‘জীবাণু লাইব্রেরি’ পোর্টন ডাউন

জীবাণু বা অণুজীব প্রাণিজগতে যেমন আতঙ্কের বিষয়, তেমনি গবেষকদের কাছে এরা রহস্য। তাই ব্রিটেনে রয়েছে জীবাণুদের লাইব্রেরি। ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে পোর্টন গ্রামের উত্তর–পূর্বে আছে রোগজীবাণুদের এই লাইব্রেরি। নাম, পোর্টন ডাউন। সেখানে সংরক্ষিত আছে ১০ হাজারের বেশি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাক। ইবোলা, প্লেগ ও অ্যানথ্রাক্সের মতো ব্যাকটেরিয়া আছে এই জীবন্ত লাইব্রেরিখ্যাত পোর্টন ডাউনে। অত্যন্ত গোপনীয় ও সশস্ত্র পাহারায় সংরক্ষিত আছে বিশ্বের বিপজ্জনক সব জীবাণু। প্রায় শত বছরের পুরোনো এই জীবন্ত লাইব্রেরিতে প্রাণঘাতী জীবাণু নিয়ে গবেষণা করেন শীর্ষস্থানীয় গবেষকেরা।

ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারের স্যালিসবারির বাইরে পাঁচ মাইল দূরে এই পোর্টন ডাউন। ১৯১৬ সালে চালু হয়েছিল সাত হাজার একরের এই গবেষণাগার। শুরুতে এটি ছিল ব্রিটেনের যুদ্ধ বিভাগের পরীক্ষামূলক স্টেশন। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রয়্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশন’। মূলত যুদ্ধের রাসায়নিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য খোলা হয়েছিল এই পরীক্ষাগার। এখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের ব্যবহৃত রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণা হতো। শুধু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ব্যবহার করা হয় একে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এটি ধীরে ধীরে রাসায়নিক ও জৈবিক গবেষণার স্থান হয়ে ওঠে।

বর্তমানে পোর্টন ডাউন নামে পরিচিত এই জীবন্ত লাইব্রেরিতে বিশাল বিশাল সব ধাতব পাত্রে সংরক্ষিত আছে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাক। এগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। পোর্টন ডাউনের সংগ্রহে আছে ৫ হাজার ৫০০ ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ৩০০ ধরনের ভাইরাস ও বিভিন্ন মানবকোষ। এগুলো অ্যান্টিবায়োটিক গবেষণা, আলঝেইমার ও ক্যানসারের মতো রোগের চিকিৎসায় সহায়তা করে। কোভিড–১৯–এর সময়ে বিজ্ঞানীদের টিকা ও কার্যকর চিকিৎসা উদ্ভাবনে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এখানে প্রাণঘাতী ইবোলা নিয়ে গবেষণা করা হয়। এখনো সক্রিয় এই গবেষণা।

গবেষণা করা হয় প্রাণঘাতী প্লেগ নিয়েও। একটি দ্বিতল ভবন এই গবেষণা বা পরীক্ষাগারের মূল কেন্দ্র। দেখতে অনেকটা হাসপাতালের মতো। তবে এখানে প্রবেশাধিকার খুব সীমিত। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় পরিচালিত হয় সবকিছু। পরীক্ষাগারের ভেতরে চারটি বিভাগ রয়েছে, যেগুলো রোগজীবাণুর বিপদের মাত্রার ঊর্ধ্বক্রম অনুসারে সাজানো। পরীক্ষাগারের ভেতরে প্রবেশ করতে পরতে হয় বিশেষ ধরনের পোশাক। এসব প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরে কাজ করেন গবেষকেরা।

তবে এখনো এই পরীক্ষাগার নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকের ধারণা, এখনো এখানে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করা হয়। যদিও ব্রিটেন অনেক আগেই এ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে। তবে বিভিন্ন সংঘাত–যুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার এর দিকে আঙুল তোলে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৬ সালের স্নায়ুযুদ্ধের সময়, যুক্তরাজ্যজুড়ে রাসায়নিক আক্রমণ কীভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে, তা বোঝাতে আকাশ থেকে কয়েকটি পরীক্ষা চালানো হয়। যদিও তা সাধারণ মানুষের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি।

যাহোক, বর্তমানে যুক্তরাজ্যের এই গোপন গবেষণাগার বা রোগজীবাণুর জীবন্ত লাইব্রেরি কাজ করছে ভয়ংকর সব রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আবিষ্কারে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরীক্ষাগার হিসেবে কাজ করছে এই শতবর্ষী পোর্টন ডাউন।

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম

সূত্র: বিবিসি, দ্য কনভার্সেশন, উইকিপিডিয়া