মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ: ভেন্টিলেটর, আইসিইউ এবং ভুলে যাওয়া ইয়ন ইবসেন

প্রতীকী ছবি

১৯৫২ সাল। কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক। ভয়ংকর এক মহামারির কালো ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে শহরটা। মাত্র ৭ বছর আগে জার্মান সেনাবাহিনীর তৈরি নরক থেকে মুক্তি মিলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল সবাই। এখন শহরের জায়গায় জায়গায় বোমা পড়েনি ঠিকই, কিন্তু ছোঁয়াছে এক রোগ বোমার মতোই মুহুর্মুহু হামলে পড়ছে মানুষের ওপর। বালবার পোলিও।

পোলিওভাইরাসের সংক্রমণের ফলে যে রোগ হয়, তার নাম পোলিও। আর, এর সবচেয়ে নির্মম রূপ এই বালবার পোলিও। আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্কের মোটর নিউরনগুলোতে আক্রমণ করে এটি। অকেজো করে ফেলে। ফলে প্যারালাইজড হয়ে যায় রোগী। শরীরের অন্যান্য অংশ নাড়াতে তো সমস্যা হয়ই, বিশেষভাবে সমস্যা হয় শ্বাস নিতে। সেই সঙ্গে মুখ নাড়ানো, কথা বলা বা কিছু গিলতেও বেশ কষ্ট হয়।

আর সব তো কোনোভাবে ধরে চালিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু যে শ্বাস নিতে পারে না, তাকে বাঁচানোর উপায় কী? ভিভি এবার্ট, ১২ বছর বয়সী এক প্যারালাইজড পোলিও রোগী যখন ড্যানিশ চিকিৎসক ইয়ন ইবসেনের চোখের সামনে ধুঁকে ধুঁকে এগিয়ে যাচ্ছিল মৃত্যুর দিকে, ইবসেন তখন মরিয়া হয়ে উঠলেন। একটি রবার ব্যাগ, একটি বাঁকা নল আর দুহাতের কারসাজিতে মৃত্যুর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এই সাহসী মানুষটি।

ভিভি এবার্ট পরবর্তী জীবনে কাছের মানুষদের ওপরে নির্ভরশীল ছিলেন, কিন্তু বেঁচে ছিলেন আরো অনেক দিন
ছবি: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগ ডট কম

এই গল্প ভিভি এবার্টের। এই গল্প ইয়ন ইবসেনের। এই গল্প কোপেনহেগেনের মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসা সব মানুষের। পরের সাত দশকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থার জন্য বেঁচে যাওয়া লাখো মানুষের। এবং আমাদের। আজ আমরা, আমাদের অনেক আত্মীয়-পরিজন মৃত্যুর সঙ্গে লড়েন আইসিইউতে। শ্বাস নেন ভেন্টিলেটরে। এই গল্প আমাদের সবার।

প্রিয় পাঠক, আসুন, ভেন্টিলেটর আবিষ্কারের সেই গল্প শুনে আসা যাক।   

ভেন্টিলেটর বলতে আমরা যা বুঝি, ১৯৫২ সালের আগে তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তখনো একধরনের যন্ত্র ছিল, যা দিয়ে শ্বাস নিতে অক্ষম, এমন রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হতো। এর নাম ছিল আয়রন লাং (lung)। বাংলা করলে দাঁড়ায়, লৌহ-ফুসফুস।

আয়রন লাং একধরনের নেগেটিভ প্রেশার ভেন্টিলেটর। ১৯০০ সাল থেকেই মানুষ ভেন্টিলেশনের ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিল। কিন্তু আয়রন লাং, যার আরেক নাম ড্রিঙ্কার ট্যাংক, তৈরি হয় ১৯২৮ সালে। ফিলিপ ড্রিঙ্কার ও লুইস আগাসি শ’ নামে দুই বিজ্ঞানী এটি তৈরি করেন। জিনিসটাকে অযথাই আয়রন লাং বা ড্রিংকার ট্যাংক বলা হতো না। তবে নাম দুটোই আলাদাভাবে খানিকটা অসম্পূর্ণ। ছবি দেখার পর এ ব্যাপারে আপনিও একমত হবেন। সত্যি বলতে, এর নাম হওয়া উচিৎ ছিল, আয়রন ট্যাংক। কারণ, আক্ষরিক অর্থে ওটা তা-ই!

আয়রন লাং

একটা লোহার ট্যাংকের ভেতরে একটা বিছানা। রোগীকে সেখানে শোয়ানো হতো। তারপর সিল করে দেওয়া হতো ট্যাংকটি। শুধু মাথা ও গলা বেরিয়ে থাকত। ওখান দিয়ে যেন বাতাস যাওয়া-আসা করতে না পারে, সে জন্য রবার দিয়ে সিল করা থাকত গলার চারপাশে। একটা মোটর দিয়ে চালানো হতো এই আয়রন ট্যাংক। মোটরটি ট্যাংকের ভেতরে, রোগীর দেহের চারপাশের বাতাস বের করে নিত। ফলে, তৈরি হতো আংশিক ভ্যাকুয়াম। এভাবে রোগীর দেহের চারপাশের বদ্ধ জায়গাটুকুতে রুমের তুলনায় ঋণাত্মক চাপ তৈরি করা হতো। সংকুচিত হয়ে যেত রোগীর ডায়াফ্রাম। ফলে, বাধ্য হয়ে ফুসফুস ট্যাংকের বাইরে থাকা নাক ও মুখের মাধ্যমে শ্বাস টেনে নিত (প্রশ্বাস)। আবার, সেটা বের করে দেওয়ার জন্য ভেতরের বাতাসের ওপর রুমের বায়ুমণ্ডলীয় চাপ থেকে বেশি চাপ দেওয়া হতো। ফলে, বেরিয়ে যেত ফুসফুসের বাতাস (নিঃশ্বাস)।

এভাবেই আয়রন লাংনির্ভর চিকিৎসা চলছিল ১৯৫২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু সে বছর এলোমেলো হয়ে গেল সব।

কোপেনহেগেনের ছোট্ট এক হাসপাতাল ব্লেগদাম। গড়ে প্রতিদিন বালবার পোলিও আক্রান্ত ৫০ জনের মতো রোগী আসতে লাগল হাসপাতালে। কিন্তু কেউ তো আর একদিনে সুস্থ হয়ে উঠছে না। তার ওপর গড়ে ৬-১২ জন করে রোগীর শ্বাসতন্ত্র অকেজো হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। এতজনকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো আয়রন লাং কোথায়? তার ওপর, চাইলেই জিনিসটা কেনাও যাচ্ছে না হুট করে। যথেষ্ট দামি এই যন্ত্রগুলো। তা ছাড়া, যাদের গিলতে সমস্যা হয়, তাদের খাবার, থুথু জমে থাকে গলায়। ঋণাত্মক চাপের ফলে এসবও অনেক সময় চলে যায় ফুসফুসে। সুস্থ হওয়ার বদলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে রোগী।

এদিকে, প্রতিদিন নতুন রোগী আসছেই। প্রথম কয়েক সপ্তাহ পরে দেখা গেল, ৮৭% বালবার পোলিও রোগী মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা অর্ধেকের মতো।

ব্লেগদাম হাসপাতালের চিফ ফিজিশিয়ান, মানে প্রধান চিকিৎসক চাই আলেক্সান্ডার ল্যাসেন তখন দিশেহারা। মিটিং ডাকলেন চিকিৎসকদের। কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন অঙ্গরাজ্যের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটাল থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে ফেরা ইয়ন ইবসেনও যোগ দিলেন সেই মিটিংয়ে। বললেন অদ্ভুত এক আইডিয়ার কথা।

ইয়ন ইবসেন

এখানে একটুখানি থামতে হবে। ভাবতে হবে, ঠিক সেই মুহূর্তেই কি অলৌকিকভাবে ইবসেনের মনে উঁকি দিয়ে গিয়েছিল এই বিচিত্র আইডিয়া? নাকি আরও আগে কোথাও ইবসেন এর সন্ধান পেয়েছিলেন? জানতে হলে ফিরে যেতে হবে আরও এক দশক পেছনে।

১৯৪০ সালে মেডিকেল স্কুল শেষ করেন ইবসেন। তারপর প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান ডেনমার্কের উত্তরের এক বিচ্ছিন্ন উপদ্বীপে। ইবসেনের ছেলে টমাসের ভাষ্যমতে, সেখানে স্বাস্থ্যসেবা দিতেন মোটে তিন জন মানুষ। একজন ডাক্তার, একজন ফার্মাসিস্ট এবং একজন পাদ্রী! ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সপরিবারে সেখানেই ছিলেন। সার্জারি থেকে বাচ্চা ডেলিভারি করানো—অনেক কিছুই শিখেছেন হাতে-কলমে। তারপর ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিবার নিয়ে চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন অঙ্গরাজ্যে। যোগ দেন ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে। শেখেন অ্যানেস্থেশিওলজি।

অপারেশনের সময় রোগীর জ্ঞান থাকলেও তিনি যাতে ব্যথা অনুভব না করেন, সে জন্য শরীরের নির্দিষ্ট অংশ অবশ করে ফেলাকে বলে অ্যানেস্থেশিয়া। এর সঙ্গে এখন সবাই পরিচিত। বর্তমানে অ্যানেস্থেশিয়ার জন্য সাধারণত ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করা হয়। সে সময় অ্যানেস্থেশিয়া অত প্রচলিত ছিল না। তা ছাড়া, ক্লোরোফর্মের বদলে ইথার নামের আরেক ধরনের রাসায়নিক সে সময় ব্যবহার করা হতো। আর, এই ইথারের প্রথম সফল ব্যবহার হয়েছিল এই ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালেই।

অর্থাৎ, চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহৃত চমৎকার বেশ কিছু আইডিয়ার সূতিকাগার বলা যায় ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালকে। ইবসেন এখানেই প্রথম ‘ব্যাগিং’য়ের আইডিয়া পান। ব্যাগিং মানে, অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিকভাবে চালানোর জন্য রবারের ব্যাগ ব্যবহার করা। এই ব্যাগ হাতে চাপা হতো। তবে এটি তখনো তেমন প্রচলিত ছিল না। ব্যাগিংকে বলা যায় ‘পজেটিভ প্রেশার ভেন্টিলেশন’। শরীরের চারপাশে ঋণাত্মক চাপ তৈরি করে শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর বদলে, এ ক্ষেত্রে বাইরে থেকে সরাসরি শরীরে বাতাস দেওয়া হয়। কেউ পানিতে ডুবে গেলে, উদ্ধারের পর মুখে মুখ লাগিয়ে বাতাস দিতে হয়। এর নাম, সিপিআর (CPR)। এটিও একধরনের পজেটিভ প্রেশার ভেন্টিলেশন।

ব্যাগিং-এর পদ্ধতিকে আরেকটু এগিয়ে নেন আলবার্ট বাওয়ার ও ভিভিয়ান রে বেনেট। তাঁরা রবার ব্যাগের সঙ্গে জুড়ে দেন একটি নল। ঘাড়ের দিকে একটুখানি কেটে, নল দিয়ে ব্যাগটাকে সরাসরি যুক্ত করে দেন ট্রাকিয়ার সঙ্গে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাইলটদের ফুসফুসে অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহ করেন তাঁরা। কিন্তু এই পদ্ধতি সবার কাছে এত উদ্ভট লেগেছিল যে বাওয়ার-বেনেটকে খুব অখ্যাত এক জার্নালে এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করতে হয়।

১৯৫০ সাল। ইবসেন ততদিনে আবারো ডেনমার্কে ফিরে এসেছেন। যোগ দিয়েছেন কোপেনহেগেনের ব্লেগদাম হাসপাতালে। ব্যাগিংয়ের সঙ্গে পরিচিত থাকায় অখ্যাত সেই জার্নালে প্রকাশিত পেপারটি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। পড়েওছিলেন মন দিয়ে। হয়তো ভুলেও গিয়েছিলেন। তারপর পেরিয়ে গেছে আরও দুই বছর। কিন্তু বাস্তবে ওই পদ্ধতির ব্যবহার কোথাও তখনো সেভাবে শুরু হয়নি। প্রয়োজনও পড়েনি। আয়রন লাং দিয়ে কাজ চালিয়ে গেছেন চিকিৎসকরা। 

১৯৫২ সালের ২৫ আগস্ট ইবসেনের ঠিক মনে পড়ে গেল সেই উদ্ভট পদ্ধতির কথা। বললেন ল্যাসেন ও উপস্থিত অন্যান্য চিকিৎসকদের। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ল্যাসেন রাজি হলেন পরীক্ষা করে দেখতে, এটা আদৌ কাজ করে কি না। কিন্তু পরদিন ভিভি এবার্ট নামে ১২ বছর বয়সের এক কিশোরী ভর্তি হলো ব্লেগদাম হাসপাতালে। মেয়েটি যখন ঠিকভাবে শ্বাস নিতে না পেরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে গিয়ে প্রায় হারতে বসেছে, ইবসেন ঠিক করলেন, ওই পদ্ধতি ব্যবহার করে মেয়েটিকে তিনি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন।

পরদিন সকাল সোয়া-এগারোটায় একজন সার্জন ইবসেনের নির্দেশমতো অপারেশন শুরু করল। ঘাড়ের দিকে একটুখানি কেটে একটি নল, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘ট্রাকিওস্টোমি টিউব’, ঢুকিয়ে দিল সরাসরি মেয়েটির শ্বাসনলে। কিন্তু ফল হলো উল্টো। দেখা গেল, তার অক্সিজেন লেভেল আরও নেমে গেছে।

টিউবের সঙ্গে ইবসেন অক্সিজেন ভর্তি একটি রবারের ব্যাগ জুড়ে দিলেন। ব্যাগের অন্যপাশটা যুক্ত আছে একটি অক্সিজেন ট্যাঙ্কের সঙ্গে। প্রতিবার ব্যাগে চাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির ফুসফুস ভরে যাচ্ছে অক্সিজেনে। কিন্তু মেয়েটি সেই অক্সিজেন নিতে চাচ্ছে না। উল্টো পাগলের মতো বের করে দিতে চাচ্ছে জোর করে। লালা বেরিয়ে এসেছে ওর মুখের চারপাশে। চারপাশে জড়ো হওয়া সব আগ্রহী চিকিৎসকরা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছেন রুম থেকে। নিশ্চয়ই ভাবছিলেন, এই পদ্ধতি দিয়ে আর যাই হোক, কারো জীবন বাঁচানো যাবে না।

ইবসেন হাল ছাড়লেন না। সোডিয়াম থায়োপেন্টাল দিলেন মেয়েটিকে। সিডেটিভ। ধীরে ধীরে মেয়েটির শরীর কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ করা থামিয়ে দিল। মেয়েটির ফুসফুস টেনে নিল রবার ব্যাগের অক্সিজেন। ভিভি এবার্টের হয়ে ইয়ন ইবসেন শ্বাস নিয়ে গেলেন, দীর্ঘ সময়!

স্বেচ্ছাসেবী মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা পোলিও আক্রান্ত বাচ্চাদের ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে কৃত্রিম শ্বাস দিচ্ছেন

থায়োপেন্টালের প্রভাব ফুরিয়ে এলে চিকিৎসকরা যখন রবারের ব্যাগ চাপা থামালেন, আবারো প্রশ্বাসের অভাবে খিঁচুনি উঠল ভিভির। দ্রুত ব্যবস্থা করা হলো। একইভাবে ব্যাগ চেপে শ্বাস চালিয়ে যাওয়া। বাওয়ার-বেনেট এবং ইবসেনের কাঁধে ভর করে বেঁচে গেল ভিভি এবার্ট। আবিষ্কৃত হলো আধুনিক ভেন্টিলেটর।

পরবর্তী ৮ দিন ছিল এই ভেন্টিলেটর প্রয়োগের সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল সময়। অগ্নিপরীক্ষা। ২৫০টি ১০ লিটারের অক্সিজেন সিলিন্ডার লেগেছে প্রতিদিন। ৭০ জনের বেশি রোগীকে ছোট্ট ওই হাসপাতালে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে শ্বাস দিতে হচ্ছে। কিন্তু এত ব্যাগ এতক্ষণ ধরে চাপবে কে?

দেড় হাজার মেডিক্যাল ও ডেন্টাল শিক্ষার্থী এগিয়ে এল সাহায্যে। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দিন-রাত পালা করে চেপে গেল ব্যাগ। এই দেড় হাজার শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ব্লেগদাম কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সবাইকে সুরক্ষা-সামগ্রী দিতে পারেনি তারা। মানবতার এই অপূর্ব প্রকাশ বোধ হয় নাড়িয়ে দিয়েছিল প্রকৃতিকেও। যদিও এই কথাটা ঠিক বিজ্ঞানসম্মত হলো না। কিন্তু সেই দেড় হাজার শিক্ষার্থীর একজনও আক্রান্ত হয়নি ছোঁয়াচে বালবার পোলিওতে। একে আর কীভাবে প্রকাশ করা যায়?

খুব বেশি আবিষ্কার এত দ্রুত এতটা কাজে লাগেনি মানুষের। এক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা গেল মৃত্যুর হার ৮৭% থেকে ৫০%-এ নেমে এসেছে। নভেম্বর আসতে আসতে তা নেমে এল ৩৬%-এ। পরের বছর, ১৯৫৩ সালের মার্চে মৃত্যুর হার নেমে গেল ১১%-এ।

ব্লেগদামের সেই হাসপাতালে কিন্তু শুধু ভেন্টিলেটরই আবিষ্কৃত হয়নি। একই রোগে আক্রান্ত ও জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন, এমন সবাইকে এক জায়গায় নিয়ে আসা; সেই সঙ্গে ওই বিষয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সদেরও সেখানে একইসঙ্গে সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া—এই ধারণাটিরও উদ্ভব ঘটেছিল সেবারই, ওই ব্লেগদাম হাসপাতালে। হ্যাঁ, এটাই ছিল ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (ICU) সূচনা। তারপর, ব্লেগদামকে অনুসরণ করে আরও অনেক হাসপাতালে আইসিইউ গড়ে উঠেছে, ব্যবহৃত হয়েছে ভেন্টিলেটর।

পরে এই ভেন্টিলেটর ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। যান্ত্রিক ভেন্টিলেটরের উদ্ভাবন হয়েছে। আধুনিক ভেন্টিলেটর এখন বুঝতে পারে, রোগীর কখন অক্সিজেন প্রয়োজন। কী পরিমাণ অক্সিজেন লাগবে, সেটাও সে হিসাব করে বের করে নিতে পারে।

সে সময় এসবের কিছুই ছিল না। ফলে বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবীদের। ব্লেগদাম হাসপাতালেরই কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাদের সে সময়ের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এরকম একজন উফে কার্ক। ১৯৫২ সালে তার বয়স ছিল ২৫। তার এক চিঠি থেকে জানা যায়, রোগীরা যেন ঠিকভাবে ঘুমাতে পারে, সে জন্য রাতে বাতি নিভিয়ে দেওয়া হতো। অনেক সময় দেখা যেত, রাতেই কোনো সময় রোগী মারা গেছে। অথচ স্বেচ্ছাসেবী তা সকাল হওয়ার আগে জানতে পারেনি। আবার কেউ হয়তো বোঝেনি, কোনোভাবে খুলে গেছে রোগীর ঘাড়ে লাগানো টিউব। বা টিউবের সঙ্গে যুক্ত রবারের ব্যাগ হয়তো বিচ্ছিন্ন হয় গেছে কিছুটা। ফলে, মারা গেছে রোগী। সেই খবর পাওয়া গেছে সকাল হওয়ার পর। কী ভয়ংকর কষ্টের সেই অনুভূতি!

এতকিছুর পরেও তাঁরা ঠিকই সেবা দিয়ে গেছেন। সরে আসেননি। এ ছাড়াও, ব্লেগদাম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য আইসিইউতে বই পড়া, গান শোনা ইত্যাদির ব্যবস্থা রেখেছিল। যতভাবে সম্ভব, যত্ন করার চেষ্টা করেছে রোগীদের।

অনেক অ্যানেস্থেশিস্ট ও ইন্টেনসিভ কেয়ারের চিকিৎসক আগস্টের ২৬ তারিখকে ‘ইয়ন ইবসেন দিবস’ হিসেবে পালন করেন। কিন্তু আজও, অনেকেই জানেন না ইবসেনের নাম। জানেন না, তিনি কী করেছিলেন। লাখো-কোটি মুমূর্ষু মানুষের জীবন বাঁচানোর পথ দেখিয়ে যাওয়ার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞান কিন্তু আজীবন ঋণী থাকবে ইয়ন ইবসেনের কাছে।

সূত্র: স্মিথসোনিয়ান, নেচার, উইকিপিডিয়া