এখন অবশ্য আমরা জানি যে, প্রজাপতির ডিম, শূককীট (সচল অবস্থা) মূককীট (অনড় অবস্থা) ও পরিণত অবস্থার মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ সুন্দর প্রজাপতিরূপে আমাদের চোখের সামনে উড়ে বেড়ায়।
আমাদের চারপাশের জীবজগতের সাধারণ সদস্য ও এদের জীবনবৃত্তান্ত যদি লক্ষ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে এদের জন্মগত শিশু-অবস্থা সাধারণত একই রকমের হয়ে থাকে। যেমন মানুষের শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর এটা যে মানবশিশু তা বলে দিতে হয় না। কেননা এদের চেহারা-আঙ্গিক মা-বাবার মতোই। হাতির বাচ্চার বা জিরাফ, হরিণের বেলায়ও তাই দেখা যায়। তেমনিভাবে আমরা যদি প্রাণিজগতের শ্রেণি-পর্বগুলো সাজাই-বাছাই করি যেমন: স্তন্যপায়ী (ম্যামেলিয়া), পাখি (অ্যাভিস), সরীসৃপ (রেপ্টাইলিয়া) পর্যন্ত এই তালিকাধারাটি অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু উভচর (অ্যাম্ফিবিয়া) ব্যাঙের শিশু দেখতে ব্যাঙ বলে মনে হয় না। ব্যাঙাচির মাছের মতো থাকে একটা লম্বা লেজ। তাই ব্যাঙের শিশুর চেহারা ব্যাঙের চেয়ে বেশ খানিকটা আলাদা হয়। এমনিভাবে আমরা যদি অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের দিকে তাকাই, তখন দেখা যাবে যে পরিণত প্রাণীর সঙ্গে এদের সদ্য ডিম থেকে বেরিয়ে আসা অপরিণত অবস্থাটির কোনো মিল নেই। এ অবস্থা বিবেচনায় কীটপতঙ্গ শ্রেণির (সংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর সর্ববৃহত্ প্রাণী দল) মধ্যে এই ধারার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ পরিণত কীটপতঙ্গের সঙ্গে এদের অপরিণত অবস্থার কোনো মিল নেই। উদাহরণস্বরূপ ধরা যায়, বিছাপোকা বা ‘বিচ্ছু’ ও প্রজাপতি। প্রজাপতির ডিম ফুটে যে শূককীট বের হয়, তার শরীর অসংখ্য লোম বা শুঁয়ায় ভরা। শূককীট বের হয়ে আসে, তা এখনো অনেকে বিশ্বাস করে না যে, এটি শিশু প্রজাপতি বা বিছাপোকারই জীবনচক্রের প্রাথমিক পর্যায়। আমাদের দেশে কেন, আদি বিজ্ঞান ও সভ্য দেশ ইউরোপীয়রা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত তা গ্রহণ করেনি। এখন অবশ্য আমরা জানি যে, প্রজাপতির ডিম, শূককীট (সচল অবস্থা) মূককীট (অনড় অবস্থা) ও পরিণত অবস্থার মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ সুন্দর প্রজাপতিরূপে আমাদের চোখের সামনে উড়ে বেড়ায়। এর আরেকটি বড় উদাহরণ হলো—রেশম গুটি। সেই গুটি থেকে আমরা পাই অতি মূল্যবান সিল্ক সুতা। আমাদের দেশে কেন, ফ্রান্স, চীন, জাপানেরও বাণিজ্যে এই রেশমি সুতা যথেষ্ট গুরুত্ব পায়।
কীটপতঙ্গ জগতে ডিম, শূককীট, মূককীট ও পরিণত অবস্থার মধ্য দিয়ে যে পূর্ণতা লাভ করে তাকে জীবজগতের ভাষায় ‘রূপান্তর’ বা ‘Metasmphosis’ বলে। এদের বর্ধন ও আকৃতিগত পরিবর্তন দুই-ই পর্যায়ক্রমিকভাবে যে শারীরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত হয়, তাকে জীববিজ্ঞানীরা ‘নির্মোচন’ (moulting) নামে অভিহিত করেছেন। নির্মোচন বলতে দেহ-জিনের তুলনায় ছোট বহিঃত্বককে বর্জন ও নতুন বড় বহিঃত্বকের পুনর্জন্মকে বোঝায়।
আমরা জানি, কীটপতঙ্গজগেক প্রধানত দুই দলে ভাগ করা হয়—ক. অপক্ষল কীটপতঙ্গ (পাখাবিহীন) ও খ. পক্ষল কীটপতঙ্গ। কীটপতঙ্গের জীবনধারায় ‘রূপান্তর’ যেমন, বিছাপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে ওঠা ‘পক্ষল’ কীটপতঙ্গ দলের একটি উত্কৃষ্ট উদাহরণ। অন্যদিকে অপক্ষল কীটপতঙ্গে এই ক্রমবর্ধনের সময় ও আকৃতির পরিবর্তন খুব সামান্য হয়। এগুলোর মধ্যে রুপালি মাছ বা ‘সিলভার ফিশ’ (Lepisma) সচরাচর আমাদের চোখে পড়ে। পুরোনো বইপত্র ও কাগজ ঘাটাঘাটির সময় এগুলো দ্রুত বেরিয়ে পালিয়ে যায়। এগুলো আমাদের বইপত্রের যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে। এদের বিমোচনচক্র সীমিত নয়—মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চলতে থাকে।
সাধারণভাবে এটা ধরে নেওয়া হয় যে কীটপতঙ্গের আকৃতিগত ভারসাম্য এদের উপচর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (moults)। যেমন এডিস ‘ইজিপটাই’, এদের জটিল চোখ গঠনের সময় উপচক্রীয় কোষ নির্মোচন গ্রন্থিরসের সহায়তায় বিভাজিত হয়ে গড়ে ওঠে।
বর্তমানে জানা গেছে, কীটপতঙ্গের রূপান্তর, গ্রন্থিরস বা হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ ‘শূককীট-মূককীট ও পরিণত অবস্থার স্তরগুলো চারটি বিশেষ গ্রন্থিরসের নিঃস্বরণী উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এগুলোর প্রধান নিয়ন্ত্রক স্নায়ুনিঃসরণী কোষ কীটপতঙ্গের মগজে থাকে। এ জন্য মাথাবিহীন শুঁয়াপোকায় নির্মোচন বন্ধ হয়ে যায়। এই চারটি হরমোনের পারস্পরিক বিক্রিয়ায় কীটপতঙ্গের ডিম, শূককীট, মূককীট ও পরিণত অবস্থায় পৌঁছে যায়।
সুতরাং দেখা যায়, কীটপতঙ্গের রূপান্তর একটি সুশৃঙ্খল রাসায়নিক বিক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় কার্যকরণ-ধারার ওপর বর্তমান সময়ের বহু বিজ্ঞানী কাজ করছেন এবং এসবের নিত্যনতুন ফল প্রকাশিত হচ্ছে।
বিড়ালের বাচ্চা (দেখতে মা-বাবার মতো), ব্যাঙাচি (লেজওয়ালা অনেকটা মাছের মতো) আবার শুঁয়াপোকা (প্রজাপতির মতো মোটেই নয়)—প্রকৃতির এমন সব বিচিত্র আচরণের কারণ কী? উত্তর সহজ নয়। তবে জীবাশ্মবিজ্ঞানীদের অনুসন্ধান ও তথ্যপ্রকৃতির ‘অভিযোজন’ প্রক্রিয়ার দিকনির্দেশনা দেয়। তাদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, কীটপতঙ্গ ৩৫ কোটি বছরের সময়সীমায় (ডেভোনিয়ান যুগ) আবির্ভূত হয়েছিল। যেখানে মানুষের বয়স মাত্র ৩০-৪০ লাখ বছরের। প্রাণীর ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, জীবজগতের সব সদস্যের নানা অলিগলি পথ ধরে, নানা বৈরী পরিবেশ ও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে হয়েছে। এসব কঠিন পথ ধরে এগিয়ে বহু জীবজ একক (যেমন, ডাইনোসর) বিলুপ্ত হয়ে গেছে। টিকে আছে কীটপতঙ্গ, হয়েছে তাদের ক্রমবিকাশ। এদের চেহারাকৃতি, পরিবেশ, খাদ্যাভাস বারবার পরিবর্তন করতে হয়েছে। এমনকি সুন্দর প্রজাপতিও বিছাপোকা হয়ে রূপ পাল্টে প্রকৃতির নির্বাচন-চালুনিতে টিকে গেছে।
লেখক: সাবেক জ্যেষ্ঠ পরমাণু বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং খণ্ডকালীন অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই, ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত