এবং প্রজন্মান্তরে কীভাবে তার প্রকাশ ঘটে? উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে আবিষ্কার করে বসেন শতাব্দীর অন্যতম চাঞ্চল্যকর ঘটনা—বংশপরম্পরায় মিল-অমিলের পরিসংখ্যান। এই বিষয়টিকেই আমরা এখন জেনেটিকস বলে জানি। মেনডেলের জীবদ্দশায় তাঁর আবিষ্কার কোনো তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। অনেকটা নীরবেই তাঁর কাজগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়, বিখ্যাতদের কাজের আড়ালে। বংশগতি ছাড়াও মেনডেল বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আবহবিদ্যা সেরকমই একটি শাখা। মৌমাছির কৃত্রিম প্রজননেও তিনি সফলতা অর্জন করেন।

১৮৬৮ সালে ন্যাপের মৃত্যুর পর আশ্রমের গুরুদায়িত্ব গিয়ে পড়ে মেনডেলের ওপর। মেনডেল আশ্রমের মঠাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। এর পর তিনি গবেষণায় কতটা মনোনিবেশ করতে পেরেছিলেন সে বিষয়ে মতভেদ আছে। তবে তিনি যে আশ্রমের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ ছিলেন, সে বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন একজন সফল ধর্মযাজক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে ছিলেন একজন সফল জীববিজ্ঞানী। ১৮৮৪ সালের ৬ জানুয়ারি সকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফ্রাঞ্চ বারিনা নামে এক সহকর্মী মেনডেলের মৃত্যুর আগমুহূর্তের কিছু কথা লিখে গিয়েছেন—

‌‘যদিও জীবনে আমাকে অনেক কষ্টকর মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তবু যেসব সুন্দর ও ভালো অভিজ্ঞতাও হয়েছে আমার সেগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই হবে। আমার বৈজ্ঞানিক কাজগুলো আমাকে অনেক বেশি সন্তুষ্টি এনে দিয়েছে এবং আমি মনে করি যে বিশ্ব একদিন ঠিকই আমার কাজের স্বীকৃতি দেবে।’

এ মন্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে মেনডেলের জীবদ্দশায় তাঁর কাজগুলোকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। এখন আমরা জানি, মেনডেলের কাজগুলো পরবর্তী বংশগতিবিদ্যা বা জেনেটিকসের পথ করেছে সুগম। এ কারণেই তাঁকে বলা হয় ফাদার অফ জেনেটিকস বা ‌‌‌বংশগতিবিদ্যার জনক।

লেখক: চিকিৎসক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ