কোভিডের নতুন ওষুধ

কোভিড অতিমারির সম্ভাব্য চতুর্থ ঢেউয়ের প্রাক্কালে বিজ্ঞানীরা আশার আলো দেখালেন আবার। সংক্রমণের দুই বছর পর কার্যকর অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের দেখা পেল বিশ্ববাসী। এর আগে ফ্ল্যাপিরাভির, রেমডিসিভিরসহ বেশ কিছু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহৃত হয়েছে কোভিডের সংক্রমণে। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন (অ্যান্টিম্যালেরিয়া) ও আইভারমেকটিন নিয়ে ট্রায়াল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে আগেই। কেবল রেমডিসিভির ছাড়া আর কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ তেমন কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু রেমডিসিভির যেমন উচ্চমূল্য, তেমনি এর আরেকটি সমস্যা হলো, এটি ইনজেকশনের মাধ্যমে দিতে হয় বলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। তাই শুরু থেকেই মুখে খাবার ও সহজে ক্রয়যোগ্য একটি কার্যকর অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের জন্য বিজ্ঞানীরা প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে ৪ নভেম্বর যুক্তরাজ্য বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে মুখে খাওয়ার অ্যান্টিভাইরাল মলনুপিরাভিরের অনুমোদন দেয় কোভিড সংক্রমণে ব্যবহারের জন্য।

মলনুপিরাভির নিয়ে গবেষণার শুরু কিন্তু কোভিডের অনেক আগে থেকেই। এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বেশ আগে থেকে এই অ্যান্টিভাইরালের ট্রায়াল শুরু করেছিলেন ভেনিজুয়েলান এনকেফালাইটিস ভাইরাসের বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালে সার্স ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহারের ট্রায়াল যুক্ত হয় এর সঙ্গে। মার্স ভাইরাসের বিরুদ্ধেও এর ট্রায়াল চলছিল। কোভিড আসার পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। শুরু হয় করোনাভাইরাসের বিপরীতে এর কার্যকারিতার গবেষণা। অবশেষে সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে সংক্রমণের শুরুতে মলনুপিরাভিরের ব্যবহার কোভিডে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বা জটিল হওয়ার ঝুঁকি অর্ধেক কমিয়ে দিতে পারে। ওষুধটি বাজারে এনেছে মার্ক কোম্পানি।

এর এক দিন পরই যুক্তরাজ্যের ফাইজার ঘোষণা দেয় যে তাদের আবিষ্কৃত প্যাক্সলোভিড ওষুধটি কোভিডে আক্রান্ত ব্যক্তির হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি ৮৯ শতাংশ কমাতে সক্ষম। নিঃসন্দেহে এই দুটি নতুন ওষুধের আবির্ভাব আমাদের জন্য সুসংবাদ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা ভ্যাকসিন ও কার্যকর অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের সহজলভ্যতা অচিরেই এই অতিমারির সমাপ্তি ঘোষণা করতে সক্ষম হবে। এখন দেখা যাক, কীভাবে কাজ করে এই দুটি ওষুধ আর কতটাই–বা নিরাপদ।

মলনুপিরাভির কাজ করে ভাইরাল জেনোমের মিউটেশন ঘটিয়ে। ওষুধটি সেবনের পর এর একটি মেটাবলাইট বা উৎপাদিত বিপাক বর্জ্য ভাইরাসের এনজাইম আরএনএ ডিপেনডেন্ট আরএনএ পলিমেরেজ দ্বারা গৃহীত হয়। তারপর ভাইরাল জেনোমের মধ্যে প্রবেশ করে আর মিউটেশন ঘটিয়ে এত বেশি ‘এরর’ সৃষ্টি করতে থাকে যে ভাইরাসটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। মলনুপিরাভির মোট পাঁচ দিনের কোর্সে গ্রহণ করতে হয়। আবিষ্কারকেরা বলছেন, যেহেতু মানুষের কোষ ডিএনএ ধারণ করে, আরএনএ নয়, তাই এটি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু কিছু বিজ্ঞানী দাবি করছেন, মলনুপিরাভিরের প্রয়োগ মানবদেহের কোষের ডিএনএ মিউটেশন ঘটাতে পারে। তাই কেবল সঠিক প্রয়োজনেই এই ওষুধ প্রয়োগ করা উচিত আর গর্ভবতী নারীদের জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

অন্যদিকে প্যাক্সলোভিড কাজ করে ভাইরাল প্রোটিনের ওপর। ভাইরাসের কিছু প্রোটিন চূড়ান্ত কার্যকারিতার পথে প্রসেস করার সময় যে এনজাইম ব্যবহার করে, সেই এনজাইমকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় এই ওষুধ। ফলে ভাইরাস তার কার্যক্ষমতা হারায়। তবে ওষুধটি যাতে যকৃতে ভেঙে না যায়, সে জন্য এর সঙ্গে আরেকটি অ্যান্টিভাইরাল রিটোনাভিরের দরকার পড়বে। দুটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের এই কম্বিনেশন মানবদেহের জন্য কতটা সহনীয় হবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।

মার্ক দাবি করছে, মলনুপিরাভির ডেলটা, বিটা ভেরিয়েন্টসহ বর্তমান সব ধরনের কোভিড ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর। তবে কোনো কোনো বিজ্ঞানী আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে যেহেতু এটি ভাইরাসের জিনোম পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম, সেহেতু এর ব্যবহারে ভবিষ্যতে আরও নতুন ভেরিয়েন্টের উদয় হওয়া অসম্ভব নয়। ব্যাপক ব্যবহারের পর ওষুধ দুটির অ্যান্টিভাইরাল রেজিস্ট্যান্স (ভাইরাসের দেহে অকার্যকার) আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

ওষুধ দুটির অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক ব্যবহার নিয়েও শঙ্কিত বিজ্ঞানীরা। ভাইরাস সংক্রমণের একেবারে শুরুর দিকে, যখন শরীরে ভাইরাস রেপ্লিকেশন করে, তখনই এটি প্রয়োগ করলে সর্বাধিক কার্যকর হবে। তাই দ্রুত কোভিড টেস্ট করে রোগ শনাক্ত না করতে পারলে কোনো লাভ হবে না। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশে, আক্রান্তদের কোভিড টেস্ট করতে অনেক দেরি হয়ে যায়, যখন হয়তো ওষুধ দিয়ে আর কাঙ্ক্ষিত লাভ হবে না। আবার অনেক দেশে সাধারণ ফ্লু বা জ্বর–কাশিতেও ওষুধের অপপ্রয়োগ ঘটতে পারে। এরই মধ্যে উন্নত দেশগুলো বিপুল পরিমাণে অ্যান্টিভাইরাল অর্ডার করতে শুরু করেছে, ফলে কোভিড ভ্যাকসিনের মতো এখানেও বৈষম্যের সৃষ্টি হতে পারে। আগেও দেখা দেখা গেছে, মানুষ আতঙ্কে ওষুধ কিনে জমিয়ে রাখতে পারে বা নিজেরাই উপসর্গ দেখে শুরু করে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে দ্রুত অ্যান্টিভাইরাল রেজিস্ট্যান্স দেখা দেওয়া অসম্ভব নয়।

কোভিড ট্রায়ালে অপেক্ষা করে আছে আরও কিছু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ। রেমডিসিভিরের মুখে খাওয়ার ওষুধ আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলছে। তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে আরও কিছু ওষুধ। ঠিক কবে কীভাবে এই অতিমারি শেষ হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। কিন্তু বিজ্ঞান বসে নেই।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা